২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

উসমান রা:-এর শাহাদাত ও মতভেদের সূচনা

-

ইসলামের ইতিহাস শাহাদাতের গৌরবে গৌরবান্বিত। বদর, উহুদ, খন্দক ইত্যাদি যুদ্ধে শাহাদাতবরণ করেছেন অগণিত সাহাবায়ে কেরাম। শহীদ হয়েছেন চার খলিফার তিন খলিফা- হজরত উমর ফারুক রা:, উসমানগনি রা:, হজরত আলী রা:। শহীদ হয়েছেন হজরত হাসান রা:। জঙ্গে জামাল ও জঙ্গে সিফফিনে শহীদ হয়েছেন অসংখ্য সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ি। কারবালায় শহীদ হয়েছেন মহানবী সা:-এর নাতি ইমাম হোসাইন রা:সহ তার পরিবারের ৭২ জন সদস্য। হজরত উসমান রা:-এর শহাদাত ইসলামের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা। তার শাহাদাতের ফলে মুসলমানদের মধ্যে মতভেদ ও অনৈক্যের সূচনা হয়। মুসলমান নানা দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
হজরত উসমান রা: বিদ্রোহীদের কর্তৃক বিশুদ্ধ মতে ৪০ দিন অবরুদ্ধ ছিলেন। তখন তিনি একাধিক বক্তব্য দিয়েছেন। ১. তিনি তার একদিনের বক্তব্যে বলেছেন- আমি ইসলামে চারজনের মধ্যে চতুর্থ ব্যক্তি। রাসূলুল্লাহ সা: আমার কাছে তার মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। তিনি মৃত্যুবরণ করলে তার অপর মেয়ে বিয়ে দেন। জাহিলি যুগেও আমি ব্যভিচারে লিপ্ত হইনি, চুরিও করিনি, ইসলামী যুগেও নয়। ইসলাম গ্রহণ করার পর আমি কাউকে কষ্ট দেইনি, কোনো লোভ-লালসা করিনি। রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে বাইয়াত করার পর ডান হাত দিয়ে আমি লজ্জাস্থান স্পর্শ করিনি। ইসলাম গ্রহণ করার পর প্রত্যেক জুমার দিন একজন দাস মুক্ত করতাম। কোনো জুমার দিন তা না পারলে পরবর্তী জুমার দিন দুইজন দাস মুক্ত করতাম। ২. তিনি আরেক দিন তার বক্তব্যে বলেছেন- কোন কারণে তোমরা আমাকে হত্যা করতে চাচ্ছ? আমি রাসূলূল্লাহ সা:কে বলতে শুনেছি, তিনটি কারণের মধ্যে কোনো একটি কারণ ব্যতীত কোনো মুসলমানের রক্ত হালাল নয়। বিয়ে করার পর ব্যভিচারে প্রবৃত্ত হলে তাকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হবে। ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে হত্যা করার পর তাকে হত্যা করা হবে। কেউ ইসলাম গ্রহণ করার পর মুরতাদ হয়ে গেলে তাকে হত্যা করা হবে। আল্লাহর কসম করে বলছি। আমি জাহেলি বা ইসলামী কোনো যুগেই ব্যভিচারে লিপ্ত হইনি, কাউকে হত্যা করিনি যে, তার বদলে আমাকে হত্যা করা হবে, আর ইসলাম গ্রহণ করার পর আমি মুরতাদও হইনি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং হজরত মুহাম্মদ সা: আল্লাহর বান্দা ও রাসূল (মুসনাদে আহমদ, তিরমিজি, নাসায়ি, ইবনে মাজাহ, দারেমি, মিশকাত হাদিস নং-৩৪৬৬); ৩. অপর এক দিনের বক্তব্যে তিনি বলেছেন, আল্লাহর নাম নিয়ে আমি তোমাদেরকে বলছি, তোমরা জানো যে, রাসূলুল্লাহ সা: যখন মদিনায় আগমন করেন তখন মসজিদে মুসল্লিদের স্থান সঙ্কুুলান হতো না। তখন রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, নিজের নির্ভেজাল সম্পদ দ্বারা কে এ ভূমিখণ্ড ক্রয় করবে এবং এতে সেও অন্যান্য মুসলমানের মতো অংশীদার হবে এবং জান্নাতে এর চেয়ে উত্তম ভূমি লাভ করবে? তখন আমি আমার নির্ভেজাল মাল দ্বারা তা ক্রয় করি এবং তা মুসলমানের জন্য দান করে দেই। আজ সে মসজিদে দুই রাকাত সালাত আদায় করতে তোমরা আমাকে বাধা দিচ্ছ। তারপর তিনি বলেন, রাসূল সা:-এর মদিনায় আগমনের পর সেখানে বিরে রুমা ব্যতীত সুপেয় পানির কোনো কূপ ছিল না। আমি রাসূলুল্লাহ সা:-এর নির্দেশে আমার হালাল অর্থ দিয়ে তা ক্রয় করে মুসলমানদের পানি পানের ব্যবস্থা করেছি, এখন তোমরা আমাকে এ কূপের পানি পান করতে দিচ্ছ না। তিনি আরো বলেন, তোমরা কি জানো না যে, আমি সঙ্কটকালীন তাবুক যুদ্ধের সৈন্যবাহিনীর সাজসরঞ্জাম এমনকি ঘোড়া বাঁধার রশিও প্রদান করেছি (তিরমিজি)।
ওসমান (রা:)-এর শাহাদাতের তারিখ প্রসঙ্গে মতভেদ রয়েছে। ঐতিহাসিক ওয়াকিদি আবদুর রহমান ইবনে আবুযযিনাদ সূত্রে আবদুর রহমান ইবনে হারিসের বরাতে বলেন, উসমান রা:-এর হত্যাকারী হলো কিনান ইবনে বিশর ইবনে ইতাবতুজিবি। সেই দিনটি ছিল ৩ জিলহজ জুমাবার। কারো মতে তা ছিল আইয়ামে তাশরিক, কারো মতে ইয়াওমুন নাহার তথা কোরবানির দিন। কারো মতে, ৩৫ হিজরির ১৮ জিলহজ শুক্রবার, কারো মতে ৩৬ হিজরিতে তিনি রোজা অবস্থায় শাহাদাতবরণ করেন। তখন তার বয়স ছিল মতান্তরে ৬৩, ৭৫, ৮২, ৮৪, ৯০ বছর। তার খিলাফতকাল ছিল ১২ দিন কম ১২ বছর।
ইসলামে মতভেদের সূচনা : হজরত আমাশ বলেন, ইসলামে প্রথম ফিতনা হলো উসমান রা:-এর হত্যা। আর শেষ ফিতনা হলো দাজ্জালের আবির্ভাব। উসমান রা:-এর শাহাদাতের পর মুসলমানদের মধ্যে মতভেদ ও বিভাজনের সূচনা হয়। হজরত ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তোমরা এমন একটা ফিতনার মুখোমুখি হবে, সে দিন ফিতনায় এই ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিহত হবে।’ ইবনে উমর রা: বলেন, আমি তাকিয়ে দেখি যে, তিনি হলেন উসমান ইবনে আফফান রা:। মহানবী সা: বলেছেন, ‘তোমাদের কী অবস্থা হবে যখন তোমাদের দু’টি বিশাল দলের সঙ্ঘাতের সম্মুখীন হবে? তখন হজরত আবুবকর রা: বলেন, যে উম্মতের স্র্রষ্টা এক ও নবী এক, তাদের মধ্যে কী এমন অবস্থা হবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আবুবকর রা: বললেন, আমি কি সে যুগ পাবো হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, না। হজরত ওমর রা: বললেন, তবে আমি কি তা দেখতে পাবো? তিনি বললেন, না। উসমান রা: বললেন, তবে আমি কি তা পাবো? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তোমাকে উপলক্ষ করেই তারা সঙ্ঘাত-সঙ্কটে আক্রান্ত হবে। রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেছেন, ‘বনু উমাইয়ার এক ব্যক্তি নিহত হওয়ার সময় ইসলামের চাকা ঘুরে যাবে। এখানে এক ব্যক্তি দ্বারা ওসমান রা: উদ্দেশ্য (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, চতুর্থ খণ্ড)। তার শাহাদাতের পর হজরত আলী রা: ও হজরত মুয়াবিয়া রা:-এর মধ্যে জঙ্গে জামাল ও জঙ্গে সিফফিন নামে দু’টি বিরাট যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তাতে শহীদ হন অগণিত সাহাবি ও তাবেয়ি। নিজেদের মধ্যে মতভেদের ফলে মুসলমানদের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। আর এর ফলে অনেক রাজ্য তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়।
লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী।


আরো সংবাদ



premium cement