২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ধর্ম যার উৎসবও তার

-

‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন’ অর্থ- ‘তোমাদের দ্বীন তোমাদের, আর আমার দ্বীন আমার’ (১০৯. সূরা কাফিরুন-৬)। আয়াতটি সুপরিচিত। মুসলিম সবারই জানা। এমনকি অমুসলিম ভাই-বোনেরাও কমবেশি জানেন। কেননা, তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গিয়ে অনেক মুসলিম আয়াতটি কিংবা এর সরল অনুবাদের আলোকে কিছু বক্তব্য শুনিয়ে আসেন। উদার মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই আয়াতটির অহরহ অপব্যাখ্যা হচ্ছে। বিষয়টি হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে। আয়াতটির মৌলিক ধ্যান-ধারণা পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যেই আজকের লেখা। কুরআনুল কারিম এমন আজিম এক কিতাব, যার তাফসির, ব্যাখ্যা কিংবা এর ব্যাপারে মন্তব্য করার মতো কোনো ইলম বা জ্ঞান আমার নেই। তবে মুফাসসিররা যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা সংক্ষিপ্তভাবে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি।
এ আয়াতের তাফসিরে আল্লামা ইবনে কাসির রহ: বলেন, এ বাক্যটি তেমনি যেমন অন্য আয়াতে আছে, ‘আর তারা যদি আপনার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তবে আপনি বলবেন, আমার কাজের দায়িত্ব আমার এবং তোমাদের কাজের দায়িত্ব তোমাদের’ (১২. সূরা ইউনুস-৪১)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘আমাদের কাজের ফল আমাদের জন্য এবং তোমাদের কাজের ফল তোমাদের জন্য’ (২৮. সূরা আল-কাসাস-৫৫, ৪২. সূরা আশ-শূরা-১৫)। এর সারমর্ম এই যে, ইবনে-কাসির দ্বীন শব্দকে দ্বীনি ক্রিয়াকর্মের অর্থে নিয়েছেন। যার অর্থ, প্রত্যেককে নিজ নিজ কর্মের প্রতিদান ও শাস্তি ভোগ করতে হবে। অর্থাৎ আমার দ্বীন আলাদা এবং তোমাদের দ্বীন আলাদা। আমি তোমাদের মাবুদের পূজা-উপাসনা কিংবা বন্দেগি করি না এবং তোমরাও আমার মাবুদের পূজা-উপাসনা কিংবা বন্দেগি করো না। আমি তোমাদের মাবুদদের বন্দেগি করতে পারি না এবং তোমরা আমার মাবুদের বন্দেগি করতে প্রস্তুত নও। তাই আমার ও তোমাদের পথ কখনো এক হতে পারে না।
কেউ কেউ মনে করেন, এখানে কাফেরদেরকে তাদের দ্বীনের ওপর থাকার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তারা এটাকে ইসলামের উদারনীতির প্রমাণ হিসেবে পেশ করে থাকেন। নিঃসন্দেহে ইসলাম উদার। ইসলাম কাউকে অযথা হত্যা বা ক্ষতিগ্রস্ত করতে অনুমতি দেয় না। কিন্তু তাই বলে তাদেরকে কুফরি থেকে মুক্তি দিতে তাদের মধ্যে দাওয়াত ও দ্বীনের প্রচার প্রসার ঘটানো থেকে বিরত থাকতে বলেনি। ইসলাম চায় প্রত্যেক কাফের ও মুশরিক ইসলামের ছায়াতলে এসে শান্তির বার্তা গ্রহণ করুক। আর এ জন্য ইসলাম প্রজ্ঞা, উত্তম উপদেশবাণী, উত্তম পদ্ধতিতে তর্কবিতর্ক ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহর পথে আহ্বান করাকে প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য করণীয় বিষয় হিসেবে ঘোষণা করেছে।
এ সূরার পরে নাজিল হওয়া কয়েকটি মক্কি সূরাতে কাফেরদের সাথে এ দায়মুক্তি, সম্পর্কহীনতা ও অসন্তোষ প্রকাশের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘হে নবী! বলে দিন হে লোকেরা, যদি তোমরা আমার দ্বীনের ব্যাপারে (এখানে) কোনোরকম সন্দেহের মধ্যে থাকো তাহলে (শুনে রাখো), আল্লাহ ছাড়া তোমরা যাদের বন্দেগি করছ আমি তাদের বন্দেগি করি না। বরং আমি শুধু সেই আল্লাহর বন্দেগি করি যার কর্তৃত্বাধীনে রয়েছে তোমাদের মৃত্যু’ (১২. সূরা ইউনুস-১০৪)। অন্য সূরায় আল্লাহ আরো বলেন, ‘হে নবী! যদি এরা এখন আপনার কথা না মানে তাহলে বলে দিন, তোমরা যা কিছু করছো তা থেকে আমি দায়মুক্ত’ (৪২. সূরা আশ-শূরা-২১৬)।
অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘এদেরকে বলুন, আমাদের ত্রুটির জন্য তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না এবং তোমরা যা কিছু করে যাচ্ছ সে জন্য আমাদের জবাবদিহি করতে হবে না। বলুন, আমাদের রব একই সময় আমাদের ও তোমাদের একত্র করবেন এবং আমাদের মধ্যে ঠিকমতো ফায়সালা করবেন’ (৩৪. সূরা সাবা-২৫-২৬)। অন্য সূরায় এসেছে, ‘এদেরকে বলুন, হে আমার জাতির লোকেরা তোমরা নিজেদের জায়গায় কাজ করে যাও। আমি আমার কাজ করে যেতে থাকব। শিগগিরই তোমরা জানতে পারবে কার উপর আসছে লাঞ্ছনাকর আজাব এবং আর আপতিত হবে তার ওপর স্থায়ী শাস্তি’ (৩৯. সূরা আজ-জুমার-৩৯-৪০)। আবার মদিনা তাইয়িবার সমস্ত মুসলিমকেও এই একই শিক্ষা দেয়া হয়। তাদেরকে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের জন্য ইবরাহিম ও তার সাথীদের মধ্যে রয়েছে একটি উত্তম আদর্শ। (সেটি হচ্ছে) তারা নিজেদের জাতিকে পরিষ্কার বলে দিয়েছে, আমরা তোমাদের থেকে ও তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব মাবুদদের পূজা করো তাদের থেকে পুরোপুরি সম্পর্কহীন। আমরা তোমাদের কুফরি করি ও অস্বীকৃতি জানাই এবং যতক্ষণ তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান না আনো ততক্ষণ আমাদের ও তোমাদের মধ্যে চিরকালীন শত্রুতা সৃষ্টি হয়ে গেছে’ (৬০. সূরা আল-মুমতাহিনাহ-৪)।
কুরআনুল কারিমে একের পর এক এসব সুস্পষ্ট বক্তব্যের পর তোমরা তোমাদের ধর্ম মেনে চলো এবং আমাকে আমার ধর্ম মেনে চলতে দাও- ‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন’ এর এ ধরনের কোনো অর্থের অবকাশই থাকে না। বরং সূরা আজ-জুমারে যে কথা বলা হয়েছে, একে ঠিক সেই পর্যায়ে রাখা যায় যেখানে বলা হয়েছে- ‘হে নবী! এদেরকে বলে দিন, আমি তো আমার দ্বীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে তাঁরই ইবাদত করবো। তোমরা তাঁকে বাদ দিয়ে যার ইচ্ছে তার বন্দেগি করতে চাও করতে থাকো’ (৩৯ সূরা আজ-জুমার : ১৪)।
সুতরাং এটাই এ আয়াতের মূল ভাষ্য যে, এখানে কাফেরদের সাথে সম্পর্কচ্যুতি ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এটাও লক্ষণীয় যে, পবিত্র কুরআনে এ কথাও আছে, ‘কাফেররা সন্ধি করতে চাইলে তোমরাও সন্ধি করো’ (৮. সূরা আল আনফাল-৬১)। তা ছাড়া মদিনায় হিজরত করার পর রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর ও ইহুদিদের সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। তাই সম্পর্কচ্যুতির অর্থ এই নয় যে, তাদের সাথে প্রয়োজনে সন্ধিচুক্তি করা যাবে না। মূলত সন্ধির বৈধতা ও অবৈধতার আসল কারণ হচ্ছে স্থান-কাল-পাত্র এবং সন্ধির শর্তাবলি। এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা:-এর ফায়সালা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘সে সন্ধি অবৈধ, যা কোনো হারামকে হালাল কিংবা হালালকে হারাম করে’ (আবু দাউদ-৩৫৯৪, তিরমিজি-১৩৫২, ইবনে মাজাহ-২৫৫৩)।
সূরা আল-কাফিরুন নাজিলের ঐতিহাসিক পটভূমি জানার চেষ্টা করলে, বিষয়টি বোঝা আরো সহজ হবে। তাফহিমুল কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- মক্কায় এমন এক যুগ ছিল যখন নবী সা:-এর ইসলামী দাওয়াতের বিরুদ্ধে কোরাইশদের মুশরিক সমাজে প্রচণ্ড বিরোধিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সা:কে কোনো না কোনো প্রকারে আপস করতে উদ্বুদ্ধ করা যাবে বলে কোরাইশ সর্দাররা মনে করত। এ ব্যাপারে তারা কখনো নিরাশ হয়নি। এ জন্য তারা মাঝে মধ্যে তাঁর কাছে আপসের ফর্মুলা নিয়ে হাজির হতো। তিনি তার মধ্য থেকে কোনো একটি প্রস্তাব মেনে নিলেই তাঁর ও তাদের মধ্যকার ঝগড়া মিটে যাবে বলে তারা মনে করত। হাদিসে এ সম্পর্কে বিভিন্ন ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
হজরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রা: বর্ণনা করেছেন, কোরাইশরা রাসূলুল্লাহ সা:কে বলল, আমরা আপনাকে এত বেশি পরিমাণ ধনসম্পদ দেবো, যার ফলে আপনি মক্কার সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি হয়ে যাবেন। যে মেয়েটি আপনি পছন্দ করবেন, তার সাথে আপনার বিয়ে দিয়ে দেবো। আমরা আপনার পেছনে চলতে প্রস্তুত। আপনি শুধু আমাদের একটি কথা মেনে নেবেন- আমাদের উপাস্যদের নিন্দা করা থেকে বিরত থাকবেন। এ প্রস্তাবটি আপনার পছন্দ না হলে, আমরা আরেকটি প্রস্তাব পেশ করছি। এ প্রস্তাবে আপনার লাভ এবং আমাদেরও লাভ। রাসূলুল্লাহ সা: জিজ্ঞেস করলেন, সেটি কী? এক বছর আপনি আমাদের উপাস্যদের ইবাদত করবেন এবং আমরাও এক বছর আপনার উপাস্যদের ইবাদত করব।... এরই প্রেক্ষাপটে সূরাটি নাজিল হয়। কাফিরদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়।
ধর্ম যার যার উৎসব সবার- এরকম কথা প্রকৃত মুমিন ও মুসলিমদের মুখে মানায় না। এরকম কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা ও রাখা, আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। অমুসলিমরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হোক; এটা কখনোই কাম্য হতে পারে না। তারা স্বাধীনতা নিয়ে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা করুক, তাতে আপত্তি থাকতে পারে না। বিপত্তি হলো- যখন শুনি কিংবা দেখি, মুসলিম নামের লোকজন নিজস্ব ঈমান আকিদা বিসর্জন দিয়ে অজান্তেই অনৈসলামিক কাজে জড়িত হয়ে পড়েন। যা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। মুসলিম ভাই-বোনদের প্রতি অনুরোধ- আসুন, ইসলামের মৌলিক জ্ঞানার্জনে যত্নবান হই। অনুশীলনে সক্রিয় থাকি। কুরআন ও হাদিস-সুন্নাহর পথে অবিচল থাকার চেষ্টা করি।
সহকারী মহাসচিব, বাংলাদেশ মাজলিসুল মুফাসসিরিন


আরো সংবাদ



premium cement
অর্থনীতিতে চুরি : ব্যাংকে ডাকাতি পাকিস্তানে আফগান তালেবান আলেম নিহত যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য না করলে এ বছরই রাশিয়ার কাছে হারতে পারে ইউক্রেন : সিআইএ প্রধান রাশিয়ার সামরিক শিল্পক্ষেত্রে প্রধান যোগানদার চীন : ব্লিংকন ইরাকে সামরিক ঘাঁটিতে 'বিকট বিস্ফোরণ' শেখ হাসিনা সব প্রতিবন্ধকতা উপড়ে ফেলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন: পররাষ্ট্রমন্ত্রী গাজায় ইসরাইলি গণহত্যা বন্ধে বিশ্ববাসীকে সোচ্চার সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির মৃত্যু নীলফামারীতে তিন হাজার ১৭০ চাষির মাঝে বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ বিতরণ কারাগারে কয়েদির মৃত্যু উজ্জ্বল হত্যার বিচার দাবিতে সরিষাবাড়ীতে মানববন্ধন

সকল