২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মহানবীর সিরিয়া সফর নিয়ে বিতর্ক

-

তিন.
এ সম্পর্কে ইমাম আবু যুহরার আলোচনা যুগান্তকরী হিসেবে বিবেচিত থাকবে চিরকাল : ‘এ বিষয়ে যত বর্ণনা আছে তার মূল ফোকাস নবী সা:-এর সাথে বাহীরার সাক্ষাৎ কিংবা সেই পাদ্রীর নামধামের মধ্যে নিহিত নয়, এবং এই ঘটনার মধ্যে অবাক হওয়ার মতো খুব একটা কারণও নেই। কারণ মুহাম্মদ সা:-এর নবুয়ত ও রিসালাতের পূর্বাভাস ও সুসংবাদেও বর্ণনা আহলে কিতাবীদের তাওরাত ও ইঞ্জিলে আগে থেকেই ছিল। বরং রাসূলের জন্মগ্রহণের পর থেকে প্রতিটি ঘটনা এর সাক্ষ্য বহন করছিল, যাদের অভ্যাসই হলো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও বস্তুগত প্রমাণ ছাড়া কোনো কিছু বিশ্বাস না করা তাদের কাছে সিরাতের প্রতিটি মুজিজার বর্ণনা অপ্রাসঙ্গিক। তবে এতদসত্ত্বেও তারা রাসূলুল্লাহর পিঠে অঙ্কিত ‘মোহরে নবুয়ত’ কখনোই অস্বীকার করতে পারে না। বাহীরার ঘটনায় অন্য সব কিছু বাদ দিলেও শিশু মুহাম্মদের কাঁধের মোহর নিশ্চিতভাবেই তিনি দেখেছিলেন। এর কী উত্তর দেবেন তারা? এর পাশাপাশি তাওরাত ও ইঞ্জিল বিকৃত করার পরেও সেখানে রয়ে যাওয়া শেষ নবীর চিহ্নগুলোও বিদ্যমান ছিল, যা সুস্পষ্টভাবে তাঁর সাথেই মিলছিল। সুতরাং সন্দেহ করে কি এসব ঢেকে রাখা যায়?’
এখন আমরা চলমান মডারেটদের আতঙ্কের বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করতে চাই যারা এই ঘটনার দরুন ইসলামী মৌলিকত্বেও উপর আপতিত প্রশ্নের উত্তর দিতে হিমশিম খায়। আল্লামা নাসিরুদ্দিন আলবানী রহ: বলেন : ‘এখন যারা এ ধরনের প্রশ্ন তুলছে যে মুহাম্মদ সা: বাহীরার কাছ থেকে ইসলামের শিক্ষা নিয়েছে, তাদের কথা তো সেই মক্কার মুশরিকদের কথারই প্রতিধ্বনি যাদের ব্যাপারে কোরআন সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেÑ ‘আমরা তো ভালোভাবেই জানি যে, তারা বলে : তাকে জনৈকব্যক্তি শিক্ষা দেয়। যার দিকে তারা ইঙ্গিত করে, তার ভাষা তো আরবি নয় এবং এ কুরআন পরিষ্কার আরবি ভাষায়। যারা আল্লাহর কথায় বিশ্বাস করে না, তাদের আল্লাহ পথপ্রদর্শন করেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। মিথ্যা কেবল তারা রচনা করে, যারা আল্লাহর নিদর্শনে বিশ্বাস করে না এবং তারাই মিথ্যাবাদী’। সূরা আন নাহল-১০৩-১০৪)
এখানে প্রকৃতই প্রাচ্যবিদদের অভিযোগের জবাব দেয়া যদি উদ্দেশ্য হয় তাহলে তা ঘটনাটিকে বাস্তব মেনে নিয়েও জবাব দেয়া সম্ভব। কিন্তু ড. হায়কালদের মতো প্রাচ্যবিদ প্রভাবিত ব্যক্তিরা সহিহ বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত রাসূলের বক্ষ বিদারণের মতো ঘটনাকেও অস্বীকার করেন যা প্রমাণ করে আসলে দলিলের বিশুদ্ধতা নিয়ে তাদের মূল আপত্তি না, বরং রাসূলের মুজিজা নিয়েই তাদের যত আপত্তি। আর হায়কাল ও রশিদ রেজার মতো যারা এই ঘটনা গ্রহণ না করার পক্ষে দালিলিক প্রমাণের সমস্যা নিয়ে আলাপ তুলে আমরা দেখি তারা নিজেরাই এর উৎস নিয়ে নতুন কোনো দিগন্ত উন্মোচন না করে প্রাচীনদের দেয়া রেফারেন্স দিয়েই দায়সারা গোছের আলাপ করে। এ থেকে প্রমাণ হয় তাদের আগ্রহ দলিলের খননে নয়, বরং সন্দেহের বীজ বপনে। এ পর্যায়ে আমরা গোটা অভিযোগের খ-ন করবো আল্লামা যুরক্বানীর বক্তব্য থেকে।
১. সম্পূর্ণ অপবাদটিই দলিলহীন এবং ভিত্তিহীন। এ ধরণের অভিযোগ নির্ভুল প্রমাণ ছাড়া কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। অভিযোগ উত্থাপনকারীদেরকে প্রমাণ দিতে হবে মুহাম্মদ সা:- বাহীরা থেকে ঠিক কি কি শুনেছিলেন, কবে, কোথায় ও কিভাবে?
২. সিরিয়া সফরের ক্ষেত্রে ইতিহাস রাসূলুল্লাহর কৈশোর ও যৌবনে মোট দুবার সফরের বর্ণনার বাহিরে আর কিছুই নথি রাখেনি। দু’বারই ঘটনার সাক্ষী হিসেবে তাঁর সাথে অনেকেই ছিলেন। বিশেষত প্রথম সফরে চাচা আবু তালেব ও দ্বিতীয় সফরে মায়সারা পুরো ঘটনার সাথেই ছিলেন। তারা উভয়েই পাদ্রীরা মুহাম্মদ সম্পর্কে কী বলেছেন তা উল্লেখ করেছেন। যদি সত্যিই পাদ্রীদের থেকে রাসূলুল্লাহ কিছু জ্ঞান অর্জন করেই থাকতেন তা হলে সেই সাক্ষীরা তা নির্দ্বিধায় বলতেন কারণ তখনো মুহাম্মদ সা:- এর নবুয়ত অর্জিত হয়নি যে তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।
৩. ঘটনাসংশ্লিষ্ট সব বর্ণনা প্রমাণ করে বাহীরার পক্ষে মুহাম্মদের শিক্ষকের ভূমিকা গ্রহণ করা তাঁর নিজের নীতিরই বিরুদ্ধে যায়। কারণ যে ব্যক্তি শিশু মুহাম্মদের ভবিষ্যৎ নবুয়তের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকে তাঁর পক্ষে সেই প্রতীক্ষিত নবীর শিক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হওয়া নিজের সাথে প্রতারণার শামিল। কারণ এই নবীই বরং অচিরেই সব উস্তাদদের উস্তাদে পরিণত হতে যাচ্ছেন, আল্লাহর রাসূল মনোনীত হতে যাচ্ছেন যা অন্যদের চেয়ে বাহীরা খুব ভালোভাবেই অবহিত ছিলেন।
৪. ইসলামের আসন্ন প্রবাহধারা যদি বাহীরা থেকেই প্রবাহিত হবে তাহলে তিনিই বরং নবী হওয়ার জন্য অধিকতর উপযুক্ত হতেন এবং এর জন্য মনোনীত হতেন।
৫. এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক যে, একজন বালক মাত্র দুই দুইবার পুরোহিতের সান্নিধ্যে ক্ষণিকের জন্য এসে রাতারাতি মানবজাতির শিক্ষকে পরিণত হবেন। আবার যে দু’বার তাদের সাক্ষাৎ হয়েছে এর প্রথমবারে বালক না ছিলেন শিক্ষা অর্জনের জন্য প্রস্তুত, দ্বিতীয়বার ছিলেন ব্যবসায়িক আমানতের গুরু দায়িত্ব পালনে চিন্তাক্লিষ্ট।
৬. তাওরাত ও ইঞ্জিলের বিকৃতি ঘটে যাওয়ার পর সেই ধর্মের অনুসারী হিসাবে বাহীরার পক্ষে কুরআনের আনীত বর্ণনা সরবরাহ করাটা হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়। কারণ কুরআন নিজেই তৎকালীন তাওরাত ইঞ্জিলের শিক্ষাকে জাহালাত হিসেবে আখ্যায়িত করে তা সংশোধনের নির্দেশনা বাতলে দিয়েছে। এর আকিদা বিশ্বাসকে গোমরাহী অভিহিত করে তা পরিশুদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। নিশ্চয় অন্ধকারাচ্ছন্ন ব্যক্তি আলোর দিশা দিতে পারেন না।
৭. যদি অভিযোগকারীদের কথা সত্যই হতো তাহলে এই সুযোগটা সর্বাগ্রে গ্রহণ করত তৎকালীন সময়ের ইসলামবিরোধীরা। তারা নানা অভিযোগ এনেছিল, মুহাম্মদ জিন থেকে বার্তাপ্রাপ্ত হয়, মুহাম্মদকে কেউ একজন শিখায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তারা যদি নিশ্চিত হতোই যে বাহীরা থেকে মুহাম্মদ জ্ঞানলাভ করেছে তাহলে আমরা হাতের নাগালে এ ধরনের বক্তব্যই পেতাম যেখানে মক্কার মুশরিকরা সরাসরিই বাহীরার নাম উল্লেখ করে অভিযোগ করে অপপ্রচার চালাত। কিন্তু এ ধরনের তিলমাত্র বক্তব্য ইতিহাস আমাদের জন্য নথিভুক্ত করেনি।
পরিশেষে আমরা কুরআনের ভাষায় উপসংহার টানতে পারি : ‘কাফেররা বলে, এটা মিথ্যা বৈ নয়, যা তিনি উদ্ভাবন করেছেন এবং অন্য লোকেরা তাঁকে সাহায্য করেছে। অবশ্যই তারা অবিচার ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। তারা বলে, এগুলো তো পুরাকালের রূপকথা, যা তিনি লিখে রেখেছেন। এগুলো সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর কাছে শেখানো হয়। বলুন, একে তিনিই অবতীর্ণ করেছেন, যিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের গোপন রহস্য অবগত আছেন। তিনি ক্ষমাশীল, মেহেরবান।’ (সূরা ফুরকান : ৪-৬)
পিএইচডি গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিন্সিপ্যাল, মাদরাসাতুল হাদ্বারা আল-ইসলামিয়া, চট্টগ্রাম


আরো সংবাদ



premium cement