২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

খাদ্য পোশাক ও তাকওয়া

-

‘হে বনি আদম! প্রত্যেকে সালাতের সময় তোমরা সুন্দর পোশাক গ্রহণ করো। আর খাও এবং পান করো কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা আরাফ-৩১)
জিনাত বা সাজসজ্জা শব্দের মাধ্যমে বুঝানো হয়েছে যে, সালাতে শুধু সতর ছাড়াও সামর্থ্য অনুযায়ী সাজসজ্জার পোশাক পরিধান উত্তম। যেমন সাদা পোশাক পরিধান করা, হাদিসে এসেছে, ‘তোমাদের পোশাকাদির মধ্যে সাদা পোশাক পরিধান করো। কেননা, পোশাকাদির মধ্যে সেটাই উত্তম পোশাক। আর এতে তোমাদের মৃতদেরকে কাফনও দাও।’ (তিরমিজি-৯৯৪)
সাজসজ্জার পোশাক মানেই অহঙ্কারের চিহ্ন নয়। রাসূল সা: বলেন, ‘যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহঙ্কার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এক লোক বলল, যেকোনো লোক পছন্দ করে তার পোশাক উত্তম হোক, তার জুতা সুন্দর হোক। রাসূল সা: বলেন, অবশ্যই আল্লাহ সুন্দর, সুন্দরকে ভালোবাসেন। অহঙ্কার হলো- হককে না মানা, মানুষকে অবজ্ঞা করা।’ (মুসলিম-১৪৭) কিন্তু অহঙ্কারের বসে কেউ এমন পোশাক পরবে না যা ইসলামের বিপরীতে যায়। যেমন- পুরুষের টাখনুর নিচে কাপড় পরা। হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহ সে লোকের দিকে (দয়ার দৃষ্টিতে) দেখবেন না, যে অহঙ্কারের সাথে তার (পরিধেয়) পোশাক টেনে চলে।’ (বুখারি-৫৭৮৩) আবার বলা হয়েছে, ‘অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই’। (সূরা ইসরা-২৭) ‘আল্লাহ তাদেরকে পছন্দ করেন যারা ব্যয় করার ক্ষেত্রে মধ্যবর্তিতা অবলম্বন করে, প্রয়োজনের চাইতে বেশি ব্যয় করে না এবং কমও করে না।’ (সূরা ফুরকান-৬৭) এই মধ্যমপন্থা জীবনের চলা ফেরায় প্রতিটি কাজেই অবলম্বন করতে বলা হয়েছে।
রাসূল সা: বলেছেন, ‘সীমা লঙ্ঘন ও অহঙ্কার না করে খাও, দান করো এবং পরিধান করো।’ (ইবনে মাজাহ-৩৬০৫) কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘হে বনি আদম! আমি তোমাদের জন্য পোশাক অবতীর্ণ করেছি যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং অবতীর্ণ করেছি সাজসজ্জার বস্ত্র এবং তাকওয়ার পোশাক, এটি সর্বোত্তম। এটি আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন যাতে তারা চিন্তাভাবনা করে।’ (সূরা আরাফ-২৬)।
আবৃত করা এর অর্থ মানুষের ওইসব অঙ্গ, যেগুলো খোলা রাখাকে মানুষ স্বভাবতই খারাপ ও লজ্জাকর মনে করে। সাজসজ্জার জন্য মানুষ যে পোশাক পরিধান করে। ঈমানের পর সর্বপ্রথম ফরজ গুপ্তাঙ্গ আবৃত করা। শয়তান মানুষের এ দুর্বলতা আঁচ করে সর্বপ্রথম হামলা গুপ্তাঙ্গ আচ্ছাদনের ওপর করেছে। তাই মানুষের সর্বপ্রকার মঙ্গল বিধানকারী শরিয়তে গুপ্তাঙ্গ আচ্ছাদনের প্রতি এত গুরুত্বারোপ করছে যে, ঈমানের পর সর্বপ্রথম ফরজ গুপ্তাঙ্গ আবৃত করাকেই স্থির করেছে। সালাত, সাওম ইত্যাদি সবই এরপর।
