২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

আল্লাহর বিধান বারবার স্মরণ করা

-

আল্লাহ তায়ালা কুরআন কারিমে বলেছেন, ‘হে রাসূল, আপনি (আল্লাহর বিধান) স্মরণ করিয়ে দিতে থাকুন, কারণ এই স্মরণ করি দেয়াই মুমিনদের উপকারে আসবে।’ (সূরা জারিয়াহ-৫৫)। শুধু নতুন কথা নয়; অনেক সময় আমরা জানা কথাও মনে করতে পারি না। অনেক কথা মনে আছে কিন্তু মনে হচ্ছে যেন ভুলে গেছি বা মনে নেই। আবেগের কারণে মন থেকে সরে গেছে।
এ বিষয়ে রাসূল সা:-এর ওফাতের সময়ের একটি ঘটনা আছে। রাসূল সা: ওফাতের দিন ফজরের সময় যখন আবুবকর রা:-এর ইমামতিতে মুসলমানরা মসজিদে নামাজ আদায় করছেন তখন রাসূল সা: ঘরের দরজা খুলে দাঁড়ালেন, সাহাবির তখন আনন্দে মাতোয়ারা। নিশ্চয় রাসূল সা: সুস্থ হয়েছেন, গত পাঁচ দিন তিনি অসুস্থ। আমাদের সাথে নামাজ আদায় করতে পারেন না। এমতাবস্থায় আবুবকর রা: রাসূল সা:কে দেখে পেছনের দিকে যেতে শুরু করেছেন। তখন রাসূল সা: ইশারা করে বোঝালেন আমি আসছি না, তোমরা নামাজ আদায় করো। এরপর রাসূল সা: কিছু বললেন। যার অর্থÑ ‘নবুওয়াত শেষ হয়ে গেল, আর নবী আসবে না। তবে মুমিনরা অনেক সময় সত্য স্বপ্ন দেখবে। সত্য স্বপ্ন নবুয়তের ৪৮ অথবা ৭০ ভাগের এক ভাগ। রুকুতে গেলে তোমরা রবের তাজিম করবে। আর সিজদায় গেলে তোমরা বেশি বেশি আল্লাহর কাছে দোয়া করবে। কারণ সিজদার দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।’ এ কথা বলার পর রাসূল সা: ঘরের দরজার পর্দা নামিয়ে দিলেন।
এখানে এই কথার একটু ব্যাখ্যা দিতে হবে অন্যথায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। রাসূল বলেছেন, ‘সত্য স্বপ্ন নবুয়তের ৪৮ অথবা ৭০ ভাগের এক ভাগ।’ তার মানে এই নয় যে, কোনো মুমিন ব্যক্তি কোনো স্বপ্ন দেখলে সেটা দ্বীন বা ধর্মীয় বিধান হয়ে যাবে। বরং চিন্তাটা এভাবে করতে হবে যে, ভালো সত্য স্বপ্ন কেউ যদি দেখে, তবে সেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়ামত। এখন চিন্তা করুন আপনি স্বপ্ন দেখেছেন যে, ইবরাহিম আ:-এর মতো নিজের ছেলেকে কোরবানি করছেন। আপনি কি স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার পর আপনার ছেলেকে সত্যি সত্যি কোরবানি করবেন? অবশ্যই না। কারণ আপনার স্বপ্ন দ্বীন নয়, বরং একটি স্বপ্ন মাত্র। তাই রাসূল সা:-এর উক্তি ‘সত্য স্বপ্ন নবুয়তের ৪৮ অথবা ৭০ ভাগের এক ভাগ।’ এই কথার মাধ্যমে এটা মনে করা যাবে না যে, স্বপ্ন নবুয়ত বা দ্বীন বা নবুয়ত এখনো চলমান আছে।
দ্বীন হয় একশত ভাগ নবুয়ত দিয়ে। যেমনটা নবী-রাসূলরা ছিলেন। কিন্তু সত্য স্বপ্ন তো একশত ভাগের দুই ভাগ, তাই স্বপ্ন কখনো দ্বীন হবে না। সবাইকে এ বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। কেউ একটা স্বপ্ন দেখলেন, সকালে উঠে সেরকম একটা ঘটনা ঘটে গেল। তাহলে মনে করতে হবে আল্লাহ আমাকে একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
নামাজ শেষে আবুবকর রা: মদিনার কয়েক কিলোমিটার বাইরে কাজে চলে গেলেন। এদিকে দুপুর হয়নি আবার দুপুর হতেও বাকি নেই (দোহা) সেই রকম সময় রাসূল সা: ইন্তেকাল করলেন। সংবাদ শুনে হজরত ওমর রা: তরবারি নিয়ে ঘুরাতে লাগলেন আর বললেন, মুনাফেক ছাড়া কেউ বলতে পারে না যে, রাসূল সা: মারা গেছেন। যে বলবে, ‘রাসূল সা: মারা গেছে’ আমি তাকে হত্যা করব। রাসূল সা: মারা যেতে পারেন না। তিনি আল্লাহর সাথে দিদারে গেছেন, চলে আসবেন।
অন্য সাহাবিরাও হতবাক। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। আবুবকর রা: সংবাদ পেয়ে দ্রুত ফিরে এলেন রাসূল সা:-এর বাড়িতে। তিনি এসে সাহাবিদের শান্ত করার চেষ্টা করলেন। ওমর রা:কে শান্ত হতে বললেন। আবুবকর রা: রাসূলের ঘরে গেলেন এবং রাসূলের মুখমণ্ডল থেকে কাপড়টা সরিয়ে কপালে চুমু খেলেন। বললেন, হে রাসূল সা: আপনি জীবিত যেমন পবিত্র ছিলেন, আপনি ওফাতের পরেও তেমন পবিত্র রয়েছেন। মানুষকে মরতে হয় তাই আল্লাহ আপনাকে মৃত্যু দিয়েছেন।’ এরপর আবুবকর রা: ঘর থেকে বের হয়ে সাহাবিদের কাছে গেলেন। এদিকে ওমর রা: আগের মতোই আবেগে তরবারি ঘুরিয়ে রাসূল সা:কে মৃত বলতে নিষেধ করে যাচ্ছেন। তখন আবুবকর রা: ওমরকে কিছু না বলে মসজিদের মিম্বারে উঠলেন। সাহাবিরা সবাই অবুবকর রা:-এর দিকে এগিয়ে গেলেন।
আবার আবুবকর রা: হামদ ও সানা পাঠ করে ঘোষণা করলেনÑ আপনারা শুনুন, যারা মুহাম্মদ সা:-এর ইবাদত করতেন তারা জেনে রাখুন আপনাদের মাবুদ মুহাম্মদ মারা গেছেন। আর যারা আল্লাহর ইবাদত করতেন তারা শুনে রাখুন, আল্লাহ চিরঞ্জীব, অমর, তিনি মরেন না। এরপর তিনি সূরা আল-ইমরান থেকে তিলাওয়াত করলেন, ‘মুহাম্মদ সা: তো রাসূল ছাড়া কিছু নন। তার আগে অনেক রাসূল চলে গেছেন। যদি মুহাম্মদ সা: মারা যান অথবা নিহত হন তোমরা কি ইসলাম ছেড়ে দেবে? আর যদি কেউ মুহাম্মদ মারা যাওয়ার জন্য ইসলাম ছেড়ে দেয় তাহলে আল্লাহর কোনো ক্ষতি হবে না।’
সাহাবিরা সবাই এই আয়াত জানতেন। কিন্তু আবুবকর রা: বলার পরে সবাই বলতে লাগলেন, আমাদের মনে হচ্ছে এই আয়াত আজকে নতুন শুনলাম। রাসূল সা:-এর ওফাতের ধাক্কায় আমরা এই আয়াত ভুলেই গিয়েছিলাম। ওমর রা: বলছেন, ‘আমি যখন এই আয়াত শুনলাম তখন আমার সব আবেগ হারিয়ে গেল। আমার মনে হলো আমার পা আমার ভার রাখতে পারবে না। আমি পাটিতে বসে পড়লাম।’
এখান থেকে আমরা বুঝতে পারি, জানা বিষয়ও আমাদের ভুল হতে পারে বা আমরা ভুলে যেতে পারি। তাই আমাদের উচিত নিয়মিত কুরআন-হাদিসের নতুন নতুন বিষয় অনুসন্ধানের সাথে সাথে পুরনো বা আগে জানা বিষয়গুলো বারবার স্মরণ করা, মাঝে মধ্যে জানা বিষয়গুলো আবার পড়া। যে কথাগুলো বললে শুনলে আল্লাহ খুশি হন সে কথা বারবার বলার, শোনার এবং আমল করার তাওফিক আল্লাহ আমাদের দান করুন। আমিন।
মরহুম প্রফেসর ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের বক্তব্য থেকে অনুলিখন সাইফুল্লাহ হিমেল।


আরো সংবাদ



premium cement