১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্রসঙ্গ : ধর্ম যার যার, উৎসব সবার

-

‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ এটা বিশ্বাস করলে বা পালন করলে ঈমান নষ্ট হবে। এটা বোঝার জন্য আমরা আমাদের জাগতিক ধর্ম নিয়ে চিন্তা করতে পারি। আমাদের একটা ধর্ম হলো দুনিয়ার আর আরেকটা ধর্ম হলো আখিরাতের। দুনিয়ার ধর্ম মানে মনে করুন আওয়ামী লীগ-বিএনপি এসব রাজনৈতিক দল। আর আখিরাতের ধর্ম হলো ইসলাম, হিন্দু, খ্রিষ্ট বা বৌদ্ধ ধর্ম।

ধরুন, ‘রাজনীতি যার যার, উৎসব সবার।’ এখন খালেদা জিয়ার জন্ম দিনে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সবাই মিলে আনন্দ করবে। এভাবে খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালন করলে যারা আওয়ামী লীগ করে তাদের ‘রাজনৈতিক ঈমান’ নষ্ট হবে কি-না? অবশ্যই নষ্ট হবে। আরো সহজ করে বললে আ’লীগের কোনো নেতা যদি খালেদা জিয়ার জন্মদিনের উৎসবে অংশ নেয় তাহলে আমাদের দেশে প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুসারে ওই আওয়ামী লীগ নেতার রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হবে। একইভাবে শেখ হাসিনার জন্ম দিনে বিএনপির নেতারা অংশ নিয়ে আনন্দ করবে সেটা কিন্তু এ দেশে কল্পনাও করা যায় না।
এখন আসুন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যদি কোনো বিরোধী দল রাজনৈতিক অনুষ্ঠান করে; তাহলে সরকার পক্ষ সুযোগ ও নিরাপত্তা দিতে বাধ্য। কিন্তু বিরোধী দলের অনুষ্ঠানে বা তাদের আনন্দে অংশগ্রহণ করতে হবে এটার কোনো বাধ্যবাধকতা আছে কি? অবশ্যই নেই।

যদি কেউ রাজনৈতিক উদারতার কারণে নিজের ‘রাজনৈতিক ধর্মের’ বিরোধী কোনো ‘রাজনৈতিক ধর্মের’ উৎসবে যান আর সেই কারণে যদি তার ‘রাজনৈতিক ঈমানের’ ক্ষতি হয়; তাহলে প্রশ্ন হলো- বাস্তব জীবনে নিজের ‘আখিরাতের ধর্ম’ বিরোধী কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গেলে ঈমানের কোনো ক্ষতি হবে কি-না? অবশ্যই হবে।
আমাদের জানা দরকার, ‘রাজনৈতিক ধর্ম’ মানুষের বানানো আর ‘আখিরাতের ধর্ম’ আল্লাহ দিয়েছেন। সুতরাং দুনিয়ার রাজনৈতিক ধর্মের চেয়ে আখিরাতের ধর্মের গুরুত্ব বেশি।

‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ এই কথাটা ওই সময় বলা যাবে; উৎসবটি যদি ধর্মীয় উৎসব না হয়। কিন্তু ধর্মকে কেন্দ্র করেই যেই উৎসব সেই উৎসবে অন্য ধর্মের মানুষ অংশ নিতে পারে না। এটা শুধু নিজ ধর্মের জন্যই হবে। অর্থাৎ ধর্ম যার ধর্মীয় উৎসবও তার।

‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ এটা মানবতাবিরোধী কথাও বটে। কোরবানির ঈদে কোরবানির গরু জবাই করার সময় পাশের বাড়ির হিন্দু ভাইকে যদি আমি বলি, ভাই আসেন আমরা গরু জবাই করছি আপনি আমাদের সাথে শরিক হন। কারণ আমরা বিশ্বাস করি ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’। তাহলে বিষয়টি কেমন হবে? হিন্দুধর্মের দৃষ্টিতে তো গরু জবাই করা অপরাধ। কিন্তু আমার ধর্মের দৃষ্টিতে এটা ভালো কাজ। তাই আমরা বলতে পারি যে, গরু জবাই করার উৎসবে হিন্দু ভাইদের আমন্ত্রণ জানালে তা মানবতাবিরোধী কাজই হবে।

একইভাবে ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিমাপূজা করাটা সবচেয়ে বড় অপরাধ। একমাত্র তওবা করে তাওহিদের পথে ফিরে আসা ছাড়া যার কোনো ক্ষমা নেই। সুতরাং একজন ঈমানদার কখনোই প্রতিমাপূজার অনুষ্ঠানে যেতে পারে না। কারণ সেখানে আমার আল্লাহকে অপমান করা হচ্ছে।