গুপ্তাঙ্গ আবৃতকরণ এবং আরাম ও সাজসজ্জার জন্য দু’প্রকার পোশাক বর্ণনা করার পর কুরআনে তৃতীয় এক প্রকার পোশাকের কথা বলে যা হচ্ছে তাকওয়ার পোশাক। এটি সর্বোত্তম পোশাক। বাহ্যিক পোশাক যেমন মানুষের গুপ্তাঙ্গের জন্য আবরণ এবং শীত-গ্রীষ্ম থেকে আত্মরক্ষা ও সাজসজ্জার উপায় হয়, তেমনি সৎকর্ম ও আল্লাহভীতিও একটি আধ্যাত্মিক পোশাক। এটি মানুষের চারিত্রিক দোষ ও দুর্বলতার আবরণ এবং স্থায়ী কষ্ট ও বিপদাপদ থেকে মুক্তিলাভের উপায়। এ কারণেই এটি সর্বোত্তম পোশাক।
এই তাফসিরের আলোকে কিছু নির্দেশনা পাওয়া যায়, প্রয়োজনের পরিমাণ পানাহার করা ফরজ, শরিয়তের ভিত্তিতে যা কিছু হারাম হয়েছে তা ছাড়া বাকি সবকিছুই হালাল, আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর নির্দেশে যা কিছু নিষিদ্ধ তা ব্যবহার করা অবৈধ, আল্লাহ যা কিছু হালাল করেছেন তা হারাম মনে করা মহাপাপ, প্রয়োজনের পরেও অতিরিক্ত খাওয়া ঠিক নয় এবং প্রয়োজনের চেয়েও কম খেয়ে ইবাদতের বিঘ্ন ঘটানোও অবৈধ। (ফাতহুল কাদির)
পোশাকের পরে এসেছে খাবারের কথা। আল্লাহ পৃথিবীতে সব খাদ্য হালাল ও বৈধ করেছেন যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো বিশেষ খাবার হারাম ঘোষণা করা হয়নি। তা হারাম করার কোনো অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি।
‘বলো, আল্লাহ স্বীয় দাসদের জন্য যে সব সুশোভন বস্তু ও পবিত্র জীবিকা সৃষ্টি করেছেন, তা কে নিষিদ্ধ করেছে? বলো, পার্থিব জীবনে বিশেষ করে কিয়ামতের দিনে এ সমস্ত তাদের জন্য, যারা বিশ্বাস করে। এ রূপে আমি জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করি।’ (সূরা আরাফ-৩২)।
মুশরিকরা যেভাবে তাওয়াফ করার সময় পোশাক পরিধান করাকে অপছন্দনীয় মনে করেছিল, অনুরূপ কিছু হালাল জিনিসকেও আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে হারাম করে নিয়েছিল। আর অনেক হালাল জিনিসকে নিজেদের প্রতিমাদের নামে উৎসর্গ করার কারণে সেগুলোকেও হারাম মনে করত। মহান আল্লাহ বললেন, ‘মানুষের সাজসজ্জার জন্য (যেমন- পোশাক ইত্যাদি) এবং পানাহারে মানুষের হারাম করে নেয়ার কারণে আল্লাহর হালাল করা জিনিস হারাম হয়ে যাবে না। বরং সেগুলো হালালই থাকবে। এই হালাল ও পবিত্র জিনিসগুলো আসলে আল্লাহ ঈমানদারদের জন্য সৃষ্টি করেছেন, যদিও কাফেররাও তা থেকে উপকারিতা এবং তৃপ্তি লাভ করে থাকে। বরং অনেক সময় পার্থিব সম্পদ এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করার ব্যাপারে তাদেরকে মুসলিমদের চেয়েও বেশি সফল দেখা যায়। তবে তা অপরের ওসিলায় এবং সাময়িকভাবে। এতে আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টিগত ইচ্ছা ও হিকমতও আছে।’
কিয়ামতের দিন এ নিয়ামতসমূহ কেবল ঈমানদারদের জন্য হবে। কেননা, কাফেরদের ওপর যেভাবে জান্নাত হারাম হবে, অনুরূপভাবে জান্নাতের যাবতীয় খাদ্য-পানীয় তাদের জন্য হারাম হবে। পার্থিব সব নিয়ামতের সাথে পরিশ্রম, হস্তচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা ও দুঃখ-কষ্ট থাকলেও পরকালের অর্জন হবে নির্ভেজাল।
লেখিকা : ইসলামী গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement