২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভার্চুয়াল গেম ও সুপ্ত আগ্নেয়গিরি

-

নব্বইয়ের দশকে আমাদের শৈশব ও বাল্যকাল কেটেছে, কেটেছে কৈশোর। সে সময়ের কিছু দৃশ্য আজও মনের কোণে উঁকি দেয়। চোখ লাল না হওয়া পর্যন্ত পুকুরে সাঁতার কাটা, গাছে চড়ে পাকা পেয়ারা কিংবা আম পাড়া, বর্ষাকালে ছিপ, জাল বা ডুব দিয়ে মাছ ধরা, বিকেল হতেই ব্যাট-বল কিংবা ফুটবল নিয়ে মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাঠে খেলতে যাওয়া, কখনোবা প্রিয় বন্ধুদের সাথে ঝগড়া করে মন খারাপ করে বাড়ি ফেরা ইত্যাদি আজও স্মৃতির পাতায় জ্বলজ্বল করছে! মায়ের চোখ রাঙানি কিংবা বকুনি কিছুতেই কৈশোরের সে দুরন্তপনাকে দমিয়ে রাখতে পারত না। আবার বাধ্য ছেলের মতো ফজরের পর আরবি কায়দা বা আমপারা বুকে জড়িয়ে মক্তবে যেতাম আর সন্ধ্যার পর হারিকেন কিংবা কুপি জ্বালিয়ে উঁচু আওয়াজে পড়ে বড় ভাই-বোনদের বিরক্ত করতাম! এসব নিয়ে তাদের সাথে ঝগড়া-খুনসুটি তো লেগেই থাকত!
কোথায় যেন হারিয়ে গেল সেই দিনগুলো। গ্রামটাও যেন আর আগের মতো নেই। খেলার মাঠে চাঞ্চল্য ও কিশোরদের দুরন্তপনা আর চোখে পড়ে না। তাদের বন্ধুগুলোও আজ ভার্চুয়াল, ভাইবোন সবাই নিজ নিজ ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত, তাই খুনসুটি করার মতো সময় তাদের আজ নেই!
আধুনিক জীবনে প্রযুক্তির অবদান ও প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। প্রযুক্তি তার জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় আমাদের জীবনকে করেছে সহজ ও আরামদায়ক। পুরো বিশ্বকে একটি গ্লোবাল ভিলেজে রূপান্তর করার কৃতিত্ব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিরই। উপকারের পাশাপাশি এর কিছু নেতিবাচক দিকও আছে যেগুলো সেøা পয়জনিংয়ের মতো নীরব ঘাতক হয়ে তরুণ প্রজন্মকে বিপথগামী করছে। স্ক্রিন আসক্তি এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ফেসবুক, ইউটিউব, পর্নোগ্রাফির পাশাপাশি ভিডিও গেম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সারা বিশ্বের শিশু, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীদের মধ্যে ভিডিও গেমের নেতিবাচক প্রভাব এতটাই বেশি যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আর দীর্ঘ গবেষণার পর ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ ‘গেমিং অ্যাডিকশন’ চিহ্নিত করে এটিকে মনোস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে গ্রহণ করেছে ২০১৮ সালের জুন মাসে! গবেষণায় দেখা গেছে, কিশোর ও তরুণদের মধ্যে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ ইন্টারনেট গেমিংয়ে আসক্তিতে ভুগছে। যাদের মধ্যে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হচ্ছে কিশোর আর ১ দশমিক ৩ শতাংশ কিশোরী।
বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসির তথ্যমতে, এপ্রিল ২০১৯ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৯ কোটি ৩৭ লাখ মানুষ ইন্টারনেটের গ্রাহক, আর এদের মধ্যে ৮ কোটি ৭৯ লাখ ব্যবহারকারী মুঠোফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটে যুক্ত হয়। ২০১৬ সালের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৩৫ শতাংশ হচ্ছে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর-কিশোরী। এরাই কিন্তু গেমিং আসক্তি হওয়ার সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
আমাদের দেশে এ বিষয়ে এখনো ব্যাপকভাবে কোনো স্টাডি হয়নি। তবে প্রাপ্ত এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ঢাকার কল্যাণপুর এলাকার ৫০%, ধানমন্ডির ২৪%, মিরপুরের ২১%, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশ এলাকার ১৮% শিশু গেম খেলায় অভ্যস্ত। সুতরাং আমাদের দেশেও এর কুপ্রভাব সহজেই অনুমেয়।
আসক্তির লক্ষণসমূহ : গেম খেললেই তা আসক্তি নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য গবেষণা দলের মতে, গেমিং আসক্তির লক্ষণগুলো ১২ মাস ধরে থাকতে হবে। তবে লক্ষণ যদি গুরুতর ধরনের হয় তবে সেগুলো অল্প দিন দেখা দিলে সেটাকেও গেমিং ডিজঅর্ডার বলা যাবে।
বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী গেম আসক্তির উল্লেখযোগ্য লক্ষণগুলো হলো : অধিকাংশ সময় গেম বিষয়ে চিন্তা করা। গেইম খেলতে না পারলে অস্বস্তি বোধ হওয়া। আরো বেশি সময় ধরে গেম খেলার প্রয়োজন বোধ করা। অন্যান্য সাধারণ কাজ এমনকি পছন্দের কাজও করতে না চাওয়া। গেমের কারণে কাজে ও স্কুলে নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হওয়া। ‘কতক্ষণ গেম খেলো’ এই প্রশ্নের জবাবে গেমের প্রতি দুর্বলতা ঢাকতে আপনজনের কাছে মিথ্যা বলা। দিন দিন ইন্টারনেটে গেম খেলার সময় বাড়তে থাকা। ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়া। দিনে ঘুমানো আর রাতে জাগা। খাবার গ্রহণে অনিয়মিত হওয়া। বাসায় সবার সঙ্গে টেবিলে বসে না খেয়ে নিজের ঘরে একা বসে খেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা। সামাজিকতাবোধ কম পায়। নন-গেমার কারো সঙ্গে মিশতে না চাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। খেলার সময় কেউ ডাকলে বা মোবাইলে কল দিলে রেগে যাওয়া, ইত্যাদি।
আসক্তির ফলাফল : গেম আসক্তির পরিণাম বেশ ভয়াবহ। মূলত ইন্টারনেট গেম আসক্তি অন্যান্য নেশাজাত দ্রব্যের আসক্তির মতোই। পার্থক্য হচ্ছে এটি আচরণগত আসক্তি, আর অন্যান্য নেশাজাত দ্রব্যের আসক্তি হলো রাসায়নিক আসক্তি। মস্তিষ্কের যে অংশে (রিওয়ার্ড সেন্টার) ইয়াবা বা গাঁজার মতো বস্তুর প্রতি আসক্তি জন্ম নেয় ঠিক সেই অংশেই ইন্টারনেট বা গেমের প্রতি আসক্তি জন্মায়। তাই একে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই।
শিশুদের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর দিক : এটি দৃষ্টিশক্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। রুচিহীনতা তৈরি হয় ও খাদ্যাভ্যাসে প্রভাব ফেলে। রাগ ও আক্রমণাত্মক আচরণ বৃদ্ধি পায়। আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মমর্যাদা হ্রাস পায়। স্কুলে অনুপস্থিতির হার এবং খারাপ রেজাল্ট হয়। মা-বাবা ও অন্য নন-গেমার বন্ধুদের সাথে দূরত্ব তৈরি হয়। মস্তিষ্কের মনোযোগ নিয়ন্ত্রণকারী অংশে নেতিবাচক পরিবর্তন হয়, ফলে পড়াশোনাসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ হ্রাস পায়। গেমের জন্য টাকা চুরির প্রবণতা বাড়ে। অটিজম শিশুদের ক্ষেত্রে জটিলতা আরো বৃদ্ধি পায়। বড়দের ক্ষেত্রে শারীরিক ক্লান্তি, মাথা ব্যথা ও মাইগ্রেন, দাম্পত্য কলহ বৃদ্ধি, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা হ্রাস প্রভৃতি সমস্যা দেখা দেয়।