ধর্মনিরপেক্ষতার নামে বা ধর্মীয় উদারতার নামে কোরবানির উৎসবে হিন্দুদের দাওয়াত দেয়াটা যেমন অপরাধ; ঠিক পূজার উৎসবে বা বড় দিনের উৎসবে মুসলমানকে দাওয়াত দেয়াও তেমন অপরাধ। শুধু আপনার মধ্যে যদি ঈমান না থাকে তবেই আপনি এটাকে অপরাধ মনে করবেন না।

এবার আসুন একটা উদাহরণে যাই আমরা। ধরুন, আওয়ামী লীগের আয়োজনে একটি অনুষ্ঠানে গানবাজনা হচ্ছে সাথে খালেদা জিয়াকে গালিগালাজ করা হচ্ছে। এখন আপনি বিএনপির কর্মী হয়ে ওই অনুষ্ঠানে যেতে পারবেন? আবার মনে করুন, আপনি আওয়ামী লীগ করেন। এখন বিএনপির আয়োজনে একটি অনুষ্ঠানে ঢোল পিটিয়ে শেখ হাসিনাকে গালাগালি করা হচ্ছে, শেখ হাসিনার নামে বিভিন্ন প্যারোডি গান বানিয়ে গাওয়া হচ্ছে। আপনি যদি আওয়ামী লীগের কর্মী হয়ে থাকেন তাহলে কি ওই অনুষ্ঠানে যেতে পারবেন? উভয় ক্ষেত্রেই আপনি বাধাপ্রাপ্ত হবেন। কারণ আপনার ‘রাজনৈতিক ঈমান’ আপনাকে বাধা দেবে।

এখন, আপনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অনুষ্ঠানে যেতে বাধাপ্রাপ্ত হন; কারণ সেখানে আপনার রাজনৈতিক গুরুকে গালমন্দ করা হচ্ছে। কিন্তু হিন্দুদের পূজার অনুষ্ঠানে আপনার রবকে অপমান করা হচ্ছে; সেখানে যেতে বাধাপ্রাপ্ত হন না। তার মানে আপনার ঈমান নেই। আপনি মুসলমান কিভাবে হন?

আপনি যদি হিন্দু হয়ে মুসলমানের গরু জবাই করার উৎসবে হাততালি দিয়ে অংশ নেন; তাহলে আপনি নিজেকে হিন্দু মনে করলেও অন্য হিন্দুরা আপনাকে হিন্দু মনে করবে না। একইভাবে মুসলমান হয়ে হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসবে অংশ নিলে আপনি নিজেকে যাই মনে করেন সত্যিকারের মুসলমানরা আপনাকে মুসলিম মনে করবে না।
কাজেই দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ এটা যারা বলেন তারা বেশির ভাগ মূলত না বুঝেই কথাটি বলে থাকেন।

কোনো একটি অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টির এরশাদের নামে প্যারোডি বানিয়ে গাওয়া হচ্ছে। কিন্তু আপনি জাতীয় পার্টির কর্মী হয়ে সেই অনুষ্ঠানে নাচানাচি করছেন। তাহলে বোঝা গেল, আপনার জাতীয় পার্টির প্রতি ‘ঈমান’ নেই। ঠিক তেমনি কোথাও প্রতিমা পূজা হচ্ছে, কোথাও যিশুখ্রিষ্টের দেবত্বের কথা বলা হচ্ছে, কোথাও শিরকের গান গাওয়া হচ্ছে। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে আপনি উপভোগ করলেন কোনো কষ্ট পেলেন না। তাহলে আপনি প্রমাণ করলেন আপনার ভেতর ঈমান নেই। শিরক দেখে বেদনা অনুভব না করে, আপনার নবী মুহাম্মদ সা:-এর শিক্ষার জঘন্যতম অবমাননা দেখে হৃদয়ে অস্থিরতা বোধ না করে, আনন্দ বোধ করে আপনি প্রমাণ করলেন আপনি অনেক আগেই কাফের হয়ে গেছেন। কাজেই ‘ধর্ম যার যার, উৎসব তার তার’।

অবশ্যই সব ধর্মের ধর্মীয় অধিকার দেয়া এবং নিরাপত্তা প্রদান করা ইসলামে ফরজ দায়িত্ব। যারা প্রকৃত মুসলমান; তারা অন্য ধর্মের ধর্মীয় স্বাধীনতার ব্যাপারে সচেতন। যখন ইয়াজিদের সরকার সিরিয়ায় এলো; তখন দামেস্কের মসজিদে উমামীর পাশে খ্রিষ্টানদের একটি গির্জা ছিল। মসজিদ বড় করা হবে তাই খ্রিষ্টানদের বলা হলো- তোমাদের গির্জা বিক্রি করে দাও, আমরা মসজিদ বড় করব। কিন্তু খ্রিষ্টনরা বিক্রি করতে রাজি হয়নি। পরে জোর করে গির্জা দখল করে মসজিদ বড় করল ইয়াজিদের লোকজন। এভাবে প্রায় ৫০ বছর চলে গেল। মানুষ প্রায় ভুলেই গেছে যে এখানে একটা গির্জা ছিল। কিন্তু খ্রিষ্টানদের ঠিকই মনে আছে কারণ তাদের মনে ব্যথা আছে। এরপর হজরত ওমর ইবনু আব্দুল আজিজ খলিফা হলেন।

তিনি খলিফা হওয়ার বছর খানেকের মধ্যে সব জুলুম অত্যাচার রোধ করে দিলেন। তখন খ্রিষ্টনরা দেখলেন এই খলিফা তো ভালোই। খ্রিষ্টানরা গিয়ে ওমর ইবনু আব্দুল আজিজকে বলল, হুজুর আমাদের একটা আবদার আছে? খলিফা জানতে চাইলেন কী আবদার। তখন খ্রিষ্টনরা বলল, বড় মসজিদের এক পাশের অংশ কিন্তু আমাদের গির্জা ছিল। ইয়াজিদের সময় গির্জা দখল করে মসজিদ বড় করা হয়। তখন খলিফা খ্রিষ্টানদের গির্জার দলিল-প্রমাণ দেখে দামেস্কের গভর্নর ও বিচারপতিকে মসজিদের দলিল-প্রমাণসহ ডেকে পাঠালেন। কিন্তু বিচারক ও গভর্নর পুরো মসজিদের দলিল দেখাতে পারলেন না। তখন মসজিদের যে অংশে গির্জা ছিল সেই অংশ ভেঙে খ্রিষ্টানদের এক সপ্তাহের মধ্যে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন।

খলিফার আদেশ! কিন্তু মুসলমানরা তো পাগল হয়ে গেছে। এতদিন আমরা সালাত আদায় করেছি এইখানে। তখন মুসলমানরা দামেস্কের প্রধান বিচারপতির কাছে আরজ করলেন, হুজুর আপনি একটা ব্যবস্থা করেন। খ্রিষ্টান ভাইদের একটু অনুরোধ করেন তারা যেন গির্জার জায়গা আমাদের কাছে বিক্রি করে দেয়। তখন প্রধান বিচারক খ্রিষ্টানদের বললেন মুসলমানদের অনুরোধে তারা গির্জার জায়গা বিক্রি করতে রাজি হয়। আর খ্রিষ্টানদের জন্য নতুন জায়গায় গির্জা করে দেয়ার কথা হয়। এরপর মুসলিমরা খলিফার কাছে গিয়ে বলল- হুজুর, খ্রিষ্টানরা গির্জার জায়গা বিক্রি করতে রাজি হয়েছে। খলিফা তখন খ্রিষ্টানদের ডেকে সত্যতা যাচাই করে নিলেন। খ্রিষ্টানরা বললো, হুজুর আমরা খুশি মনে গির্জার জায়গা মুসলামনদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। তখন খলিফা ঘোষণা দিলেন, এখন মসজিদ রাখতে পারো।

সুতরাং মুসলমানদের দায়িত্ব অন্যদের ধর্মীয় স্বাধীনতা, ধর্ম পালন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আরো একটা দায়িত্ব আছে। সেটা হলো তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না দেয়া। ধর্মের মাধ্যমে মানুষ কিছু বিষয়কে পূজনীয়ভাবে, ভক্তি করে। যেমন- মন্দির, গির্জা, ধর্মগ্রন্থ। এগুলোর অবমাননা করতে পারবেন না। আল্লাহ কুরআনে নিষেধ করেছেন। এটা তাদের হৃদয়ে লাগে। নবীর বিরুদ্ধে কথা বললে যেমন আপনার হৃদয়ে লাগে তেমনি তাদের ধর্মকে অপমান করলে তাদেরও লাগে। কাজেই তাদের মর্যাদাহানিকর কিছু বলতে পারবেন না। তবে তার অর্থ এই নয় যে, দুই বেলা নামাজ আদায় করবেন, আরেক বেলা পূজা করবেন। অথবা একজন হিন্দু দুই বেলা পূজা করবে আরেক বেলা মসজিদে এসে জিকিরের মাহফিলে অংশ নেবে, এমনটি নয়।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া-এর অধ্যাপক মরহুম খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীরের (রহ:) বক্তব্য থেকে অনুলিখন সাইফুল্লাহ হিমেল


আরো সংবাদ



premium cement