১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বন্ধু নির্বাচনে ইসলাম ও আমরা

-

বন্ধু শব্দের আরবি প্রতিশব্দ- সাদিক। বাংলায় বন্ধুর একটি সুন্দর প্রতিশব্দ রয়েছে, আর তা হলো- ‘কল্যাণকামী’। বন্ধু হলো মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসার এক অটুট সম্পর্ক। সুসম্পর্ক থেকে সৃষ্টি হয় গভীর বন্ধুত্ব। ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ডেটাবেজ গবেষণায় দেখা গেছে, ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের কারণে মানুষ সুখী হয়। কিন্তু আজকাল যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বন্ধু নির্বাচন করছি। মিডিয়া আর তথ্যপ্রযুক্তির যুগে গুলিয়ে ফেলেছি আসল বন্ধুত্বের রহস্যটা। এ যুগে বন্ধু বানাতে যেমন সময়ের প্রয়োজন হয় না, আবার বন্ধুত্ব ত্যাগ করতেও সময় লাগে না। প্রায়ই দেখি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে যাদেরকে বন্ধু বানানো হয়, কয়েক দিন পর চোখের পলকেই আবার চলে যায়। কিন্তু পাশে থাকা প্রকৃত বন্ধুগুলোই থেকে যায়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি জায়গায় বন্ধুত্বের এক ধরনের ছায়া থেকেই যায়।
ইদানীং বন্ধু বানানো খুবই সহজ; কিন্তু গভীর সম্পর্কটা ধরে রাখা বেশ কঠিন। বাস্তবচিত্র হলো- পথে-ঘাটে যেখানে-সেখানে অবাধে মেলামেশা থেকে শুরু করে যেভাবে বন্ধুত্বের দাবিদার হয়ে নিজেকে অসাবলীলভাবে প্রকাশ করি তা ভেবে দেখার বিষয়! আসলে আমি কী করছি? আদৌ ইসলাম এই বন্ধুত্বের চিত্রটি সমর্থন করে?
একটু ভাবুন, আমরা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে আমরা যেভাবে বন্ধুত্বের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছি অথবা দিনের পর দিন সময় অপচয় করে যার পেছনে সময় ব্যয় করছি সেটি কি আদৌ ঠিক হচ্ছে? বলা হয়ে থাকে, লক্ষ্যহীন মানুষ সময়ের অপচয় করে। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা পাঁচটি জিনিসকে তার বিপরীত পাঁচটি জিনিসের আগে মূল্যায়ন করো ও তার সদ্ব্যবহার করো। তোমার যৌবনকে বার্ধক্যের আগে, সুস্থতাকে অসুস্থতার আগে, সচ্ছলতাকে দারিদ্র্যের আগে, অবসরকে ব্যস্ততার আগে, জীবনকে মৃত্যুর আগে’ (বায়হাকি-১০২৪৮, মুসনাদে হাকিম-৭৮৪৬)।
বর্তমান বন্ধুবান্ধব খুব সতর্কতার সাথে বেছে নেয়া উচিত। কারা বন্ধু হবে আর কারা হবে না- এ ব্যাপারে বিচক্ষণ হওয়া দরকার। ভালো-মন্দ লোক চেনা বড় কঠিন! বন্ধুত্ব পাতানোর আইডিয়ার ওপর ভিত্তি করেই আজ সামাজিক মাধ্যমগুলো বিশেষ ভূমিকা রাখছে। যেমন- ফেসবুকের কথাই বলা যাক। একজনকে বন্ধু বানালে আরো ১০ জন বন্ধু হওয়ার দরজা খুলে যায়। কার সাথে, কবে কখন, কিভাবে দেখা হয়েছিল সেটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে ধরে নেয়া হয় না; কিন্তু সে যে আরো বড় নেটওয়ার্ক নিয়ে আসছে সেটিই চ্যালেঞ্জ। সুতরাং খুব সতর্কতার সাথে আমাদের বন্ধু বানানো উচিত।
ইমাম গাজ্জালি রাহ: বলেছেন, ‘যার সাথে বন্ধুত্ব করবে তার মধ্যে পাঁচটি গুণ থাকা চাই। আর তা হলো- ‘বুদ্ধিমত্তা, সৎ স্বভাবের অধিকারী হওয়া, পাপাচারী না হওয়া, বিদয়াতি না হওয়া ও দুনিয়াসক্ত না হওয়া।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বলুন আর বাস্তবতার নিরিখেই বলুন, আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক এমনটাই হওয়া দরকার।
আমাদের প্রিয় নবী সা:-এর জীবনে যে বন্ধু ছিলেন না এমনটি নয়। তাঁরও বন্ধু ছিলেন। আমরা তাঁর জীবন থেকে হলেও বন্ধু নির্বাচন বিষয়টি শিক্ষণীয় হিসেবে দেখতে পারি। কারণ, তিনি হলেন দুনিয়ার একমাত্র স্মার্ট ব্যক্তি যাকে পুরো দুনিয়ার মুসলিম তথা অন্যান্য জাতির মানুষও কমবেশি অনুসরণ করে থাকে। অতএব, রাসূল সা: -এর জীবনীই আমাদের জন্য শিক্ষণীয় ও তিনি আমাদের জন্য বাস্তব মডেল। তিনি বন্ধু বেছে নিয়েছেন খুব সতর্কতার সাথে। এরা কারা? যারা প্রিয় নবীর বন্ধুবান্ধব!