অভিভাবকদের করণীয় : ডিভাইস ব্যবহারের ক্ষেত্রে সন্তান কী ব্যবহার করবে এবং কতটুকু সময় ব্যবহার করবে তা আপনি নিজে নির্ধারণ করুন এবং সে ক্ষেত্রে যাবতীয় হোমওয়ার্ক কমপ্লিট করার শর্ত জুড়ে দিন। সন্তানের সামনে অপ্রয়োজনে ডিভাইস ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। আপনার সন্তানের কাছে যেমনটি আশা করেন নিজেও তা অনুশীলন করুন। সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দিন। পিতা-মাতার সাথে সম্পর্কের দূরত্ব সন্তানের বিপথগামী হওয়ার অন্যতম কারণ। পারিবারিক পাঠাগার গড়ে তুলুন। সন্তানকে তার বয়সের উপযোগী বই উপহার দিন। একাধিক সন্তান থাকলে বই পাঠের প্রতিযোগিতা ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করুন। সন্তানকে ধর্মচর্চা ও নৈতিকতা শিক্ষাদানের পাশাপাশি ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বা যুগশ্রেষ্ঠ মনীষীদের জীবনযাপন ও সময়নিষ্ঠতা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দিন।
ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি : একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা। এটিও তার ব্যতিক্রম নয়। একজন মানুষের স্বাভাবিক বিকাশের স্বার্থে খেলাধুলা বা চিত্তবিনোদনকে ইসলাম নিষেধ করে না। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু শর্ত ও মূলনীতি রয়েছে। প্রসিদ্ধ প্রথিতযশা বিদ্বান সালেহ আল মুনাজ্জিদ হাফি: তাঁর বিশ্ববিখ্যাত ওয়েবসাইট রংষধসয়ধ.রহভড় তে গেমস খেলার বিধান বিষয়ক এক প্রশ্নোত্তরে বলেন, গেমস বা খেলাধুলাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়...
প্রথমত, যেসব খেলার মাধ্যমে শরীরচর্চা হয় ইসলামে তা বৈধ, প্রয়োজন সাপেক্ষে উত্তমও বটে। যেমন : দৌড়, সাঁতার, ঘোড়দৌড়, ফুটবল, ক্রিকেট ইত্যাদি। তবে সে ক্ষেত্রে সতর খোলা, আর্থিক চ্যালেঞ্জ, বাজি ধরা ইত্যাদি নিষিদ্ধ কর্ম পরিহার করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, যেসব খেলায় শারীরিক পরিশ্রম নেই তার বিধান আপেক্ষিক। মিউজিক, প্রাণী বা শত্রুকে আক্রমণ কিংবা হত্যা করতে গুলি বা বোমা হামলা, নগ্নতা, বিশেষ ধর্মানুভূতি ও তার সিম্বলে আঘাত, ফাইটারের বারবার মৃত্যু ও পুনর্জীবন লাভ, লাইফ বৃদ্ধি, জাদু, লুডু, কার্ড, পাশা বা জুয়া, সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার, পৃথিবী ও ভিন্ন গ্রহের প্রাণীর ছবি, গুপ্তহত্যা, উগ্রতা, অস্ত্র চালানো, সাধারণ বা ধর্মীয় মূর্তিকে সম্মানের মাধ্যমে বিশেষ ক্ষমতা লাভ ইত্যাদি নিষিদ্ধ কর্মবিশিষ্ট গেমস খেলা হারাম। এসব নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত গেমস বৈধ তবে তা যেন শারীরিক বা মানসিক ক্ষতির কারণ না হয় এবং ধর্মীয় আবশ্যক বিধিবিধান পালনে বাধা সৃষ্টি না করে তা নিশ্চিত করতে হবে। আল্লাহ বলেন : ‘যারা তাদের দ্বীনকে খেলা-তামাশা বানিয়ে নিয়েছিল আর দুনিয়ার জীবন যাদেরকে প্রতারিত করেছিল। কাজেই আজকের দিনে তাদেরকে আমি ভুলে যাব যেভাবে তারা এ দিনের সাক্ষাৎকে ভুলে গিয়েছিল...’ (সূরা আরাফ : ৫১)।
বর্তমান প্রজন্মের গেমস আসক্তিকে পুঁজি করে এর নির্মাতারা বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। তরুণদের ক্রমবর্ধমান আসক্তির ফলে তাদের আয় উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। আসক্তির এ ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে একটি অসুস্থ প্রজন্ম দেখার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। তাই সন্তানের হাতে ডিভাইস তুলে দিয়ে তাদের সুপ্ত আগ্নেয়গিরিতে নিক্ষেপ করছেন কি না তা ভেবে দেখার এখনই সময়!

 


আরো সংবাদ



premium cement