দু’দিনের ভ্রমণ : কিছু ব্যথা, কিছু কথা
- উসমান বিন আবদুল আলিম
- ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০৫
ভ্রমণ মানুষের মনকে প্রফুল্ল করে তোলে। স্রষ্টার সৃষ্টির রহস্যময় জানার জন্যও ভ্রমণের বিকল্প নেই। বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বলেছেন, ‘ভ্রমণ স্রষ্টার সৃষ্টিরহস্য জানায়, ভ্রমণ আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।’ ভ্রমণের মাধ্যমে জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধি পায়। অর্জন হয় কিছু জানাশোনা আর কিছু অভিজ্ঞতা। তাই ভ্রমণপিপাসুদের কাছে ভ্রমণ সবসময়ই আনন্দময় ও তৃপ্তিদায়ক হয়ে থাকে। তবে ভ্রমণটি গুনাহমুক্ত, আল্লাহর নিদর্শন দেখা ও জ্ঞান অন্বেষণ করার জন্য হতে হবে। তখনই ভ্রমণ সার্থক হবে।
ভ্রমণের মাধ্যমে ঐতিহাসিক স্থানে গিয়ে বিভিন্ন বিষয় জানা যায়। পূর্বেকার ব্যক্তিদের দেখে শিক্ষা অর্জন করা যায়। পৃথিবীতে বিচরণ করলে বোঝা যায় আল্লাহর সৃষ্টির রহস্য। কারিগরহীন কত নিপুণভাবে তিনি এই পৃথিবীকে ও পৃথিবীর সব প্রাণীকে সৃষ্টি করেছেন। ভ্রমণ করার মাধ্যমে জানা যায়, পূর্বেকার জালেম বা মিথ্যাবাদীদের আল্লাহর দেয়া শাস্তির বর্ণনা। তাদের থেকে শিক্ষা নেয়া যায়, নিজেকে শোধরানোর পন্থা বের করা যায়।
ইরশাদ হয়েছে, ‘বলে দাও, তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো, অতঃপর দেখো, যারা সত্যকে মিথ্যা বলেছে, তাদের পরিণাম কী হয়েছিল?’ (সূরা আনআম, আয়াত-১১) অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বলো, তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো এবং অনুধাবন করো, কীভাবে তিনি সৃষ্টির সূচনা করেছেন? অতঃপর আল্লাহ সৃজন করবেন পরবর্তী সৃষ্টি। আল্লাহ তো সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।’ (সূরা আনকাবুত, আয়াত-২০)
সম্প্রতি বন্ধুবর হুসাইনের নিমন্ত্রণে রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলায় যাওয়ার সুযোগ হয়।
এঁকেবেঁকে গেছে রাস্তা। মাঝে মধ্যে বিশালাকার ফসলি জমিন। কিছু দূর পরপরই মানুষের বসবাস। একটি বড় বাজার। কয়েকটি প্রাইমারি স্কুল। তিন-চারটি মসজিদ। পুরো গ্রামজুড়ে একটিমাত্র মাদরাসা, তাও আবার সেই মাদরাসাটি বন্ধ। বিষয়টি দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে গেলাম। আমরা এদিক-সেদিক ঘুরেফিরে একপর্যায়ে পদ্মার পাড় চলে যাই। ততক্ষণে পদ্মার ওপাশে দিনমনি পশ্চিমাকাশে রক্তিম লালিমা ছড়িয়ে বিদায়ের হাতছানি দিচ্ছে। একদিন আমাদেরকেও এই বসুন্ধরা থেকে বিদায় নিতে হবে, চিরস্থায়ী বিদায়। প্রস্তুতি আছে কি আমাদের? অনুশোচনার বিষয়।
