২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইসলামের অপরূপ সৌন্দর্য ‘সবর’

-

কুরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ সবরকারীদের পছন্দ করেন’। ‘সবর’ অর্থ ধৈর্য, দৃঢ়তা, বিরত রাখা ইত্যাদি, বিপদে-আপদে, দুঃখ-কষ্টে, বালা-মুসিবতে অবিচলচিত্তে সব কিছুই আল্লাহর ওপর ন্যস্ত করে নিজের করণীয় চলমান রেখে ধৈর্য ধারণ করাকে সবর বলে। আমাদের উচিত আনন্দ, ঝামেলা, দুঃখ ও উদ্বেগ ইত্যাদি সময়ে নিজেকে নিজে নিয়ন্ত্রণে রেখে আল্লাহ ও রাসূল সা: কর্তৃক নির্ধারিত সীমাবদ্ধতার মধ্যে থাকা।

জীবনের কোন কোন পর্যায়ে সবর বা ধৈর্যকে ধারণ করতে হয় তা ইমাম গাজ্জালি রা: পাঁচ ভাগে ভাগ করে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। ১. আল্লাহর ইবাদতে সবর করা; ২. আনন্দ ও খুশির সময় সবর করা; ৩. জুলুম ও নির্যাতনের সময় সবর করা; ৪. পাপ এবং হারাম কাজ থেকে বিরত থাকার ওপর সবর করা; ৫. বিপদ-আপদে সবর করা। ইমাম আহমদ বলেন, পবিত্র কুরআনে ৯০ বার সবর সম্পর্কীয় আয়াত নাজিল হয়েছে।

মানব জীবনে সবর এমন একটা মানবিক গুণ, যার অনুশীলন ছাড়া ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনে সাফল্য আশা করা যায় না। যদিও ধৈর্য ধারণ করা খুবই কঠিন ও কষ্টসাধ্য কাজ, তবুও এটি এমন এক মহৎ গুণ, যা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কল্যাণের জন্য অপরিহার্য।

মহান আল্লাহ কুরআনে ধৈর্যশীলদের অফুরন্ত প্রতিদান দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যারা ধৈর্য ধারণ করে আমি নিশ্চয়ই তাদেরকে তারা যা করে তা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব’ (সূরা নাহল : ৯৬)। ধৈর্য একটি মহৎ ও উত্তম গুণাবলিসম্পন্ন কাজ যা আল্লাহ তাঁর নবী-রাসূলদের গুণাবলি প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন, ‘আর স্মরণ করো ইসমাইল, ইদরিস ও জুল কিফলের কথা, তাদের প্রত্যেকেই ধৈর্যশীল ছিল’ (সূরা আম্বিয়া : ৮৫)।
‘এই মহান কাজ (ধৈর্য) সর্বোচ্চ গুণাগুণসম্পন্ন নবী-রাসূলদের গুণাবলির মধ্যে একটি ছিল এবং তিনি তার রাসূল মুহাম্মদ সা:কে আদেশ করেছেন ধৈর্য ধরতে। অতএব আপনি ধৈর্য ধারণ করুন যেমন ধৈর্য ধারণ করেছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ’ (সূরা আহকাফ : ৩৫)।

আবু সাঈদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যের চেয়ে উৎকৃষ্ট এবং ব্যাপকতর দান কাউকেই দেননি’(সুনানে আবু দাউদ)।

প্রকৃত ধৈর্য বলা হয়- যা কোনো অভিঘাত, দুঃখ-দুর্দশার শুরু থেকেই গ্রহণ করা হয়। নবী করিম সা: বলেন, ‘নিশ্চয় ধৈর্য যা আঘাতের প্রারম্ভেই নেয়া হয়।’ (বুখারি-১৩০২, মুসলিম-৯২৬)।

আল্লাহ বলেন, ‘ধৈর্য ধারণ করুন। আপনার সবর শুধু আল্লাহর জন্য, তাদের জন্য দুঃখ করবেন না এবং তাদের চক্রান্তের কারণে মন ছোট করবেন না’ (সূরা নাহল : ১২৭)। তিনি আরো বলেন, ‘অতএব, আপনি আপনার পালনকর্তার আদেশের জন্য ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করুন এবং ওদের মধ্যকার কোনো পাপিষ্ঠ কাফেরের আনুগত্য করবেন না’(সূরা দাহর:২৫)।

এখানে স্মরণ রাখতে হবে যে, ধৈর্যের অর্থ এই নয় যে, কাফের, মুশরিকের দুঃখ-কষ্ট, দুর্ভোগ, নিপীড়ন ও হিংসা সর্বদা সহ্য করতে হবে। বরং তাদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিতে হবে, তাদের কাছে সত্যকে স্পষ্ট করতে হবে। তবে যদি তারা অমান্য করে বা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে ঔদার্যতা প্রদর্শন না করে, মুসলমানদের এলাকায় আক্রমণ করে জান-মাল ও সম্মানের ক্ষতি করে তাহলে উচিত হলো যথাসম্ভব প্রতিহত করা। এমতাবস্থায় জিহাদ করার আদেশ রয়েছে।

সৎ কাজ করা ও অসৎ কাজ করার ক্ষেত্রে যেই কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়, সে ক্ষেত্রে ধৈর্য ধরার জন্য আল্লাহ কুরআনে উল্লেখ করেন, ‘হে বৎস, নামাজ কায়েম করো, সৎ কাজে আদেশ দাও, মন্দ কাজে নিষেধ করো এবং বিপদাপদে সবর করো। নিশ্চয় এটি সাহসিকতার কাজ।’ হাদিস শরিফে এসেছেÑ আবু সাইদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত- কিছুসংখ্যক আনসারি সাহাবি আল্লাহর রাসূল সা:-এর কাছে কিছু চাইলে তিনি তাঁদের দিলেন, পুনরায় তাঁরা চাইলে তিনি তাঁদের দিলেন। এমনকি তাঁর কাছে যা ছিল সবই শেষ হয়ে গেল। এরপর তিনি বললেন, ‘আমার কাছে যে মাল থাকে তা তোমাদের না দিয়ে আমার কাছে জমা রাখি না। তবে যে চাওয়া থেকে বিরত থাকে, আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে রাখেন আর যে পরমুখাপেক্ষী না হয়, আল্লাহ তাকে অভাবমুক্ত রাখেন। যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করে, আল্লাহ তাকে সবর দান করেন। সবরের চেয়ে উত্তম ও ব্যাপক কোনো নিয়ামত কাউকে দেয়া হয়নি’ (বুখারি-৬৪৭০, মুসলিম-১০৫৩)।

সাহায্য প্রাপ্তির উপায় ধৈর্য ধারণ: ‘ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য লাভ করো। সালাতকে অবশ্যই কঠিন মনে হয়, কিন্তু তাদের পক্ষে (কঠিন) নয়, যারা খুশুর (অর্থাৎ ধ্যান ও বিনয়) সাথে পড়ে’ (সূরা বাকারা-৪৫)। রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘মুসলমান বান্দার ছোট-বড় যেকোনা পর্যায়ের কষ্ট বা বিপদাপদ আসুক না কেন, বিপদ দ্বারা আল্লাহ তার সব গুনাহ মাফ করে দেন, এমনকি যদি তার গায়ে কোনো কাঁটা বিঁধে সেই কাঁটা বিঁধার কারণেও’ (বুখারি ও মুসলিম)।

আজো আমরা বিপদ-আপদে পড়লে পড়ি, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’। কিন্তু এটি আমরা পড়ি অধৈর্য হয়ে পড়লে তখনই। মূলত আমরা এর দর্শন ভুলে গিয়ে এটিকে প্রথায় পরিণত করেছি। ‘যে ব্যক্তি বিপদে-মুসিবতে এই দোয়া পড়বে, আল্লাহ তায়ালা তার বিপদ দূর করবেন এবং তার যা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে উত্তম জিনিস তাকে দান করবেন’ (বুখারি ও মুসলিম)।

ধৈর্যের মূর্তপ্রতীক হজরত আইয়ুব আ: ১৮ বছর পর্যন্ত সহিষ্ণুতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে পরম সাফল্য লাভ করেছিলেন। নবী হজরত ইউনুস আ:কে সামান্য অধৈর্য হওয়ার কারণে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাতের আঁধারে উত্তাল সমুদ্রবক্ষে মাছের উদরে যেতে হয়েছিল। এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:কে উদ্দেশ করে কুরআন কারিমে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতএব, তুমি ধৈর্য ধারণ করো তোমার প্রতিপালকের নির্দেশের অপেক্ষায়, তুমি মৎস্য-সহচরের (ইউনূস আ:) ন্যায় অধৈর্য হয়ো না, সে বিষাদ আচ্ছন্ন অবস্থায় কাতর প্রার্থনা করেছিল’ (পারা-২৯, সূরা-৬৮ কলম, আয়াত-৪৮)।

আমরা সাধারণত বিপদ-আপদ ও বালা-মুসিবতে বিচলিত না হওয়াকেই ধৈর্য বলে মনে করি। মূলত ধৈর্য অনেক ব্যাপক অর্থ ধারণ করে। ধৈর্য তিন প্রকার : ‘সবর আনিল মাছিয়াত’ অর্থাৎ অন্যায় অপরাধ থেকে বিরত থাকা। ‘সবর আলাত তআত’ অর্থাৎ ইবাদত আল্লাহর আনুগত্য ও সৎকর্মে কষ্ট স্বীকার করা। ‘সবর আলাল মুছিবত’ অর্থাৎ বিপদে অধীর না হওয়া (তাফসিরে বায়জাবি)।

কোনো ব্যক্তি যদি উপরিউক্ত অর্থে ধৈর্য অবলম্বন করে, তবে তার জীবনে পূর্ণতা ও সফলতা অনস্বীকার্য। কারণ প্রথমত, অন্যায়-অপরাধ তথা পাপকার্য থেকে বিরত থাকা সব প্রকার অকল্যাণ ও গ্লানি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায়। দ্বিতীয়ত, ইবাদত ও সৎকর্ম সম্পাদন করা সফলতার একমাত্র সোপান। তৃতীয়ত, প্রতিকূলতায় দৃঢ়পদ থাকার লক্ষ্যে পৌঁছার একমাত্র মাধ্যম। সুতরাং ‘সবর কামিল’ বা পরিপূর্ণ ধৈর্যই মানবজীবনকে পূর্ণতা দিতে পারে। আমাদের উচিত সব অনভিপ্রেত অবস্থায়, যেকোনো অযাচিত পরিবেশে ও অনাহূূত পরিস্থিতিতে নিজেকে সংযত রেখে দৃঢ়তার সাথে লক্ষ্যপানে এগিয়ে যাওয়া। তবেই আল্লাহর সাহায্য আমাদের সাথী হবে, আল্লাহ আমাদের সঙ্গী হবেন।
-শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement