২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আল্লাহর এক বিশেষ দান কোমল হৃদয়

-

কোমল হৃদয় আল্লাহর এক বিশেষ দান। কোমল হৃদয়, কোমল মনের অধিকারী ব্যক্তি সামাজিকভাবে অত্যধিক সম্মানের পাত্র হিসেবে পরিগণিত হন। এটি এমন একটি দুর্লভ গুণ, যেটির প্রভাবে ব্যক্তির চরিত্রে আরো কতগুলো সুন্দর ও বিরল গুণ ও বৈশিষ্ট্যের সমাহার ঘটে। যেমনÑ যিনি কোমল হৃদয়ের অধিকারী, তিনি সাধারণত নম্র-ভদ্র, মিষ্টভাষী, সুন্দর ব্যবহার, মানবিক আচরণ, পরশ্রীপরায়ণ, কল্যাণকামী, সহানুভূতিশীল, দয়ার্দ্র, নির্লোভী, নিরহঙ্কারী ও নিঃস্বার্থবাদী স্বভাবের হয়ে থাকেন। মনে রাখা প্রয়োজন, আল্লাহর গুণবাচক নামগুলোর বেশির ভাগই কোমলতা, রহমত ও দয়া-মায়ার স্বাক্ষর বহন করে। এই গুণটি জীবনের সর্বক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজন।
আল্লাহর প্রিয়জনরাও এ গুণে গুণান্বিত ছিলেন। যেই গুণী মহামানবরা যুগে যুগে কালে কালে তাদের গুণ দ্বারা পৃথিবীকে সিক্ত করে গেছেন। তাদের এ গুণের বদৌলতে কত পথহারা পথিক সঠিক পথের দিশা পেয়েছে। হজরত আদম আ: থেকে শেষ নবী মানবতার মহান বন্ধু মুহাম্মদ সা: ছিলেন এ গুণের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা শেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা:-এর কোমল হৃদয়ের প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আপনি যে, কোমল হৃদয় হতে পেরেছেন, সে আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহেরই ফল। কিন্তু আপনি যদি কঠিন হৃদয় ও কর্কশভাষী হতেন তাহলে তারা সবাই আপনাকে ছেড়ে চলে যেত।’ (সূরা ইমরান-১৬) তিনি যেমনি ছিলেন আদর্শের প্রতীক, তেমনি ছিলেন দয়ার স্বাক্ষর। স্নেহ-ভালোবাসা, বিনম্র স্বভাব প্রসবিনীর ঝর্ণাধারার মতো তার জীবন থেকে নিঃসৃৃত হয়ে পুরো মানব জাতিকে সিঞ্চিত করেছে। তাঁর জীবন চরিতের বিশাল ভুবনে প্রবেশ করলে দেখতে পাবেন বিশাল জীবনের প্রায় পুরো অংশই দয়া আর অনুকম্পা দখল করে আছে। বাস্তব চক্ষে যতটুকু অবশিষ্ট দেখবেন, সেটুকুর জন্য আপনি গভীর মনোযোগ নিবদ্ধ করলে বুঝতে পারবেন যে, একটি জাতিকে বিশাল ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সামান্য কতকের ওপর যতটুকু কঠোরতা অবলম্বন করা দরকার মনে করেছেন ততটুকু তিনি করেছেন। এটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতি দয়া প্রদর্শন জন্যই করেছেন। মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে মক্কার সন্নিকটে মুসলিম বাহিনী পৌঁছলে আবু সুফিয়ান মুসলমানদের শক্তি আন্দাজ করতে এসে ধরা পড়ে যান। এই সেই আবু সুফিয়ান ইসলামের বিরোধিতায় যিনি ছিলেন অনন্য সাধারণ। একাধিকবার তিনি মদিনা আক্রমণসহ রাসূল সা:-কে হত্যার জঘন্য ষড়যন্ত্র ফেঁদেছিলেন। সে মুহূর্তে প্রথম উচিত কাজ ছিল তাকে হত্যা করা। কিন্তু না, যখন তাকে মানবতার মহান বন্ধুর সামনে আনা হলো, তিনি তার দিকে করুণার দৃষ্টি প্রসারিত করে বললেন, ‘যাও, আজ আর তোমাকে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না। আল্লøাহ তোমাকে ক্ষমা করে দিন। তিনি সমস্ত ক্ষমা প্রদর্শনকারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ ক্ষমা প্রদর্শনকারী।’ আবু সুফিয়ান পরে ইসলামের ছায়াতলে আসেন।
আপনি যদি এভাবে চিন্তা করেন, যে মক্কার কঠিন পাথুরে হৃদয়গুলো মানবতার চরম বিপর্যয়ের মুখোমখি দাঁড়িয়েছিল, যারা হানাহানিতে সামাজিক ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল, পৃথিবী থেকে দয়া-মায়া বিদায় নিয়েছিল, পিতা তার সন্তানকে জীবন্ত কবর দিতÑ এ অবস্থা যুগ যুগ ও কাল কাল ধরে চলে আসছিলÑ এহেন পরিস্থিতি থেকে মাত্র ২৩ বছরের ব্যবধানে একটি জাতিকে মানবতার সর্বোচ্চ শিখরে নিয়ে যাওয়া কি যাই-তাই ব্যাপার? তাহলে কিভাবে সম্ভব হলো? নিম্নের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারব যে, তিনি তৎকালীন অধঃপতিত সমাজকে ধ্বংসের গভীর খাদ থেকে উদ্ধারের নিমিত্তে এর ইতিবাচক দিকের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সর্বপ্রথম তিনি মানুষের মন-মননে ‘আল্লাহ ও আখিরাতের ভয়’ জাগ্রত করার কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন। এ জন্য তিনি নেতিবাচক তথা উদ্যতভাব, খড়গহস্ত ও কর্কষভাষী হননি। বরং তাঁর মনের সবটুকু দরদ ঢেলে দিয়ে, একান্ত অকৃত্রিম হিতাকাক্সক্ষী সেজে ও অত্যন্ত কোমলভাবে মানুষকে বুঝিয়েছেন। যার স্বীকৃতি স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা উপরে উল্লিøখিত সূরা ইমরানের ১৬ নং আয়াতে দিয়েছেন। আল্লøাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘হে নবী, ভালো ও মন্দ কখনো সমান হতে পারে না। মন্দকে ভালো পন্থায় প্রতিরোধ করো। তখন দেখবে, তোমার সাথে যার শুত্রুতা, সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হয়েছে। (সূরা হা-মিম আস সেজদা-১৮) লক্ষ্য অর্জনে তিনি প্রথমেই তরবারির কাছে নয় বরং হিদায়াতের আলোর প্রয়োজনীয়তাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। হাত-পা ও মাথাকে নত করার আগে মানুষের মনের ব্যাকুলতার প্রয়োজনীয়তার অনুভব করেছেন। শারীরিক বশ্যতার আগে আত্মার আনুগত্যশীলতাকে উজ্জীবিত করেছেন। কারণ আল্লøাহর ভয় যার মনকে বিচলিত করে না, মানুষের ভয় তাকে কিভাবে বিচলিত করবে? সুতরাং দয়া-মায়া, সহানুভূতিশীল, কোমলতার কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান পৃথিবীর যুদ্ধ যুদ্ধ নীতিগুলো থেকে সহজেই অনুমান করতে পারি। এ ধরনের নেতিবাচক নীতি দ্বারা দেশ আর জনপদ বিরানই হবে কিন্তু ফলপ্রসূ কিছু বাস্তবায়িত হবে না।
মুসলিম শরিফের হাদিসে বর্ণিতÑ ‘আল্লøাহ যেদিন আকাশ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, সেদিন রহমত বা দয়াও সৃষ্টি করেছিলেন।’ (সংক্ষেপিত) হজরত আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, আমি এই হুজরার বাসিন্দা সত্যায়িত সত্যবাদী আবুল কাসেম সা:-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, ‘দয়া দুর্ভাগাদের থেকে তিরোহিত করা হয়’। রাসূল সা: আরো বলেন, ‘দয়ালুদের প্রতি আল্লøাহ দয়া প্রদর্শন করেন। তোমরা পৃথিবীবাসীদের দয়া করো, আকাশের মালিক তোমাদের দয়া করবেন। দয়া আল্লøাহর আত্মীয়। যে এর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে সে আল্লøাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করল। যে এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল সে আল্লøাহর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল।’ (তিরমিজি)
দয়া বিবর্জিত হৃদয় সাধারণত উৎপীড়ক ও অত্যাচারী হয়ে থাকে। দয়ার্দ্র হৃদয় মহান দয়ালুরই করুণার দান। যার হৃদয়ে দয়ার উদ্রেগ হয় না মনে করতে অবশ্যই দয়ার আধার মহামহিম রহিম ও রাহমানের দয়া থেকে সে বঞ্চিত আছে। কারণ রাসূল সা: বলেছেন,‘যে ব্যক্তি মানুষের ওপর দয়া করে না আল্লাহ তায়ালা তার প্রতিও রহমত বর্ষণ করেন না।’ (বোখারি) অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছেÑ কঠিন হৃদয় ব্যক্তি আল্লাহ নৈকট্য থেকে দূরে অবস্থান করবে। মহানবী সা: কঠিন অন্তর এবং অশ্রুহীন চক্ষুকে নাফরমান বলে আখ্যা দিয়েছেন। নবী সা: বলেছেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত দয়ার্দ্র না হবে ততক্ষণ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না।’ (তিবরানি)
যারা আল্লøাহ তায়ালা, নবী মুহাম্মদ সা: ও সাহাবায়ে কেরামের এ গুণের অধিকারী হতে পারবেন না তিনি আল্লাহর বান্দাহ, রাসূল সা:-এর উম্মত ও সাহাবায়ে কেরামের আদর্শের অনুসারী দাবি করার অধিকার রাখেন না। অতীতের অনেক জাতি তাদের কঠিন হৃদয় ও নির্দয়তার জন্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। আমাদের মধ্যে এমন চরিত্রের লোক পাওয়া খুব সহজ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যারা সামান্য ক্ষমতা পেলে অথবা সামান্য ধন-সম্পদের মালিক হলে, তাদের থেকে দয়া-মায়া ও অনুকম্পা দূরীভূত হয়ে যায়। এটি কোনো মুমিন ও মুসলমানের বৈশিষ্ট্য হওয়া ঠিক নয়। আল্লøাহ আমাদের প্রত্যেককে কোমলতা অবলম্বনের তাওফিক দিন। আমিন।
- ম্যানেজার, আইবিবিএল, জিন্দাবাজার শাখা, সিলেট

 


আরো সংবাদ



premium cement