মাগরিবের সময় ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু চারিপাশ থেকে কোনো আজানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে না। মসজিদের খোঁজে বের হলাম। কিছু দূর যেতেই মসজিদের দেখা মেলে। হাতেগোনা কয়েকজন মুসল্লির দেখা পেলাম। একজন মুখ দিয়ে আজান দিলেন। আমরা তড়িঘড়ি করে অজুু করে মসজিদে প্রবেশ করি। আমাদের দিকে মুসল্লিদের চাহনি দেখে প্রথমে ভয় পেয়ে যাই। পরক্ষণেই বুঝতে পেরেছি এলাকাটিতে সাধারণত হুজুরের দেখা মেলে না। হঠাৎ জুব্বা পরিহিত দু’জন হুজুর কোথার থেকে এলো (!) তাই তারা অপার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।
মুসল্লিদের সাথে পরিচয় হলাম। তারা বলল- হুজুর, আমাদের ইমাম নেই আপনাকেই নামাজ পড়াতে হবে। আমি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম কেন? তারা জানালেন- হুজুর আমাদের মসজিদের শুধু জুমার নামাজ পড়ানোর জন্য ইমাম রয়েছে, তাও তিনি অনেকদূর থেকে আসেন। কিন্তু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ইমাম নেই। আমাদের এলাকায় এরকম হুজুর নেই যে, যিনি এখানে ইমামতি করবেন। তাই আমরা নামাজের সময় হলে মসজিদে এসে আজান দিয়ে থাকি। কেউ নামাজ পড়ানোর থাকলে তিনি পড়ান অন্যথায় আমরা যে যার মতো করে নামাজ আদায় করে বাড়িতে চলে যাই। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নামাজ পড়ালাম। ভাবলাম- এমনো এলাকা আমাদের বাংলাদেশে রয়েছে! নিজেদের জন্য আফসোস হলো। আমরা দ্বীনী কাজ কতটুকু করছি? কী জবাব দেবো প্রভুর দরবারে?
নামাজ পড়ে মুসল্লিদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হলাম। পথিমধ্যে কিছু লোককে দেখতে পেলাম, যারা আমাদেরকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করছে- আপনারা কি আমাদের এলাকায় তাবলিগে আসছেন। বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, তাদের এরকম প্রশ্নের কারণ। সে উত্তর দিলো- আমাদের এলাকায় সাধারণত হুজুর দেখা যায় না। পুরো গ্রামে শুধু আমি একাই আলেম। আরো কয়েকজন আছে কিন্তু তারা শুধু নিজের নামাজ পড়তে বা মাঝে মধ্যে পড়ানোর ভেতরই সীমাবদ্ধ।
পরদিন সকালে নাশতার পর্ব শেষ করে আবার বের হই। এলাকার একটি বড় আমবাগানে গিয়ে বসি। আমাদের দেখে সেখানকার আশপাশ থেকে কিছু ছেলেমেয়ে আমাদের কাছে আসে। আমি তাদের সাথে পরিচিত হই। বিভিন্ন বিষয় জিজ্ঞেস করি। একপর্যায়ে আমি তাদেরকে ‘কালেমায়ে-তাওহিদ’, নামাজের কথা, কালেমায়ে ‘শাহাদাত’, সূরা ফাতেহা ও টুকটাক কিছু ইসলামী বিষয় জিজ্ঞেস করি। যা সাধারণ শিশুরা পেরে থাকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, তারা কেউ আমার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম- তোমরা বাসায় বা সকালে মক্তবে আরবি পড়ো না? তাদের উত্তর ছিল- আমাদেরকে বাসায় তো পড়ায়নি, কিন্তু একটি মক্তব ছিল, তাও কয়েক বছর আগে। এখন আর সেটা নেই, তাই আমরাও পড়ি না। একটা ১০ বছরের শিশুকে জিজ্ঞেস করলাম- তুমি কি মসজিদে যাও নামাজের জন্য? সে বলল; আমি তো সূরাই পারি না, নামাজ কীভাবে পড়ব!
