২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পরকীয়া ও ইসলাম

-

পরকীয়া একটি অমানবিক ক্রিয়া। বিকৃত মানসিকতার কাজ। সুস্থ মস্তিষ্কেও কোনো নারী-পুরুষ পরকীয়ায় লিপ্ত হতে পারে না। ইদানীং আমাদের সমাজে পরকীয়া বা বিয়ে-পরবর্তী শারীরিক সম্পর্কের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব পরকীয়া সম্পর্কে প্রবাসীদের স্ত্রীরা সবচেয়ে বেশি লিপ্ত হচ্ছে। আজকাল খবরের কাগজ হাতে নিলেই চোখে পড়ে গৃহবধূ ধর্ষণের খবর। গবেষণায় দেখা গেছে, গৃহবধূ ধর্ষণের পেছনে পরকীয়া সম্পর্কের যোগসূত্র অনেক।

পরকীয়া সম্পর্ক থেকেই বেশির ভাগ গৃহবধূ ধর্ষিত হচ্ছে। পরকীয়া সম্পর্কে যেমন সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্ট হয়, তেমনি পারিবারিক সম্পর্কে ফাটল ধরে। ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অমিল দেখা দেয়। একসময় তাদের বৈবাহিক জীবনে ভাঙন সৃষ্টি হয়। পরকীয়ার বিষফল মানবজাতি দীর্ঘকাল থেকে ভোগ করে আসছে। পরকীয়ার মতো জঘন্যতম অপরাধের অসারতা নিজের বিবেককেও ধিক্কার জানায়। নিজের স্ত্রী অন্য কারো সাথে সম্পর্কে লিপ্ত হোক, কিংবা নিজের স্বামী অন্য কোনো মহিলার সাথে মেলামেশা করুক এটি কোনো সুস্থ বিবেকবানই মেনে নেবেন না। ইসলামও পরকীয়া-ব্যভিচারকে সমর্থন করে না।

ইসলাম মানবিক ধর্ম। ইসলাম নীতি ও আদর্শের ধর্ম। ইসলাম হালাল তরিকায় নারী-পুরুষের মেলামেশার সুযোগ দিয়েছে। বৈধ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই ইসলাম পৃথিবীতে মানুষের জৈবিক চাহিদা পূরণকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইসলামে পরকীয়া-ব্যভিচার অবৈধ সম্পর্কে নারী-পুরুষের মেলামেশাকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। নারী-পুরুষ সবাইকেই চরিত্র সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘তোমরা জিনা বা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। এটি অত্যন্ত খারাপ কাজ এবং খুবই জঘন্য আচরণ’ (সূরা বনি ইসরাইল-৩২)।

শহর কিংবা গ্রাম সবখানেই এখন চরমভাবে পর্দার বিধান লঙ্ঘন হচ্ছে। ফলে কখনো দেবরের সাথে, আবার কখনো পুত্রের (স্বামীর ভাইয়ের ছেলে) সাথে পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে উঠছে। ইসলামে দেবর ও পুত্রের (স্বামীর ভাইয়ের ছেলে) কাছে যাওয়ার লাগাম টেনে ধরা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘সাবধান! তোমরা নির্জনে একাকী নারীদের কাছেও যেয়ো না। এক আনসার সাহাবি বললেন, ‘হে আল্লøাহর রাসূল সা:, দেবর সম্পর্কে আপনার নির্দেশ কী? উত্তরে নবী করিম সা: বললেন, ‘দেবর তো মৃত্যুর সমতুল্য’ (বুখারি-৫২৩২, মুসলিম-২১৭২)।

ইসলামে শুধু অবৈধ শারীরিক সম্পর্কের চূড়ান্ত রূপটাই জিনা নয়। বরং যেসব কাজ জিনার প্ররোচনা দেয় সেগুলোকেও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং তাকেও জিনা বলে গণ্য করা হয়। হাদিসে এসেছে ‘চোখের ব্যভিচার হলো দেখা, কানের ব্যভিচার শোনা, জিহ্বার ব্যভিচার বলা, হাতের ব্যভিচার ধরা, পায়ের ব্যভিচার হাঁটা। মন কামনা করে আর লজ্জাস্থান তা সত্য বা মিথ্যায় পরিণত করে’ (মুসলিম-২৬৫৭)। অর্থাৎ চোখ-কান-হাত-পা-জিহ্বা সবই জিনা করে- জিনার প্ররোচনা দেয়, আর যা পূর্ণতা পায় লজ্জাস্থানের মাধ্যমে। সুতরাং এসব অঙ্গের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

পরকীয়ার মতো কর্মকাণ্ডে খুন-খারাবি থেকে শুরু করে আত্মহত্যার সিরিজ চলছে! ব্যক্তির ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের দায়ে পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজন পর্যন্ত সমাজে মুখ দেখাতে পারছে না। এসব নোঙরা অধঃপতিত কুকর্মগুলো পরিবার, সমাজ ও সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের কপালে ভয়ঙ্কর এক পৈশাচিক অশ্লীলতার তিলক লাগিয়ে দিচ্ছে। সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় অনুশাসন থেকে ছিটকে পড়া আমাদের আধুনিক এই সমাজব্যবস্থা এটিকে প্রতিরোধ করার সক্ষমতা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে।

ব্যভিচারী পুরুষ ও ব্যভিচারিণী নারীদের শাস্তি সম্পর্কে বিচারকদের সতর্ক করে মহান আল্লøাহ তায়ালা বলেন, ‘ব্যভিচারিণী নারী ও ব্যভিচারী পুরুষ উভয়ের প্রত্যেককে ১০০ বেত্রাঘাত করো। আর আল্লøাহর দ্বীনের ব্যাপারে তাদের প্রতি কোনো মমত্ববোধ ও করুণা যেন তোমাদের মনের মধ্যে না জাগে যদি তোমরা আল্লøাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান আনো। আর তাদেরকে শাস্তি দেয়ার সময় মুমিনদের একটি দল যেন উপস্থিত থাকে’ (সূরা আন নূর-২)।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘অবিবাহিত নারী ও অবিবাহিত পুরুষ ব্যভিচার করলে শাস্তি : ১০০ বেত্রাঘাত ও এক বছরেরর জন্য নির্বাসন। বিবাহিত নারী বিবাহিত পুরুষের সাথে ব্যভিচার করলে শাস্তি ১০০ বেত্রাঘাত ও পাথর নিক্ষেপে হত্যা’ (মুসলিম-১৬৯০)।

‘জিনাকারীরা উলঙ্গ অবস্থায় এমন এক চুলার মধ্যে থাকবে, যার অগ্রভাগ হবে অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ আর নিম্নভাগ হবে প্রশস্ত, এর তলদেশে অগ্নি প্রজ্বলিত থাকবে, তাদেরকে তাতে দগ্ধ করা হবে। তারা মাঝে মধ্যে সেখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার কাছাকাছি অবস্থায় পৌঁছে যাবে; অতঃপর আগুন যখন স্তিমিত হয়ে যাবে তখন তাতে তারা আবার ফিরে যাবে। আর তাদের সাথে এ আচরণ কিয়ামত পর্যন্ত করা হবে’ (বুখারি-৭০৪৭)।

পরকীয়া প্রেম বা অন্যের বিয়ে বন্ধনে থাকা স্ত্রীর সাথে প্রেম-প্রণয়ের মাধ্যমে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া আরো জঘন্য অপরাধ ও মহাপাপ। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, একদা আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল সা:, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড় পাপ কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘কাউকে আল্লøাহর সমকক্ষ নির্ধারণ করা।’ আমি বললাম, ‘এটি নিশ্চয়ই জঘন্যতম গুনাহ। তারপর কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘তোমার সন্তান তোমার সাথে আহারে অংশ নেবে এ আশঙ্কায় সন্তানকে হত্যা করা।’ আমি বললাম, এরপর কোনটি? তিনি বললেন, ‘তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া’ (সূরা আল ফুরকান-৬৮, ৬৯; বুখারি-৪৪৭৭, ৬৮৬১, ৭৫২০, ৭৫৩২; মুসলিম-৮৬; আবু দাউদ-২৩১০)।

রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘হে মুসলমানগণ! তোমরা ব্যভিচার পরিত্যাগ করো। কেননা, এর ছয়টি শাস্তি রয়েছে। এই মন্দ পরিণতির মধ্যে তিনটি দুনিয়াতে ও তিনটি আখিরাতে প্রকাশ পাবে। যে তিনটি শাস্তি দুনিয়াতে হবে তা হচ্ছে- ১. তার চেহারার ঔজ্জ্বল্য বিনষ্ট হয়ে যাবে; ২. তার আয়ুষ্কাল সঙ্কীর্ণ হয়ে যাবে এবং ৩. তার দরিদ্র্যতা চিরস্থায়ী হবে। আর যে তিনটি শাস্তি আখিরাতে প্রকাশ পাবে তা হচ্ছে- ১. আল্লøাহর অসন্তোষ; ২. কঠিন হিসাব ও ৩. জাহান্নামের শাস্তি’ (বায়হাকি-৫৬৪)।
জিনা বা ব্যভিচার ইসলামসহ পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থে ঘৃণিত ও জঘন্য অপরাধ। সুতরাং ধর্ষণ-ব্যভিচারমুক্ত সমাজ গড়তে ধর্মীয় অনুশাসনই একমাত্র রক্ষাকবচ।
হজরত সাহল ইবনে সাদ রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে তার মুখ ও লজ্জাস্থানের হিফাজতের জামিনদার হবে; আমি তার বেহেশতের জামিনদার হবো’ (সহিহ বুখারি-৬৪৭৪)।

পরিশেষে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের গ্যারান্টির কথা স্মরণ করে দিয়ে শেষ করছি- আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তবে যে কৃত অপরাধ থেকে তাওবা করে, অতঃপর ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, পরিণামে আল্লাহ তাদের পাপগুলোকে পুণ্য দিয়ে পরিবর্তন করে দেবেন। আল্লøাহ অতীব ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু’ (সূরা আল ফুরকান-৭০)।

আসুন, পরকীয়ামুক্ত জীবন গড়ি। কুরআন-হাদিস মেনে চলি ও দয়াময় আল্লøাহর কাছে তাওবা করে সুস্থ জীবনে ফিরে আসি। আল্লøাহ আমাদের সবাইকে তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : শিক্ষক, মাস্টার তালেব উল্লাহ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বড়ঘোপ, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার


আরো সংবাদ



premium cement