আবু বকর সিদ্দিক রা: যিনি নবী করিম সা:-এর শুধু বিশ্বস্ত সাহাবি ছিলেন না; বরং প্রকৃতপক্ষে একজন ভালো বন্ধুও ছিলেন। কখনো মদ পান করেননি। মূর্তিপূজাও করেননি। তিনি ছিলেন সামাজিক। তিনি সামাজিক কাজে অংশগ্রহণে পারদর্শী ছিলেন।
জাবরা আর-রুমি : পেশায় তিনি ছিলেন কামার। বহুভাষী খ্রিষ্টান, সুশিক্ষিত ও ধর্মগ্রন্থের প্রতি প্রবল আগ্রহী ছিলেন। এই বিধর্মী জাবরা আর-রুমি রাসূলুল্লাহ সা:-এর ভালো বন্ধু ছিলেন। তবে এই বন্ধুকে নিয়ে তখনকার সময়ে মূর্তিপূজারী আরবদের ভেতরে একপ্রকার গুঞ্জন উঠেছিল। আরবদের ভেতরে দাবি উঠেছিল যে, এই লোকই নবীকে কুরআন শিখিয়েছে। কিন্তু মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন মাজিদে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন- ‘আমি ভালো করেই জানি তারা কী বলে। তারা বলে, নবীকে তো এক লোক এসব শিখিয়ে দেয়। তারা যে লোকের কথা বলে, তার ভাষা তো অনারবি। অথচ এই কুরআন স্পষ্ট আরবিতে’ (সূরা আন নাহল : ১৬/১০৩)। অবশ্য বিভিন্ন বর্ণনায় বিভিন্ন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, মক্কার কাফেররা তাদের মধ্য থেকে কার সম্পর্কে এ ধারণা করত।
হাকিম ইবনে হিজাম : যিনি বুদ্ধিমান ও একজন দানশীল নেতা ছিলেন ও হাজীদের মেহমানদারি করতেন।
কোনো মানুষকে বন্ধু হিসেবে নির্বাচন করতে হলে যে গুণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে তা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও’ (সূরা তাওবা-১১৯)।
নবী করিম সা: বিদেশী, আরব ও মূর্তিপূজারী ও খ্রিষ্টানদের সাথে মিশলেও কাছের মানুষ হিসেবে সমাজের সবচেয়ে ভালো মানুষগুলো বেছে নিয়েছেন। তারা সবাই ভিন্ন ভিন্ন বয়সের ছিলেন। তারা সবাই সমাজের কাছে ছিলেন ভালো মানুষ ও সম্মানিত।
অতএব, বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, অমুক ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব হওয়াতে আমি আগের চেয়ে পরিবর্তন বা ভালো হচ্ছি কী না! তার সাথে আমার কথা বা মনের দিক থেকে কতটুকু মিল আছে? এ ক্ষেত্রে ইসলামী দৃষ্টিকোণ অবশ্যই সামনে রাখতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement