২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রজনী!

-

লাইলাতুল এটি আরবি শব্দ। অর্থ হলো রাত। কদর শব্দটি ও আরবি। অর্থ হলো মর্যাদা, মহামান্বিত। লাইলাতুল কদর অর্থ হলো মহামান্বিত রজনী বা রাত।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন, ‘আমি একে নাজিল করেছি শবেকদরে। শবেকদর সম্পর্কে আপনি কি জানেন? শবেকদর হলো এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে। এটি নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে (সূরা আল কদর : ১-৫)।
কদর নামকরণের কারণ : যেহেতু এ রজনী অত্যন্ত মহিমান্বিত ও সম্মানিত তাই এ রজনীকে লাইলাতুল কদর বলা হয়ে থাকে। আবার এ রাতে যেহেতু পরবর্তী এক বছরের অবধারিত বিধিলিপি ফেরেশতাদের কাছে হস্তান্তর করা হয় সে কারণেও এ রজনীকে কদরের রজনী বলা হয়।
সূরা কদর অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপট : ইবনে আবি হাতেম রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সা: সাহাবিদের সম্মুখে বনী ইসরাইলের জনৈক চারজন লোক সম্পর্কে আলোচনা করলেন যে, তারা দীর্ঘ হায়াত লাভ করে অধিককাল যাবত ইবাদত করেছেন। এ সময়ের মধ্যে তারা একটিও নাফরমানি করেননি। রাসূলুল্লাহ সা:-এর জবান মোবারক থেকে এ কথা শুনতে পেরে সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত বিস্মিত হলেন এবং নিজেদের ব্যাপারে আফসোস করতে লাগলেন।
সাহাবায়ে কেরামের এ আফসোসের পরিপ্রেক্ষিতে মহান রাব্বুল আলামিন হজরত জিবরাইল আ:-এর মাধ্যমে রাসূল স:-এর কাছে এমন সময় এই সূরায়ে ‘কদর’ অবতীর্ণ করেন। (তাফসিরে মাআরিফুল কুরআন ও তাফসিরে মাজহারি)।
লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব : কদরের ফজিলত বোঝানোর জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ‘কদর’ নামে আলাদা একটি সূরা অবতীর্ণ করেন। কেবল কুরআন নয় বরং হাদিসেও কদরের ফজিলত রয়েছে বলে প্রমাণ রয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন, নিশ্চয় আমি তা (কুরআন) এক মোবারক রজনীতে অবতীর্ণ করেছি, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয় (সূরা আদ দুখান : ১-৪)। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, শবেকদরে হজরত জিবরাইল আ: ফেরেশতাদের বিরাট এক দল নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং যত নারী-পুরুষ নামাজরত অথবা জিকিরে মশগুল থাকে, তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেন (তাফসিরে মাজহারি)।
মিশকাত শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হজরত আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: এরশাদ করেন, মহানবী সা: এরশাদ করেন, ‘যদি তোমরা কবরকে আলোকময় পেতে চাও তাহলে লাইলাতুল কদরে জাগ্রত থেকে ইবাদত করো। রাসূলুল্লাহ সা: এরশাদ করেন, যদি কেউ ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের খাঁটি নিয়তে লাইলাতুল কদর কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদে অতিবাহিত করে তবে তার পূর্ববর্তী সব গোনাহ ক্ষমা করা হবে (বুখারি, হাদিস নং : ৬৭২)।
লাইলাতুল কদর কবে : লাইলাতুল কদরের নির্দিষ্ট কোনো তারিখ নেই। অনেকেই মনে করেন ২৭ রমজানই লাইলাতুল কদরের রাত। আসলে এ ধারণাটি সঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ সা: কখনো বলেননি যে, ২৭ রমজানের রাত কদরের রাত। তবে ২১ রমজান থেকে নিয়ে ২৯ রমজান পর্যন্ত বেজোড় যেকোনো রাতই শবেকদর হতে পারে। লাইলাতুল কদরের তারিখের ব্যাপারে নবী করিম সা: এরশাদ করেন, আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছে, অতঃপর আমাকে তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অতএব তোমরা শেষ ১০ রাতের বেজোড় রাতগুলোতে তা খোঁজ করবে (বুখারি, হাদিস নং : ৭০৯)।
রাসূল সা: আরো বলেন, ‘রমজানের শেষ ১০ দিনে তোমরা কদরের রাত তালাশ করো (মুসলিম, হাদিস নং: ১১৬৯)। একদা হজরত উবায়দা রা: নবী করিম সা:কে লাইলাতুল কদরের রাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তখন নবীজী সেই সাহাবিকে বললেন রমজানের বেজোড় শেষের ১০ দিনের রাতগুলোকে তালাশ করো (বুখারি, হাদিস নং: ২০১৭)। হজরত রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, যদি কেউ লাইলাতুল কদর খুঁজতে চায় তবে সে যেন তা রমজানের শেষ ১০ রাতে খোঁজ করে (মুসলিম, হাদিস নং : ৮২৩)। তাই ২১, ২৩, ২৫, ২৭, ২৯ রমজানের রাতগুলোকেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
শবেকদরে কী করব : রাসূলুল্লাহ সা: নিজে ‘লাইলাতুল কদর’ লাভ করার জন্য রমজানের শেষ ১০ রাত জাগ্রত থেকে ইবাদতে কাটিয়েছেন এবং উম্মতে মুহাম্মদীকেও রাত জেগে ইবাদত বন্দেগি করার নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূল সা: বলেন, শবেকদরকে নির্দিষ্ট না করার কারণ হচ্ছে যাতে বান্দা কেবল একটি রাত জাগরণ ও কিয়াম করেই যেন ক্ষান্ত না হয়ে যায় এবং সেই রাতের ফজিলতের ওপর নির্ভর করে অন্য রাতের ইবাদত ত্যাগ করে না বসে। তাই বান্দার উচিত শেষ দশকের কোনো রাতকেই কম গুরুত্ব না দেয়া এবং পুরোটাই ইবাদতের মাধ্যমে শবেকদর অন্বেষণ করা।
হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা আমি রাসূল সা:কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি কদরের রাত সম্পর্কে অবহিত হতে পারি তবে আমি কী করব? তখন রাসূল সা: আমাকে এই দোয়া পাঠ করার জন্য বললেন। ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি’ (তিরমিজি, হাদিস নং : ৩৫১)।
লাইলাতুল কদর চেনার কিছু আলামত : রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ১. রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না। ২. নাতিশীতোষ্ণ হবে। অর্থাৎ বেশি গরমও হবে না বেশি ঠাণ্ডাও হবে না। ৩. মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকবে। ৪. সে রাতে ইবাদত করে মানুষ অন্য রাত অপেক্ষাকৃত অধিক তৃপ্তি পাবে। ৫. কোনো ঈমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহ হয়তো স্বপ্নে তা জানিয়েও দিতে পারেন। ৬. ওই রাতে বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে। ৭. সকালে হাল্কা আলোকরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে, যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মতো। (সহিহ ইবনু খুজাইমা, বুখারি, মুসলিম)।
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে তাঁর সন্তুষ্টি অনুযায়ী আমলের মাধ্যমে লাইলাতুল কদরের ফজিলত নসিব করুন। আমীন।


আরো সংবাদ



premium cement