১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নয়ন জুড়ানো জীবন

-

উড়ন্ত পাখিটি ব্যস্ত ছোট্ট ছানার জন্য খাবার সংগ্রহ নিয়ে, পাখিটি ছোট্ট ছোট্ট প্রাণীগুলোর জন্য সারা দিন তন্ময় হয়ে ঘুরতে থাকে। তপ্ত রোদে এ ছুটে চলা পাখিদের ক্লান্তির সাথে মিশে আছে এক গভীর ভালোবাসা; এভাবেই এ ডাল থেকে ও ডালে কেটে যায় পাখিদের সুখের দাম্পত্য জীবন। মানব সমাজেও অনুরূপ চিত্র রয়েছে যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ, রব্বে কারিম সূরা আরাফের ১৯ নং আয়াতে বলেছেন, ‘হে আদম তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করো এবং যেখানে ইচ্ছা খাওয়া দাওয়া করো’Ñ এ আয়াতটিতে আসকুন শব্দটি এসেছে যার অর্থ মানসিক প্রশান্তি। এ বক্তব্য থেকে এ বিষয় সুস্পষ্ট যে, মানুষ এবং অন্য সব জীবের জন্য পরিবার মানসিক প্রশান্তির অন্যতম একটি স্থান।
‘আইয়ুন কুররাতু’Ñ দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত শব্দ, এর একটি হলো কুররাতু অর্থÑ ‘শীতলতা, প্রীতিকর বা শান্তি। অপর শব্দ ‘আইয়ুন’ অর্থÑ চোখ বা নয়ন। শব্দ দুটির একত্রে অর্থ হয়Ñ নয়ন প্রীতিকর। রব্বে কারিম সূরা ফুরকানে এক চমৎকার দোয়া আমাদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। শৈল্পিক ও চমৎকার এই দোয়ার মর্ম অনুধাবন সে হৃদয়সমূহ করতে পারবে যারা ইসলাম অনুযায়ী পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে জীবনকে সাজাতে আগ্রহী।
পরিবার মূলত একটি জাতির মেরুদণ্ড ও সমাজের মূল ভিত্তি। পরিবার এমন একটি বন্ধন যা সৌহার্দ্য ও ভালোবাসা দৃঢ় করার পাশাপাশি সমাজের প্রত্যেক সদস্যের সাথে একটি মজবুত সম্পর্ক গড়ে দেয়। পারিবারিক সম্পর্ক যত পোক্ত হয় সমাজে ঠিক ততটুকু শৃঙ্খলা বিরাজ করে, পারিবারিক ক্ষেত্রে যখন সম্পর্কের বিরাগভাব চলতে থাকে তখন সমাজে শুরু হয় বিপর্যয়। ইসলামে পরিবার একটি উজ্জ্বল দর্পণ, এই দর্পণে ফুটে ওঠে ইসলামের সুমহান শিক্ষা ও আদর্শ। সদ্য জন্মানো শিশুর প্রাথমিক ধ্যান জ্ঞানে পরিবারের ছাপ ছায়া ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান, প্রত্যেক শিশুর প্রথম পাঠশালা পরিবার। পুষ্প বাগের যেমন পরিচর্যার প্রয়োজন তেমনি একটি শিশুর সুস্থ ও ঈমানদীপ্ত হৃদয় মস্তিষ্কের জন্য কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তি থাকা আবশ্যক।
চলমান সমাজে নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম একটি কারণ ‘পারিবারিক বিপর্যয়’, পারিবারিক বিপর্যয় তখনই ঘটে যখন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ঘাটতি হয়। এ ছাড়া পরিবারকে সময় না দিয়ে প্রযুক্তিগত বিষয়ে বেশি সময় দেয়া ও বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কগুলো সামাজিক অস্থিরতার অন্যতম কারণ। সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজন প্রাপ্তবয়স্কদের মাঝে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী বিয়ে, কেননা যথাযথ সময়ের যথাযথ কাজ থেকেই উত্তম ফিডব্যাক আসে।
পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণ আমাদের উম্মাহর আত্মীক, পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি ব্যাহতকরণে দায়ী। পাশ্চাত্যবাসীরা বছরে একটা নির্দিষ্ট সময়ের অতি ক্ষুদ্র অংশকে পরিবারের জন্য বরাদ্দ করে দায়দায়িত্ব থেকে হাত গুটিয়ে নেয় অথচ অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, এই পাশ্চাত্যের ধাঁচে আমাদের মুসলিম ভাই-বোনেরা অনেকেই এখন ছিটেফোঁটা অতি সামান্য কারণে বিয়েবিচ্ছেদের মতো নিকৃষ্টতম হালালের পথ বেছে নেয়। পাশ্চাত্যের এই বিষাক্ত ছোবল থেকে মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা করতে চাইলে আদর্শ পরিবার গঠনের বিকল্প নেই।
একটি আদর্শ পরিবার নৈতিক শিক্ষার অন্যতম প্রতিষ্ঠান। রব্বে কারিমের প্রতি ভয় ও ভালোবাসার আবহ সৃষ্টি করতে পারে মৌলিক মানবীয় গুণাবলি ও সুন্দর পরিচ্ছন্ন নীতি-নৈতিকতা, পারিবারিক সদস্যদের হৃদয়ে তাকওয়ার ভিত্তি স্থাপন ছাড়া একটি আদর্শ পরিবার গঠন অসম্ভব। হাদিসে রয়েছে, আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিতÑ রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে তিনটি আমল বন্ধ হয় নাÑ ১. সদকায়ে জারিয়া; ২. এমন জ্ঞান (ইলম) যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় ও ৩. এমন নেক সন্তানÑ যে তার জন্য দোয়া করে’ (সহিহ মুসলিম-৪৩১০)।
তাই কবরকে শান্তির বিছানাস্বরূপ করার জন্য এবং পরকালে সম্মানিতদের কাতারে শামিল থাকার জন্য সন্তানকে ঈমানি আলোয় আলোকিতরূপে লালন পালন অপরিহার্য।
‘আল্লাহর কাছে প্রতিটি কাজের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জবাব আমাকে দিতে হবে’ অভিভাবক কর্তৃক যদি এ অনুভূতি সন্তানদের হৃদয়ে তৈরি করা যায় তাহলে পারিবারিক সদস্যদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক সব ক্ষেত্র হবে কলুষমুক্ত। আদর্শ সমাজ গঠনের নিমিত্তেই আদর্শ পরিবার গঠন করতে হবে। পরিবারে স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন কিংবা বাবা-মায়ের মধ্যে যে মতবিরোধ, সঙ্কীর্ণ মনোভাব ও আমিত্ববোধ তা দূর হতে পারে ‘আল্লাহর জন্যই কাউকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার’ মাধ্যমে। আর যিনি মহান প্রতিপালক,যিনি সুমহান রব, তাঁর জন্য কিছু করা মানেই এর প্রতিদান মুমিনের সেই কাক্সিক্ষত মঞ্জিল ‘জান্নাত’।
সামাজিক সংস্কারে একটি আদর্শ পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, একটি আদর্শ পরিবার আমাদের স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু। কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী সাজানো দাম্পত্য জীবন শুধু নিজেদের জন্য নয় বরং গোটা মানবসমাজের মধ্যে আল্লাহর অনুগ্রহ বয়ে আনে।
রাতের শেষ অংশের রহমতের নিস্তব্ধতায় একাকী রব্বে কারিমের সাথে আলাপনে লাখো কোটি মুমিনের হৃদয় থেকে আবার নতুন করে, এক নতুন লক্ষ্যে উচ্চারিত হোকÑ ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে এমন স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করো যারা আমাদের চোখ জুড়িয়ে দেয় আর আমাদেরকে বানিয়ে দাও মুত্তাকিদের নেতা’ (সূরা ফুরকান-৭৪)।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল