২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

শাওয়াল ও জিলকদ নিয়ে কিছু জাল হাদিস

-

সহিহ হাদিসের আলোকে শাওয়াল মাস : শাওয়াল মাস হজের মাসগুলোর প্রথম মাস। এই মাস থেকে হজের কার্যক্রম শুরু হয়। এ ছাড়া সহিহ হাদিস দ্বারা এই মাসের একটি ফজিলত প্রমাণিত। রাসূলুল্লাহ সা: এরশাদ করেছেন: ‘যে ব্যক্তি রামাদান মাসের সিয়াম পালন করবে। এরপর সে শাওয়াল মাসে ছয়টি সিয়াম পালন করবে, তার সারা বছর সিয়াম পালনের মতো হবে।’ কোনো কোনো যয়িফ হাদিসে পুরো শাওয়াল মাস সিয়াম পালনের উৎসাহ দেয়া হয়েছে। একটি যয়িফ হাদিসে বলা হয়েছে : ‘যে ব্যক্তি রামাদান এবং শাওয়াল মাস এবং (সপ্তাহে) বুধবার ও বৃহস্পতিবার সিয়াম পালন করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’
এ ছাড়া শাওয়াল মাসের আর কোনো ফজিলত প্রমাণিত নয়। মুমিন এ মাসে তার তাহাজ্জুদ, চাশ্ত, জিক্র ওজিফা ইত্যাদি সাধারণ ইবাদত নিয়মিত পালন করবেন। সাপ্তাহিক ও মাসিক নফল সিয়াম নিয়মিত পালন করবেন। অতিরিক্ত এই ছয়টি সিয়াম পালন করবেন। এ ছাড়া এই মাসের জন্য বিশেষ সালাত, সিয়াম, জিকর, দোয়া, দান বা অন্য কোনো নেক আমল অথবা এই মাসে কোনো নেক আমল করলে বিশেষ সওয়াবের বিষয়ে যা কিছু প্রচলিত বা কথিত সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা। এগুলোর অনেক কথা সাধারণভাবে শাওয়াল মাসের ফজিলত ও ছয় রোজার বিষয়ে বানানো হয়েছে। আর কিছু কথা শাওয়াল মাসের প্রথম দিন বা ঈদুল ফিতরের দিনের বিশেষ নামাজ বা আমলের বিষয়ে বানানো হয়েছে।
রোজা ও অন্যান্য ফজিলত বিষয়ক বানোয়াট কথার মধ্যে রয়েছে : হাদিস শরিফে আছে, রাসূলুল্লাহ সা: ফরমাইয়াছেন : যেই ব্যক্তি শাওয়াল মাসে নিজেকে গুনাহের কার্য হইতে বিরত রাখিতে সক্ষম হইবে আল্ল­াহ তায়ালা তাহাকে বেহেশতের মধ্যে মনোরম বালাখানা দান করিবেন। অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হইয়াছে, হজরত রাসূলল্ল­াহ সা: এরশাদ করিয়াছেন, যেই ব্যক্তি শাওয়াল মাসের প্রথম রাতে বা দিনে দুই রাকয়াতের নিয়তে চার রাকয়াত নামাজ আদায় করিবে এবং উহার প্রতি রাকয়াতে সূরা ফাতিহার পর ২১ বার করিয়া সূরা ইখলাছ পাঠ করিবে; করুণাময় আল্লাহ তায়ালা তাহার জন্য জাহান্নামের সাতটি দরজা বন্ধ করিয়া দিবেন এবং জান্নাতের আটটি দরজা উন্মুক্ত করিয়া দিবেন। আর মৃত্যুর পূর্বে সে তাহার বেহেশতের নির্দিষ্ট স্থান দর্শন করিয়া লইবে।... অন্য আর এক হাদিসে বর্ণিত আছে, হজরত রাসূলল্লাহ সা: ফরমাইয়াছেন, যে ব্যক্তি শাওয়াল মাসে মৃত্যুবরণ করিবে সে ব্যক্তি শহীদানের মর্যাদায় ভূষিত হইবে।...
এগুলো সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা হাদিসের নামে বলা হয়েছে।
শাওয়াল মাসে ছয়টি সিয়ামের ফজিলত সহিহ হাদিসের আলোকে আমরা জেনেছি। এ বিষয়ে অতিরঞ্জিত অনেক জাল কথাও প্রচলন করা হয়েছে। যেমন : ‘হজরত রাসূলুল্লাহ সা: ফরমাইয়াছেন, যেই ব্যক্তি শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখিবে, আল্লাহ তায়ালা তাহাকে শাস্তির শৃঙ্খল ও কঠোর জিঞ্জিরের আবেষ্টনী হইতে নাজাত দিবেন। অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হইয়াছে, হজরত রাসূলুল্লাহ সা: ফরমাইয়াছেন, যেই ব্যক্তি শাউয়াল মাসের ছয়টি রোজা রাখিবে, তাহার আমলনামায় প্রত্যেক রোজার পরিবর্তে সহস্র রোজার সাওয়াব লিখা হইবে।... রাসূল সা: বলেছেন, ...যে ব্যক্তি শাওয়াল মাসে রোজা রাখেন আল্লাহ পাক তার জন্য দোজখের আগুন হারাম করে দেন।... যে ব্যক্তি শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখে, আল্ল­াহ তায়ালা তার আমলনামায় সব মুহাম্মদী নেককার লোকের সওয়াব লিখেন এবং সে হজরত সিদ্দিক আকবার রা:-এর সঙ্গে বেহেশতে স্থান পাবে।... যে ব্যক্তি শাওয়াল মাসে রোজা রাখে আল্ল­াহ তায়ালা তাকে লাল-ইয়াকুত পাথরের বাড়ি দান করবেন এবং প্রত্যেক বাড়ির সামনে দুধ ও মধুর নহর প্রবাহিত হতে থাকবে। ফেরেশতারা তাকে আসমান থেকে ডেকে বলবেন, হে আল্ল­াহর খাস বান্দা, আল্লাহ তোমাকে মাফ করে দিয়েছেন। শাওয়াল মাসে লূত আ:-এর কওম ধ্বংস হয়েছিল, নূহ আ:-এর কওম ডুবেছিল, হুদ আ:-এর কওম ধ্বংস হয়েছিল।....
ইত্যাদি অসংখ্য মিথ্যা কথা দুঃসাহসের সাথে নিঃসঙ্কোচে রাসূলুল্ল­াহ সা:-এর নামে বলা হয়েছে। আমাদের সম্মানিত লেখকগণ একটুও চিন্তা ও যাচাই না করেই সেগুলো তাদের পুস্তকে লিখেন। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।
শাওয়ালের প্রথম তারিখ ঈদুল ফিতর। একাধিক যয়িফ হাদিসে ঈদুল ফিতরের রাত ইবাদতে জাগ্রত থাকতে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু ইবাদতের কোনো নির্ধারিত পদ্ধতি, রাকাত, সূরা ইত্যাদি বলা হয়নি।
ঈদের দিনে সালাতুল ঈদ ছাড়া অন্য কোনো বিশেষ নফল সালাতের কোনো নির্দেশনা কোনো সহিহ হাদিসে নেই। তবে জালিয়াতগণ এ বিষয়ে কিছু হাদিস রচনা করেছে। শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখের দিনের বা রাতের ৪ রাকাত সালাত বিষয়ক একটি জাল হাদিস আগে উল্লে­খ করা হয়েছে। এ বিষয়ক আরো একটি প্রচলিত জাল হাদিস উল্লেখ করছি : যিনি আমাকে নবীরূপে প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ, জিবরাঈল আমাকে ঈসরাফিলের মাধ্যমে আল্লাহর কাছ থেকে বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈদুল ফিতরের রাত্রে ১০০ রাকাত সালাত আদায় করবে, প্রত্যেক রাকাতে এক বার সূরা ফাতিহা এবং ১১ বার সূরা ইখলাস পাঠ করবে, এরপর রুকুতে এবং সাজদায় ... অমুক দোয়া ১০ বার পাঠ করবে, এরপর সালাত শেষে ১০০ বার ইসতিগফার পাঠ করবে। এরপর সাজদায় গিয়ে বলবে....। যদি কেউ এরূপ করে তাহলে সাজদা থেকে ওঠার আগেই তার পাপ ক্ষমা করা হবে, রামাদানের সিয়াম কবুল করা হবে.... ইত্যাদি ইত্যাদি। (কথাগুলো সবই হাদিসের নামে জালিয়াতি)।
জিলকদ মাস : জিলকদ বা যুলকাদা মাসের সাধারণ দুটি মর্যাদা রয়েছে : প্রথমত, তা চারটি হারাম মাসের একটি। দ্বিতীয়ত, তা হজের মাসগুলোর দ্বিতীয় মাস। এ ছাড়া এই মাসের বিশেষ কোনো ফজিলত হাদিসে বর্ণিত হয়নি। তবে জালিয়াতগণ এ বিষয়ে কিছু মিথ্যা ও বানোয়াট কথা প্রচার করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে : ফরমান, তোমরা জিলকদ মাসকে সম্মান করিবে, যেহেতু ইহা মর্যাদাবান মাসসমূহের মধ্যে প্রথম মাস। ... ‘রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, যেই ব্যক্তি জিলকদ মাসের ভিতরে একদিন রোজা রাখিবে, আল্লাহ তায়ালা এর প্রতি ঘণ্টার পরিবর্তে একটি হজের সওয়াব তাহাকে দান করিবেন।... যেই ব্যক্তি এই মাসের যে কোনো জুমার দিবসে দুই দুই রাকাতের নিয়তে চার রাকাত নামাজ আদায় করিবে, যাহার প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পরে ১০ বার করিয়া সূরা ইখলাছ পাঠ করিবে, আল্লাহ তায়ালা তাহাকে একটি হজ ও একটি ওমরাহর সওয়াব দান করিবেন। ... যেই ব্যক্তি জিলকদ মাসের প্রত্যেক রজনীতে দুই রাকাত করিয়া নামাজ আদায় করিবে এবং ইহার প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ইখলাছ তিনবার করিয়া পাঠ করিবে, আল্লাহ তায়ালা সেই ব্যক্তির আমলনামায় একজন হাজী ও একজন শহীদের পুণ্যের তুল্য সওয়াব দান করিবেন এবং রোজ কেয়ামতে সেই ব্যক্তি আল্লাহর আরশের ছায়ায় স্থান লাভ করিবে।...’ ‘... এই মাসের রোজাদারের প্রত্যেক নিঃশ্বাসে একটি গোলাম আজাদ করিবার সওয়াব প্রদান করেন। ... এই মাসকে গণিমত মনে করবে। যেহেতু যে ব্যক্তি এই মাসে একদিন ইবাদত করে উহা হাজার বৎসর হতেও উৎকৃষ্ট। ... জিলকদ মাসের সোমবারের রোজা হাজার বছরের ইবাদত হতেও উৎকৃষ্ট। ... এই চাঁদে যে একদিন রোজা রাখবে, আল্লাহ পাক তার জন্য প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে একেকটি মকবুল হজের সওয়াব দান করবেন। ... ইত্যাদি ইত্যাদি....।’
উল্লিখিত কথাগুলো সবই দুঃসাহসিক নির্লজ্জ জালিয়াতগণের কথা, যা তারা রাসূলুল্লাহ সা:-এর নামে বানিয়ে প্রচার করেছে এবং জাহান্নামে নিজেদের আবাসস্থল তৈরি করেছে। দুঃখজনক হলো, অনেক আলিম বা লেখক যাচাই বাছাই না করেই এই সব আজগুবি মিথ্যা কথাকে রাসূলুল্লাহ সা:-এর হাদিস বলে উল্লেখ করছেন। অন্তত কোন গ্রন্থে হাদিসটি সঙ্কলিত তা যাচাই করলেও এগুলোর জালিয়াতি ধরা পড়ে যেত। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমীন।
সূত্র : ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহ:-এর বই, হাদিসের নামে জালিয়াতি : প্রচলিত মিথ্যা হাদিস ও ভিত্তিহীন কথা


আরো সংবাদ



premium cement