আমি বন্ধুবর হুসাইনকে জিজ্ঞেস করলাম, এমন কেন? এই বয়সের শিশুরা তো এগুলো শিখে থাকে। একটা ১০ বছরের শিশু তো মসজিদে যাওয়া-আসার অভ্যাস করে। কিন্তু এরা তো কিছুই জানে না। এদের কোনো ইসলামী জ্ঞান নেই! শিশুরা কালেমা জানে না!
সে তখন বলল, ‘একসময় আমাদের গ্রামে একটা মক্তব ও মাদরাসা ছিল। যেখানে আমরা শৈশবে পড়াশোনা করেছি। এমনকি কৈশোরেও আমরা এখানে পার করেছি। কিন্তু আমরা এলাকা থেকে যাওয়ার পর কোনো ভালো আলেম না থাকায় বা পরিচালনার জন্য যোগ্য লোক নেই বিধায় মাদরাসাটি চার-পাঁচ বছর আগে বন্ধ হয়ে যায়। আর খোলা হয়নি। তবে আমি চেষ্টা করছি। টাকার প্রয়োজন। মাদরাসার মেরামত করতে হবে। শিক্ষকদের বেতনের জন্য ভাবতে হবে। বর্তমানে মাদরাসাটিতে বিদ্যুৎ অফিস করা হয়েছে। তাদেরকে টাকা দিয়ে সরাতে হবে।’
আমরা এখন যা বুঝতে পারি, প্রতিটি গ্রামে একটি করে মক্তব করা জরুরি। শিশুদের ইসলামিক শিক্ষা দিতে হবে। তাদের পেছনে মেহনত করতে হবে। আর এর জন্য প্রথমে পরিবারকে ইসলামের দিকে ধাবিত করতে হবে। যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো তারা সাধ্যমতো নিজেদের এলাকায় ছোট ছোট মক্তব করে তুলতে হবে। অথবা যাদের জানা আছে তারা নিজেদের সময় অনুযায়ী তাদেরকে ডেকে এনে প্রয়োজনীয় বিষয়াদি শিক্ষা দেয়া। আমরা যদি সোচ্চার না হই তাহলে দিন দিন এদেশ থেকে ইসলাম উঠে যাবে।
উপরোক্ত এলাকার মতো প্রতিটি গ্রামের অবস্থা হয়ে যাবে। আমাদের দেশের অনেক দাওয়াতি সংগঠন আছে তারা কাজ করে যাচ্ছে। তাদের সাথে সাথে আমাদেরও সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। অন্যথায় পশ্চিমা সভ্যতার থাবায় এ দেশ থেকে ইসলাম উঠে যেতে বেশি দিন লাগবে না। এ গ্রামগুলোতে ইহুদি-নাসারাদের থাবা বেশি। সহজেই তাদের ব্রেন ওয়াশ করতে পারে। তাই যেখানে পুরনো মাদরাসা আছে সেই মাদরাসাগুলোর যত্ন নিতে হবে। মাদরাসা না থাকলে সবার প্রচেষ্টায় প্রতিটি গ্রামে একটি করে মাদরাসা গড়ে তুলতে হবে। এলাকার মানুষদের বুঝিয়ে মাদরাসার প্রতি মোহব্বত বাড়াতে হবে। তাদের থেকে মাদরাসার জন্য সহযোগিতা নিতে হবে। পাড়ায় পাড়ায় মক্তব তৈরি করতে হবে। শিশুদের জন্য মক্তবের বিকল্প নেই।
যতদিন এ দেশে হক্কানি আলেম-উলামা থাকবে, মাদরাসাগুলো থাকবে, মক্তব থাকবে প্রতিটি এলাকায়। ইনশা আল্লাহ ততদিন এ দেশে ইসলাম থাকবে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সঠিক বুঝার ও দ্বীনী কাজ বেশি বেশি করার তাওফিক দান করুন, আমিন।
মোহাদ্দেস, জামিআ ইসলামিয়া আরাবিয়া বলিয়ারপুর, সাভার, ঢাকা
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা