২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

প্রচলিত ব্যাংক ইসলামীতে রূপান্তরের যত কারণ

-

লন্ডনভিত্তিক বিশ্ববিখ্যাত অর্থনৈতিক সাময়িকীর ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ ১৯৯৪ সালের ৬ আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত ‘সার্ভে অব ইসলাম’ শীর্ষক দীর্ঘ এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল- অতীতে বিশ্ববাসী মুসলিম স্পেন ও আন্দালুসিয়া থেকে আধুনিক শিক্ষা-সংস্কৃতি বিষয়ে জেনেছিল এবং ইসলামের কাছ থেকে ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিল। আর এখনকার বিশ্ব ইসলামের কাছ থেকে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের আইডিয়া গ্রহণ করতে পারে। পত্রিকাটির দৃষ্টিতে মুসলমানদের অতীত গৌরব তার শিক্ষা-সংস্কৃতি। আর দীর্ঘকাল পর মানবজাতির প্রতি ইসলামের বর্তমান উপহার ইসলামী ব্যাংকিং। যুক্তরাজের ডুরহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ডব্লিউ উইলসন এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, মুসলিম দেশগুলোর পুরো অর্থব্যবস্থা, বিশেষ করে ব্যাংক ব্যবস্থা, সুদমুক্ত করা না গেলে তারা পুরো জনগণকে কোনো দিনই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করতে পারবে না। তাতে মুসলিম দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নতি কখনো অপটিমাম লেভেলে পৌঁছবে না। যেমন- তুলনামূলকভাবে ঢের সস্তা হওয়া সত্ত্বেও একজন মুসলমান গরুর গোশতের বদলে কোনো দিন শূকরের গোশত কিনবে না। ভেটিকানের পোপ একবার অনুসারীদের উপদেশ দিয়েছিলেন, তোমরা ইসলামী ব্যাংকিং করো। ইউরোপীয়দের নেতৃত্বাধীন প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থার তুলনায় ইসলামী ব্যাংকিং শ্রেষ্ঠ। কারণ ইসলামী ব্যাংকিং হলো এসেট-ভিত্তিক। অন্যদিকে পশ্চিমা ব্যাংক ব্যবস্থা হলো ডেটভিত্তিক।
বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী প্রচলিত অনেক ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তরিত হচ্ছে। খোলা হচ্ছে ইসলামী ব্যাংকিং শাখা। কেন দিন দিন ইসলামী ব্যাংকিং জনপ্রিয় হচ্ছে, কেনইবা এভাবে ব্যাংক রূপান্তরের ঘটনা ঘটছে?

মরহুম এম আযীযুল হকের মতে, ‘পশ্চিমারা দুই কারণে ইসলামী ব্যাংকিং করতে চায়। প্রথমত, ইসলামী ব্যাংকিং স্থিতিশীল। এটা তারা উপলব্ধি করেছে ২০০৮ সালে, মহামন্দাকালে। দ্বিতীয়ত, তারা মুসলিম তহবিল দখলে নিতে চায়।’ তবে মুসলিম-অমুসলিম সামগ্রিকভাবে বিশে^ এ যাবৎ যত ব্যাংক রূপান্তরিত হয়েছে তার ৬২ শতাংশ রূপান্তরিত হয়েছে আদর্শগত বা ধর্মীয় কারণে। কী সেই ধর্মীয় কারণ? সংক্ষেপে তা দেখা যাক।

ইসলামের সর্বজনীনতা : ইসলাম একটি সর্বজনীন জীবনব্যবস্থা। এই সর্বজনীনতা বা অন্তর্ভুক্তিমূলক আদর্শ মানে ইসলাম সব যুগের ও সব স্থানের জন্য। এখানে ব্যক্তি মানুষের পরিচয় কোনো বিষয় নয়। তিনি কে এবং কোন দেশের নাগরিক তা ইসলামে বিবেচ্য নয়। ইসলাম সবার ধর্ম- সবার জীবনবিধান। এখানে ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-অঞ্চল নির্বিশেষে সব মানুষ সমান। এখানে মূলত মানুষ হিসেবে মানুষের সব মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা শরিয়াহ আইনের মূল উৎস কুরআন মাজিদের কয়েকটি আয়াত উদ্ধৃত করতে পারি। যেমন-

ক. আল্লাহ তায়ালা ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসৎ কাজ ও সীমালঙ্ঘন; তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো (সূরা আন-নাহল-৯০)। লক্ষ করুন, এখানে ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও অঞ্চলের সীমারেখা টানা হয়নি। এখানে সাধারণভাবে পুরো মানবজাতিকে উদ্দেশ করে আল্লাহ তায়ালা কথাগুলো বলেছেন।

খ. আমি আমার রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাদের সাথে দিয়েছি কিতাব (শরিয়াহ আইন) ও মিজান (ন্যায়দণ্ড), যাতে মানুষ ইনসাফের সাথে চলতে পারে (সূরা হাদিদ-২৫)। এখানে ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও অঞ্চলের প্রভেদ করা হয়নি। ইসলাম বা মুসলিম নয়, এখানে ‘নাস’ তথা মানুষ শব্দ ব্যবহার হরা হয়েছে।

গ. আল্লøাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন আমানত তার হকদারকে প্রত্যর্পণ করতে। তোমরা যখন মানুষের মাঝে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে (সূরা আন-নিসা-৫৮)। এখানে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারের কথা বলা হয়েছে; তাতেও ইসলাম বা মুসলিম নয়, ‘নাস’ তথা মানুষ শব্দ ব্যবহার হরা হয়েছে। অর্থাৎ ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে মুসলিম ও অমুসলিম উভয়ে সমান।

ঘ. আমি আদম-সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি; স্থলে ও সমুদ্রে তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি; ওদের স্বাস্থ্যকর জীবিকা দিয়েছি এবং যাদের সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের ওপর ওদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি (সূরা বনি ইসরাইল-৭০)। এখানে মানবজাতির প্রতি আল্লøাহর অনুগ্রহের কিঞ্চিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে, যাতে ইসলাম বা মুসলিম নয়, ‘বনি আদম’ তথা মানুষ পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর কাছে তথা ইসলামী আইনে মর্যাদা পাওয়ার ক্ষেত্রে মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

ঙ. হে বনি আদম! উপাসনাকালে তোমরা শালীন পোশাক পরিধান করবে। প্রয়োজন মতো আহার করবে ও পান করবে; কিন্তু অপচয় করবে না। নিশ্চয় আল্লøাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না (সূরা আল-আ’রাফ-৩১)। এখানে মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা তথা অন্ন ও বস্ত্রের সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে আল্লাহর কাছে তথা ইসলামী আইনে মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সে জন্য এখানে ইসলাম বা মুসলিম নয়, ‘বনি আদম’ তথা মানুষ পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে।

চ. মুশরিকদের মধ্যে যাদের সাথে তোমরা চুক্তিতে আবদ্ধ আছো- পরে যারা তোমাদের সাথে কৃত চুক্তি রক্ষায় কোনো ত্রুটি করেনি এবং তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্যও করেনি তাদের সাথে অবশ্যই নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত চুক্তি পূর্ণ করবে। নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকিদের পছন্দ করেন (সূরা তাওবা-৪)।

এখানে অমুসলিম বলে কারো সাথে চুক্তি বা ওয়াদা রক্ষা করা জরুরি নয়- এমন কিছু যাতে কোনো মুসলমানের কল্পনায়ও না আসে তার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং কোনো বৈধ কারণ না থাকলে অমুসলিমদের সাথে কৃত চুক্তি বা প্রদত্ত ওয়াদা যথাযথভাবে পূর্ণ করা মুত্তাকি হওয়ার শর্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ছ. দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের স্বদেশ থেকে বের করে দেয়নি তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন করতে ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লøাহ তো ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন (সূরা মুমতাহিনা-৮)।

ইসলামে সুদ (রিবা) নিষিদ্ধ হওয়া : ইসলাম সুদ নিষিদ্ধ করেছে এর সর্বাত্মক জুলুমের কারণে। সুদ নিষিদ্ধে ইসলামের প্রধান লক্ষ্য হলো সম্পদ যাতে সমাজের মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে পুঞ্জীভূত হতে না পারে তা নিশ্চিত করা। ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মতে, সুদের উৎপত্তি হয়েছে অভাব থেকে। গরিব মানুষ অভাবের কারণে ধনীদের কাছে টাকা ধার চায়। তখন ধনীরা এই সুদ নামক হাতিয়ারের মাধ্যমে গরিব মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করে। অপর দিকে ইসলাম চায় স্বচ্ছতা ও ইনসাফভিত্তিক একটি আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে।

কুরআনে ব্যবহৃত পরিভাষা ‘রিবা’ শুধু সুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। টাকার লেনদেন ছাড়াও ‘রিবা’ সংঘটিত হতে পারে। ক্রয়-বিক্রয়ে ‘রিবা’ সংঘটিত হতে পারে; পণ্য বিনিময়েও ‘রিবা’ সংঘটিত হতে পারে। বিনিময়ের উভয় পণ্য যদি একই হয় সে ক্ষেত্রে কোনো একটায় অতিরিক্ত প্রদান করলে বা কোনো একটা বিলম্বে প্রদান করলে সুদ হবে।

ইসলামী শরিয়তে রিবাকে দু’টি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে- ক. রিবা নাসিয়া : রিবা নাসিয়া হলো ঋণদাতা কর্তৃক ঋণগ্রহীতাকে প্রদত্ত সময়। এই সময়ের বিনিময়ে ঋণগ্রহীতা ঋণদাতাকে মূল টাকার অতিরিক্ত কিছু প্রিমিয়াম দেয়। এটাই সুদ। এটাই রিবা নাসিয়া। খ. রিবা ফদল : রিবা ফদল হলো ওজনে বা পরিমাণে বেশি দেয়া বা নেয়া। রিবা নাসিয়ার সম্পর্ক সময়ের সাথে; রিবা ফদলের সম্পর্ক ট্রেডের সাথে।

কুরআন রিবাকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করেছে। কুরআন রিবাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কুরআন রিবার লেনদেনকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। বলা হয়েছে- হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও যদি তোমরা মুমিন হও। যদি সুদ না ছাড়ো তবে আল্লøাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। তবে যদি তোমরা তওবা করো তাহলে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই থাকবে। এতে তোমরা জুলুম করবে না এবং মজলুমও হবে না (সূরা আল বাকারা-২৭৮-২৭৯)।

হাদিসে রিবার বিভিন্ন দিক বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন- ক. রিবা নিষিদ্ধকরণ; খ. রিবা লেনদেনকারীর পাপের ভয়াবহতা বর্ণনা; গ রিবার বিভিন্ন প্রকার বর্ণনা ইত্যাদি।
কুরআন ও সুন্নাহর এসব নির্দেশনা জানার পর প্রচলিত ব্যাংকারদের উচিত হলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুদের শৃঙ্খল থেকে নিজেদের মুক্ত করে নেয়া এবং যার যার অধিকার প্রকৃত হকদারকে ফিরিয়ে দেয়া।

লেখক : সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার, পূবালী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংকিং

 

 


আরো সংবাদ



premium cement