২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

হাশরে কেউ কারো দায়িত্ব নেবে না

-

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যখন সব কিছুর মীমাংসা হয়ে যাবে তখন শয়তান বলবে, ‘সত্যি বলতে কি আল্লাহ তোমাদের সাথে যে ওয়াদা করেছিলেন তা সব সত্যি ছিল এবং আমি যেসব ওয়াদা করেছিলাম তার মধ্য থেকে একটিও পুরা করিনি। তোমাদের ওপর আমার তো কোনো জোর ছিল না, আমি তোমাদের আমার পথের দিকে আহ্বান জানানো ছাড়া আর কিছুই করিনি এবং তোমরা আমার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলে। এখন আমার নিন্দাবাদ করো না, নিজেরাই নিজেদের নিন্দাবাদ করো। এখানে না আমি তোমাদের অভিযোগের প্রতিকার করতে পারি আর না তোমরা আমার। ইতঃপূর্বে তোমরা যে আমাকে আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের শরিক করেছিলে তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই, এ ধরনের জালেমদের জন্য তো যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি অবধারিত’ (সূরা ইবরাহিম-২২)।
শুধু শয়তান নয়, বরং শয়তানের এজেন্টধারীদের যারা আজ অনুসারী, তারা কিয়ামতের দিন এদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাবে না এবং তারা ঠিক শয়তানের মতোই সব দায় এড়িয়ে যাবে ও তাদের আচরণও হবে শয়তানের মতো। প্রকৃতপক্ষে তাদেরও কিছু করার শক্তি থাকবে না। আল্লাহ বলেন, ‘এটি সেই দিন যখন কারোর জন্য কোনো কিছু করার সাধ্য কারো থাকবে না। ফয়সালা সে দিন একমাত্র আল্লাহর ইখতিয়ারে থাকবে’ (সূরা ইনফিতার-১৯)। আল্লাহ আরো বলেন, ‘এরা যখন সবাই একত্রে আল্লাহর সামনে উন্মুক্ত হয়ে যাবে, সে সময় এদের মধ্য থেকে যারা দুনিয়ায় দুর্বল ছিল তারা যারা নিজেদেরকে বড় বলে জাহির করত তাদেরকে বলবে, দুনিয়ায় আমরা তোমাদের অনুসারী ছিলাম, এখন কি তোমরা আল্লাহর আজাব থেকে আমাদের বাঁচানোর জন্যও কিছু করতে পারো? তারা জবাব দেবে, আল্লাহ যদি আমাদের মুক্তিলাভের কোনো পথ দেখাতেন তাহলে আমরা নিশ্চয়ই তোমাদেরও দেখিয়ে দিতাম। এখন তো সব সমান, কান্নাকাটি করো বা সবর করোÑ সর্বাবস্থায় আমাদের বাঁচার কোনো পথ নেই’ (সূরা ইবরাহিম-২১)।
দুনিয়াতে যারা আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে ভুলে গিয়ে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যাচ্ছে, রোজ হাশরে আহকামুল হাকিমিন মহান আল্লাহর বিচারালয়ে যখন রায় শুনানো হবে, তখন এসব অপরাধী আত্মপক্ষ সমর্থন করে শয়তানকে দোষারূপ করতে থাকবে। তখন শয়তান তার সব দায়দায়িত্ব অস্বীকার করবে। উল্লিখিত আয়াতে শয়তানের বক্তব্য কী হবে তা আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন।
যাদের আশা-আকাক্সক্ষা ও লোভ-লালসা আজ শয়তানের রঙিন পৃথিবীর মায়াজালে জড়িয়ে জীবনের সুখ খুঁজে ফিরছে, প্রকৃতপক্ষে তারা এক গোলক ধাঁধার খপ্পরে পড়েছে। এ ধাঁধা থেকে একমাত্র সে দিন তাদের হুঁশ ফিরে আসবে, যেদিনকার কথা উল্লিখিত আয়াতে বলা হয়েছে। সে দিন তারা জানতে পারবে যে, আল কুরআনে বিবৃত আল্লাহর ওয়াদাসমূহ। শয়তান সে দিন তার অবস্থান ব্যাখ্যা করে জানিয়ে দেবে যে, সত্যি সত্যিই ছিল আল্লাহর ওয়াদা। সে বলবে আল্লাহ সত্যবাদী, আমি মিথ্যাবাদী। এসব অপরাধী যারা আজ তার পদাঙ্ক অনুসরণ করছে, তাদের চোখে আঙুল দিয়ে শয়তান বলে দেবে যে, তোমরা কি দেখতে পাচ্ছো না, আল্লাহর প্রতিটি প্রতিশ্রুতি ও হুমকি অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। অন্য দিকে, আমি তোমাদের যে যেসব আশ্বাস দিয়েছিলাম, যেসব লাভের লোভ দেখিয়েছিলাম, যেসব সুদৃশ্য আশা-আকাক্সক্ষার জালে তোমাদের ফাঁসিয়েছিলাম এবং সর্বাগ্রে তোমাদের মনে যে বিশ্বাস স্থাপন করিয়েছিলাম যে, ওসব আখিরাত টাখিরাত বলতে কিছুই নেই। এগুলো নিছক প্রতারণা ও গালগল্প, আর যদি সত্যিই কিছু থেকে থাকে, তাহলে অমুক বুজুুর্গের বদৌলতে তোমরা সোজা উদ্ধার পেয়ে যাবে, কাজেই তাদের খেদমতে নজরানা ও অর্থ-উপাচারের উৎকোচ প্রদান করতে থাকো এবং তারপর যা মন চায় তাই করে যেতে থাকো, আমি তোমাদের এই যেসব কথা নিজে এবং আমার এজেন্টদের মাধ্যমে বলেছিলাম, এগুলো সবই ছিল নিছক প্রতারণা।
এখানে আমার প্রতারণা ছিল অনেকটা জাল বিছানোর মতোই। সেখানে আটকে যাওয়ার জন্য আমি তোমাদের বাধ্য করিনি। বরং তোমরা নিজে নিজে এসেই আমার মেকি রঙিন জালে এসে ধরা দিয়েছ। তোমরা এ মর্মে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবে না যে, তোমরা সত্য পথে চলতে চাচ্ছিলে এবং আমি জবরদস্তি করে হাত ধরে তোমাদের ভুল পথে টেনে নিয়েছিলাম। এর যা শাস্তি হয় আমি তা মাথা পেতে নেবো। কিন্তু তোমরাও স্বীকার করে নেবে যে, আসল ঘটনা তা নয়। আমি হকের আহ্বানের মোকাবেলায় বাতিলের আহ্বান তোমাদের সামনে পেশ করেছি মাত্র। সত্যের মোকাবেলায় মিথ্যার দিকে তোমাদের ডেকেছি মাত্র। আমার কথা মানা না মানার পূর্ণ স্বাধীনতা তোমাদের ছিল। তোমাদের বাধ্য করার কোনো ক্ষমতা আমার ছিল না। এখন আমার এ দাওয়াতের জন্য নিঃসন্দেহে আমি নিজে দায়ী ছিলাম এবং শাস্তিও আমি পাচ্ছি। কিন্তু তোমরা যে আমার দাওয়াতে সাড়া দিয়েছিলে, এর দায়ভার কেমন করে আমার ঘাড়ে চাপাতে চাচ্ছো। নিজেদের ভুল নির্বাচন এবং নিজেদের ক্ষমতার অসৎ ব্যবহারের দায়ভার পুরোপুরি তোমাদের বহন করতে হবে।
আপাদমস্তক মিথ্যার ওপর চালিত শয়তানের জীবনাচারের কোথাও সত্যের লেশমাত্র না থাকলেও সে দিন সে বাস্তব সত্যটুকু ঠিকই প্রকাশ করবে। দুনিয়ার জীবনে আল্লাহর ওয়াদাগুলোকে ভুলে গিয়ে শয়তানের আহ্বানে হরহামেশা সাড়া দিয়ে যাচ্ছে, তাদের সমীপে আল্লাহর ওয়াদাগুলো তুলে ধরা হলো।
আল্লাহ বলেন, ‘হে মানবসমাজ! তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের ওপর যা কিছু নাজিল করা হয়েছে তার অনুসরণ করো এবং নিজেদের রবকে বাদ দিয়ে অন্য অভিভাবকদের অনুসরণ করো না। কিন্তু তোমরা খুব কমই উপদেশ মেনে থাকো’ (সূরা আরাফ-৩)।
দুনিয়ার মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা। এ নির্দেশনায় আসল দাওয়াত দেয়া হয়েছে, সেটি হচ্ছেÑ দুনিয়ায় মানুষের জীবন যাপনের জন্য যে হেদায়াত ও পথ-প্রদর্শনের প্রয়োজন, নিজের ও বিশ্বজাহানের স্বরূপ এবং নিজের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুধাবন করার জন্য তার যে জ্ঞানের প্রয়োজন এবং নিজের আচার-আচরণ, চরিত্র, নৈতিকতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারাকে সঠিক ভিত্তির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য সে যেসব মূলনীতির মুখাপেক্ষী সেগুলোর জন্য তাকে একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকেই নিজের পথপ্রদর্শক হিসেবে মেনে নিতে হবে এবং তার রাসূলের মাধ্যমে যে হেদায়াত ও পথ-প্রদর্শনা দিয়েছেন একমাত্র তারই অনুসরণ করতে হবে।
আল্লাহকে বাদ দিয়ে শয়তান ও তার সহচরদের কারো দিকে পথ-প্রদর্শনা লাভ করার জন্য মুখ ফিরানো এবং তার নেতৃত্বের আওতায় নিজেকে সমর্পণ করা মানুষের একটি মৌলিক ভ্রান্ত কর্মপদ্ধতি ছাড়া আর কিছুই নয়। এর পরিণামে মানুষকে সব সময় ধ্বংসের সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও তাকে সব সময় এই একই পরিণামের সম্মুখীন হতে হবে। শয়তান তাকে সে দিকেই নিয়ে যাবে। এ জন্য আল্লাহ তায়ালা বলে দিয়েছেন, ‘হে মানবজাতি! পৃথিবীতে যেসব হালাল ও পাক জিনিস রয়েছে সেগুলো খাও এবং শয়তানের দেখানো পথে চলো না। সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। সে তোমাদের অসৎ কাজ ও অনাচারের নির্দেশ দেয় আর এ কথাও শেখায় যে, তোমরা আল্লাহর নামে এমন সব কথা বলো যেগুলো
আল্লাহ বলেছেন বলে তোমাদের জানা নেই’ (সূরা বাকারা : ১৬৮-১৬৯)।
আল্লাহ আরো বলেন, ‘হে বনি আদম! শয়তান যেন তোমাদের আবার ঠিক তেমনিভাবে বিভ্রান্তির মধ্যে নিক্ষেপ না করে যেমনভাবে সে তোমাদের পিতা-মাতাকে জান্নাত থেকে বের করেছিল এবং তাদের লজ্জাস্থান পরস্পরের কাছে উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্য তাদেরকে বিবস্ত্র করেছিল। সে ও তার সাথীরা তোমাদেরকে এমন জায়গা থেকে দেখে যেখান থেকে তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না। এ শয়তানদেরকে আমি যারা ঈমান আনে না তাদের অভিভাবক করে দিয়েছি। তারা যখন কোনো অশ্লীল কাজ করে তখন বলে, আমাদের বাপ-দাদাদেরকে আমরা এভাবেই করতে দেখেছি এবং আল্লাহই আমাদের এমনটি করার হুকুম দিয়েছেন। তাদেরকে বলে দাও, আল্লাহ কখনো নিলর্জ্জতা ও বেহায়াপনার হুকুম দেন না। তোমরা কি আল্লাহর নাম নিয়ে এমন কথা বলো যাকে তোমরা আল্লাহর কথা বলে জানো না’ (সূরা আরাফ : ২৭-২৮)?
আল্লাহর এই সতর্কবার্তা প্রদানের পরও যারা শয়তানের পথে চলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর প্রদর্শিত পথে চলতে যারা অস্বীকার করেছে তাদের অবস্থা ঠিক তেমন যেমন রাখাল তার পশুদের ডাকতে থাকে কিন্তু হাঁকডাকের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই তাদের কানে পৌঁছে না। তারা কানা, বোবা ও অন্ধ, তাই কিছুই বুঝতে পারে না’ (সূরা বাকারা-১৭১)। তাদের অবস্থা সেই নির্বোধ প্রাণীদের মতো হয়ে যায় যারা একটি পালে বিভক্ত হয়ে নিজেদের রাখালদের পেছনে চলতে থাকে এবং না জেনে বুঝেই তাদের হাঁকডাকের ওপর চলতে ফিরতে থাকে। শয়তানের অনুসারীদের অবস্থাও তদ্রƒপ, তাদেরকে আহ্বান করার ও তাদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত প্রচারের সময় মনে হতে থাকে যেন নির্বোধ জন্তু-জানোয়ারদের আহ্বান জানানো হচ্ছে, তারা কেবল আওয়াজ শুনতে পাবে কিন্তু কী বলা হচ্ছে তা কিছুই বুঝতে পারে না। তাদের অবস্থা এমনই চরম পর্যায়ে পৌঁছায় যে, আল্লাহ বলেন, ‘এরাই হিদায়াতের বিনিময়ে ভ্রষ্টতা কিনে নিয়েছে এবং ক্ষমার বিনিময়ে কিনেছে শাস্তি। এদের কি অদ্ভুত সাহস দেখো। জাহান্নামের আজাব বরদাশত করার জন্য এরা প্রস্তুত হয়ে গেছে’ (সূরা বাকারা-১৭৫)।
ম্যানেজার, আইবিবিএল, জিন্দবাজার শাখা, সিলেট।


আরো সংবাদ



premium cement