২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সন্তান : পিতা-মাতার প্রতিচ্ছবি

-

আমাদের সন্তানেরা আমাদেরই প্রতিচ্ছবি। বায়োলজিক্যালি তারা আমাদের অনেক বৈশিষ্ট্যই নিজেদের মধ্যে ধারণ করে জন্ম থেকেই। কিন্তু মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার পথ পরিক্রমায় তাদের ব্যক্তিত্বের পুরোটাই তাদের মা-বাবার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আদলে গড়ে ওঠে। আমাদের সচেতন বা অসচেতনভাবে করা বিভিন্ন আচার-আচরণ অবচেতন মনেই তাদের শিশুমনে গভীর ছাপ ফেলে। বাচ্চাদের আমরা যেভাবে মানুষ করতে চাই, যেভাবে দেখতে চাই, আমরা নিজেরা কি তেমন? আমাদের যেসব আচরণ ওরা অনুকরণ করছে, সেগুলোই কি তাদের মাঝে দেখতে চাই? এ প্রশ্নগুলো আমাদের গতানুগতিক প্যারেন্টিংয়ের কৌশল নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখাবে।
একটি মুসলিম শিশু অবশ্যই আর ১০টা শিশুর মতো বেড়ে উঠবে না। তাকে মানুষ করতে পিতা-মাতাকে অনেক বেশি কৌশলী, সচেতন ও ধৈর্যশীল হতে হবে। ভালো ও মন্দের সূক্ষ্ম ফারাক খুব স্পষ্টভাবে তাদের বোঝাতে হবে মা-বাবার নিজেদের জীবনে বাস্তবায়নের মাধ্যমে। কারণ মুসলিম মা-বাবার জন্য সন্তান আল্লাহর নিয়ামত ও আমানত। এ আমানতের সঠিক পরিচর্যার জন্য পিতা-মাতাকে জিজ্ঞাসা করা হবে। হাদিসে বলা হয়েছে : ‘প্রত্যেকে তোমরা অভিভাবকÑ যে যার অধীনস্থদের ব্যাপারে দায়বদ্ধ। একজন শাসক অভিভাবক। একজন পুরুষ তার পরিবারের অভিভাবক। একজন স্ত্রী অভিভাবকÑ স্বামীর ঘর-সংসার আর সন্তানের ব্যাপারে দায়বদ্ধ সে।’ -বুখারি : ২৫৫৪, মুসলিম : ১৮২৯
পিতা-মাতার নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক : পরিবার হলো সন্তানের প্রথম পরিবেশ। এটি শিশুর ব্যক্তিত্বের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। বাবা-মায়ের সম্পর্ক পরিবারের অন্যান্য সম্পর্কের মধ্যে একটি আদর্শ তৈরি করে। যদি পিতা-মাতা একে অপরের সাথে সম্মানজনক, ভালোবাসাপূর্ণ আচরণ করে, একে অপরকে সমীহ করে, একে অপরের যতœ নেয় ও নম্রতা দেখায়, তাহলে এ গুণগুলো সন্তানের ব্যক্তিত্বকে প্রতিফলিত করে। তেমনিভাবে সন্তানের সামনে মা-বাবার নিজেদের মধ্যকার বিরোধ শিশুদের মানসিকতার চরম বিপর্যয় ঘটায়। শিশুরা যদি দেখে মা-বাবা তাদের নাসিহা করার সময় নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ করে তাহলে তারা আমাদের উপদেশ গ্রহণ করবে না। তাই মা-বাবাকে নিয়ম-নীতি বাস্তবায়নে একমত হতে হবে।
পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে সম্পর্ক : পরিবারের অন্য সদস্যরা যেমন : দাদা-দাদি, চাচা-ফুফু, মামা-খালারাসহ পরিবারের অন্যান্য আত্মীয় পরিজনদের সাথে পিতা-মাতার সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ একটি সুন্দর ও সুস্থ পারিবারিক সম্পর্ক তৈরিতে সহায়ক। সন্তানদের কোমল মনে এ আচরণগুলো ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে বৃদ্ধ পিতা-মাতার সাথে করা আমাদের আচরণ পরবর্তীতে তারা আমাদের সাথে কী আচরণ করবে তার ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। তাছাড়া আত্মীয়দের প্রতি মা-বাবা কতখানি আন্তরিক, এটিও তারা অবচেতন মনেই অবলোকন করে। ধনী ও দরিদ্র আত্মীয়দের সাথে মা-বাবার ইনসাফপূর্ণ আচরণ তাদের আদর্শ মানুষ হতে সাহায্য করে।
পিতা-মাতার দ্বীনদারিতা : হাদিসে এসেছে, ‘প্রত্যেক শিশু স্বভাব-ধর্মের ওপর জন্ম নেয়। কিন্তু এরপর তার বাবা-মা তাকে ইহুদি, খ্রিষ্টান বা আগুনপূজারি বানায়, পশুপাখি যেমন জন্মের সময় অবিকৃতভাবে জন্মায় তেমন।’ বুখারি : ১৩৫৮
ঠিক তাই। শিশুদের কচি মনে ঈমান ও ইসলামের বীজ বপনের কাজ পিতা-মাতার মাধ্যমেই হয়। তাই মা-বাবা যদি নিজেদের মধ্যে ইসলামকে পরিপূর্ণরূপে ধারণ করার চেষ্টারত থাকেন, তাহলে আশা করা যায় সন্তানও সে সুশিক্ষার ছত্রছায়ায় পরম যতেœ ঈমানদার হিসেবে বেড়ে উঠবে নিশ্চিতভাবে। অবচেতন মনেই দ্বীনকে তারা ভালোবাসবে। তারা যখন দেখে যে আমরা আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ নেই এ প্রশ্নের ভিত্তিতে আল্লাহ এতে খুশি হবেন তো? তারা যেন বুঝতে পারে যে আল্লাহর অসন্তুষ্টির সাথে সম্পৃক্ত প্রতিটি বিষয়কে আমরা পরিত্যাগ করেছি। এমন হলে তাদের জোর করে কিছুই শিখাতে হবে না। সে নিজে থেকেই আগ্রহী হয়ে উঠবে দ্বীন পালনে। আমরা যদি দ্বীন পালনে গাফিলতি করি, তাহলে সম্ভবত আমাদের এই হুঁশিয়ারি থেকে শিক্ষা নেয়া জরুরি : ‘বিশ্বাসীরা, যে চুল্লির জ্বালানি হবে মানুষ আর পাথর, সেই চুল্লি থেকে নিজেদের ও পরিবার-স্বজনদের বাঁচাও।’ (সূরা তাহরিম : ৬)
পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব হলো তাদের সন্তানদের প্রকৃত ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। সন্তান মানুষ করতে মানসিক পরিশ্রমের সাথে শারীরিক পরিশ্রমও কম হয় না। এখানে ধৈর্য ধরে লেগে থাকতে হয়, বেশ কিছু জিনিস বিসর্জন দিতে হয়। কিন্তু এই দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে সন্তানদের দুই জীবনের সাফল্যের জন্য প্রস্তুত করতে পারাই প্রকৃত সাফল্য পিতা-মাতার : ‘মৃত্যুর পর একজন মানুষের সব কাজের বিনিময় বন্ধ হয়ে যায়, তবে তিনটি ছাড়াÑ সাদাকায়ে জারিয়া, কল্যাণকর জ্ঞান এবং পুণ্যবান সন্তান।’ ( মুসলিম : ১৬৩১)
পিতা-মাতার উত্তম আখলাক : দিনে দিনে আমাদের শিশুরা এমন এক পরিবেশে বেড়ে উঠছে, যেখানে ভদ্রতা বা সম্মান দেখান তাদের কাছে অহেতুক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুরব্বিদের দেখলে সালাম দেয়া, তাদের জন্য জায়গা করে দেয়া, তারা আশপাশে থাকলে নিচুস্বরে কথা বলা ইত্যাদি ব্যাপারগুলো তাদের শেখানো হয় না। এর বড় কারণ হলো আমরা পিতা-মাতারা এ আচরণগুলো মেনে চলি না। একইভাবে অধীনস্থদের সাথে করা আমাদের আচরণও তাদের ব্যক্তিত্বে ছাপ ফেলে। আমরা যদি আমাদের বাসার কাজে সাহায্যকারীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করি, রিকশাওয়ালার সাথে খারাপ ভাষায় কথা বলি, বাসায় ফকির এলে খারাপ মন্তব্য করে তাড়িয়ে দেই, তাহলে এগুলো আমাদের শিশুরা শিখবে। পরবর্তীতে তারাও তাদের জীবনে অন্যদের ঠিক এভাবেই অসম্মান করে যাবে।
আমাদের কথা ও কাজে মিল থাকা খুব জরুরি। যেমন : আপনি বাসায় বসে ফোনে কাউকে বলছেন যে, আপনি বাইরে আছেন। শিশুরা সেটা শুনল এবং মনে মনে এটাকে টেকেন ফর গ্র্যান্টেড করে নিলো যে এমন করাই যায়। আপনার কেয়ারলেসভাবে বলা একটা ছোট মিথ্যা তাদের একদিন বড় মিথ্যা বলতে উৎসাহিত করবে। পিতা-মাতা হওয়াটা একটা অনেক বড় দায়িত্বের নাম। এখানে অবহেলার কোনো সুযোগ নেই।
পোশাক পরিচ্ছদ, আধুনিক প্রযুক্তি, সম্পদ, বিলাসবহুল গাড়ি-বাড়ি কখনো একজন মানুষের মূল্যকে বৃদ্ধি করতে পারে না। কিন্তু একজন মানুষের চরিত্র, কাজকর্ম, নীতি ও মূল্যবোধই তার পরিচয় বহন করে। কৃতকর্ম অনুযায়ী মানুষ তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে, নতুবা ঘৃণার সাথে। তাকে এটা বোঝাতে হবে যে, পৃথিবীতে রেখে যাওয়া সম্পদের জন্য তাকে আল্লাহর কাছে জবাব দিতে হবে, কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যা সে ব্যয় করবে, তার জন্য সে আল্লাহর কাছে পুরস্কৃত হবে। আমাদের এমনভাবে জীবন যাপন করা উচিত যেন অন্যরা আমাদের সম্মান করে, শ্রদ্ধা করে। নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে তাদের এ বিষয়গুলো শেখাতে হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement