২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

অহঙ্কারীরা অন্ধ ও দিকভ্রান্ত

-

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কোনো প্রকার অধিকার ছাড়াই যারা পৃথিবীতে অহঙ্কার করে বেড়ায়, শিগগিরই আমার নিদর্শনসমূহ থেকে আমি তাদের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেবো। তারা আমার কোনো নিদর্শন দেখলেও তার প্রতি ঈমান আনবে না। তাদের সামনে যদি সোজা পথ এসে যায় তাহলেও তারা তা গ্রহণ করবে না। আর যদি বাঁকা পথ দেখতে পায় তাহলে তার ওপর চলতে শুরু করবে’ (সূরা আরাফ-১৪৬)।
অহঙ্কারী মনে করে তার ওপর জোর খাটানোর কেউ নেই। অথচ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘সে মনে করে রেখেছে, তার ওপর জোর খাটাতে পারবে না’ (সূরা আল বালাদ-৫)। অর্থাৎ প্রত্যেকটি মানুষ আল্লাহর ঘেরাওয়ের মধ্যে অবস্থান করে। শুধু অহঙ্কারীরা মনে করে সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। দুনিয়ায় সে যা ইচ্ছা করে যাবে, তাকে পাকড়াও করার ও তার মাথা নিচু করার মতো কোনো উচ্চতর কর্তৃপক্ষ নেই। অথচ আখিরাত আসার আগে এই দুনিয়াতেই সে প্রতি মুহূর্তে দেখছে, তার তাকদিরের ওপর অন্য একজনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। তার সিদ্ধান্তের সামনে তার নিজের সব জারিজুরি, কলাকৌশল পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। ভূমিকম্পের একটি ধাক্কা, ঘূর্ণিঝড়ের একটি আঘাত এবং নদী-সাগরের একটি জলোচ্ছ্বাস তাকে এ কথা বলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট যে, আল্লাহর শক্তির তুলনায় সে কতটুকু ক্ষমতা রাখে। একটি আকস্মিক দুর্ঘটনা একজন সুস্থ সবল সক্ষম মানুষকে মুহূর্তের মধ্যে পঙ্গু করে দিয়ে যায়। ভাগ্যের একটি পরিবর্তন একটি প্রবল পরাক্রান্ত বিপুল ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী ব্যক্তিকে আকাশ থেকে পাতালে নিক্ষেপ করে। উন্নতির উচ্চতর শিখরে অবস্থানকারী জাতিদের ভাগ্য যখন পরিবর্তিত হয় তখন এই দুনিয়ায় যেখানে তাদের চোখে চোখ মেলানোর হিম্মত কারো ছিল না সেখানে তারা লাঞ্ছিত ও পদদলিত হয়। এসব মানুষের মাথায় কেমন করে এ কথা স্থান পেল যে, তার ওপর জোর খাটবে না।
এরা কি জানে না, প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী অপ্রতিদ্বন্দ্বী নমরুদ জুতার বাড়ি খেতে খেতে তার দুনিয়ার লীলা সাঙ্গ হয়েছিল। তারা কি এ-ও জানে না যে, সেই ল্যাঙড়া মশা আছে এবং মশার মালিকও আছেন। এটা সময়ের কোনো না কোনো নমরুদের নাকের পথ ধরে কখন যে তাদের মস্তিষ্কে ঢুকে পড়ে এবং তাদের অহমিকাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। মূসা আ: বনাম ফিরাউনের সেই নীল নদ এখনো আছে, পৃথিবীর দেশে দেশে আরো কত শত নীল নদ-নদী-সাগর রয়েছে আধুনিককালের ফিরাউনদের জন্য। কিভাবে কখন যে কার সলিল সমাধি ঘটে কেউ জানে না। করোনাভাইরাস আধুনিককালের নমরুদ ও ফিরাউনদের ভ্রষ্টনীতি ও বিভ্রান্তিমূলক সিদ্ধান্তের কুফল হতে পারে। আল্লাহই ভালো জানেন। তবে পৃথিবীর ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর ইতিহাস এ কথার সাক্ষী দেয় যে, জুলুম ও ক্ষমতার গর্বই ছিল তাদের ধ্বংসের মূল কারণ।
গর্ব-অহঙ্কার মূলত শয়তানের বৈশিষ্ট্য। সূরা বাকারায় আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি ফেরেশতাদের বলেছিলামÑ আদমকে সেজদা করো। সবাই সেজদা করল কেবল ইবলিশ করল না। সে অস্বীকার ও অহঙ্কার করল। সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।’ সূরা আরাফে বলা হয়েছেÑ ইবলিশ বলল ‘আমি তার চেয়ে উত্তম, আপনি আমাকে আগুন থেকে এবং তাকে (আদমকে) মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন।’ অর্থাৎ তার মধ্যে অহঙ্কার ও বিদ্বেষ দানা বেঁধে উঠেছিল। ফলে সেই পৃথিবীর প্রথম নিকৃষ্ট কীট, যে আল্লাহর আদেশকে অমান্য করল এবং তাঁর লানত নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত তাকে বেঁচে থাকতে হবে। যুগে যুগে এ তাগুতের অনুসারীরাই অহঙ্কারী ছিল। আল কুরআনে বর্ণিত বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ধ্বংসের কারণগুলোর মধ্যে অহঙ্কার একটি অন্যতম কারণ ছিল। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কত জনপদ আমি ধ্বংস করে দিয়েছি। তাদের ওপর আমার আজাব অকস্মাত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রাতের বেলায় অথবা দিনের বেলা যখন তারা বিশ্রামরত ছিল। আর যখন আমার আজাব তাদের ওপর আপতিত হয়েছিল তখন তাদের মুখে এ ছাড়া আর কোনো কথাই ছিল না যে, সত্যিই আমরা জালেম ছিলাম’ (সূরা আল আরাফ : ৪-৫)।
আল কুরআনের অসংখ্য আয়াতে গর্ব-অহঙ্কারের ভয়াবহ পরিণাম ও পরিণতির কথা বিবৃত হয়েছে এবং অত্যন্ত কঠিন ভাষায় হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। ইমাম আজজাহাবি রহ: তার ‘কিতাবুল কাবায়ির’-এ এটিকে কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অহঙ্কার শুধু একটি কবিরা গুনাহই নয় বরং এটি আরো অনেক কবিরা গুনাহের জন্মদাতা। কারণ এটি মানুষকে সত্য উপলব্ধিতে বাধা দেয় এবং তাদেরকে অন্ধকারের যাত্রী বানায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এক ইলাহই তোমাদের আল্লাহ। কিন্তু যারা আখিরাত মানে না তাদের অন্তর সত্যবিমুখ এবং তারা অহঙ্কারে ডুবে গেছে’ (সূরা নাহল-২২)।
অহঙ্কার মানে নিজেকে আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করা, অন্যদেরকে নিজের তুলনা ক্ষুদ্র ও অধম জ্ঞানকরত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে তাঁর অবাধ্য হওয়া ও আদেশ অমান্য করাÑ এ সবই অহঙ্কারের লক্ষণ ও তার আওতাভুক্ত (কবিরা গুনাহ-ইমাম আজজাহাবি রহ:)। অহঙ্কার গোপন ও প্রকাশ্য দুই ধরনের হয়ে থাকে। গোপন অহঙ্কার মনের মধ্যে সৃষ্টি হয় আর প্রকাশ্য অহঙ্কার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে প্রকাশ পায়। গোপন অহঙ্কারী নিজেকে অন্য সব অহঙ্কারীর চেয়েও নিজেকে বড় মনে করে। এটা তার ধারণায় বদ্ধমূল হয়, অবশেষে এটি তার বিশ্বাসে পরিণত হয়। ফলে নিজেকে খুব সম্মানিত মনে করে এবং একসময় তা তার বাস্তব চরিত্রে প্রকাশ পেতে শুরু করে। গোপন অহঙ্কার সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, তাদের কাছে আসা যুক্তি-প্রমাণ ছাড়া
আল্লাহর নিদর্শনসমূহের ব্যাপারে ঝগড়া করছে তাদের অন্তর অহঙ্কারে ভরা। কিন্তু তারা যে বড়ত্বের অহঙ্কার করে তারা তার ধারেও ঘেঁষতে পারবে না’ (সূরা মুমিন-৫৬)। এদের শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এভাবে আল্লাহ প্রত্যেক অহঙ্কারী ও স্বেচ্ছাচারীর অন্তরে মোহর লাগিয়ে দেন’ (সূরা মুমিন-৩৫)। প্রকাশ্য অহঙ্কারের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অহঙ্কারবশত তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং জমিনে গর্বসহকারে পদচারণা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো অহঙ্কারীকেই পছন্দ করেন না। চাল-চলনে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করো এবং কণ্ঠস্বর নিচু করো’ (সূরা লোকমান : ১৮-১৯)। ‘পৃথিবীতে দাম্ভিকতাসহকারে চলো না। নিশ্চয়ই তুমি পদাঘাতে ভূপৃষ্ঠ বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না। এসবের মধ্যে যেগুলো মন্দকাজ, সেগুলো তোমার রবের কাছে অপছন্দনীয়’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৩৭-৩৮)।
লেখক : ম্যানেজার, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, জিন্দাবাজার শাখা, সিলেট

 


আরো সংবাদ



premium cement