২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

রোগীর সেবা, ফজিলত ও আদব

-

ইসলাম এমন একটি সর্বজনীন জীবনব্যবস্থা, যার প্রতিটি আদেশ ও নিষেধে মানবজাতির ইহকালীন ও পরকালীন কোনো না কোনো কল্যাণ নিহিত রয়েছে। ইসলামের আদেশসূচক প্রতিটি বিধান পালনে সওয়াব রয়েছে এবং নিষেধ সূচক প্রতিটি বিধান থেকে বিরত থাকার মধ্যেও রয়েছে পুণ্য। কিন্তু আমরা শুধু ইসলামকে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের সাথে সীমাবদ্ধ করে রেখেছি। বিশেষ কিছু ইবাদত-বন্দেগি যেমনÑ শুধু নামাজ পড়া, রোজা রাখা, হজ করা, জাকাত দেয়াকেই আমরা ইবাদত মনে করি। অথচ এসব ছাড়া আরো অনেক মহাপুণ্যের ইবাদত রয়েছে, যেগুলোর প্রতি আমাদের তেমন আগ্রহ নেই। যেমন ‘ইয়াদাতুল মারিয’ তথা অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া এবং তার সেবা শুশ্রƒষা করা। এটি নফল ইবাদতের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত এবং রাসূল সা:-এর একটি বিশেষ সুন্নত।
হজরত মুহাম্মদ সা: এ ব্যাপারে খুব তাগিদ ও গুরুত্বারোপ করেছেন। নিজেও রোগীর সেবা-শুশ্রƒষা করে উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন, একটি মহান ইবাদত। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া এবং তার সেবা-শুশ্রƒষা করা, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যার ওসিলায় পারিবারিক ও সামাজিক সৌহার্দ্যপূর্ণ বন্ধন দৃঢ় হয় এবং পরস্পর ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। হাদিস শরিফের সব গ্রন্থে এর প্রতি গুরুত্বারোপ করে বিশদ বিবরণ এসেছে।
হজরত আবু হুরায়রা রা: সূত্রে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, রাসূল সা: ইরশাদ করেনÑ ‘এক মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের পাঁচটি অধিকার রয়েছেÑ ১. সালামের জবাব দেয়া; ২. হাঁচির উত্তর দেয়া; ৩. দাওয়াত কবুল করা; ৪. অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া ও ৫. জানাজায় অংশগ্রহণ করা’ (সহিহ বুখারি-১২৪০, সহিহ মুসলিম-২১৬২)।
অপর বর্ণনায় হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত হয়েছে। রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের দিন মহান রাব্বুল আলামিন আদম সন্তানকে সম্বোধন করে বলবেন। হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে যাওনি। বান্দা বলবে, আপনি তো বিশ্ব জাহানের পালনকর্তা আমি আপনাকে কিভাবে দেখতে যেতে পারি? আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল। তুমি তাকে দেখতে গেলে তার কাছে আমাকে পেতে’ (সহিহ মুসলিম-২৫৬৯)।
অমুসলিমদের সেবা-শুশ্রƒষা: অসুস্থ মুসলিমকে তো তার অধিকার হিসেবে দেখতে যেতে হবে এবং তাদের সেবা-শুশ্রƒষা করতে হবে। সাথে সাথে অমুসলিম অসুস্থ প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবকেও দেখতে যেতে হবে এবং তাদের সেবা-শুশ্রƒষা করতে হবে। এটিও একটি মহান ইবাদত এবং রাসূল সা:-এর সুমহান আদর্শ ও সুন্নত। অমুসলিমদের কাছে ইসলামের অনুপম আদর্শ তুলে ধরার এটি একটি দাওয়াতি মাধ্যমও বটে।
হজরত আনাস রা: সূত্রে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, এক ইহুদি যুবক রাসূল সা:-এর খেদমত করত। একদা সে অসুস্থ হয়ে যায়। রাসূল সা: তাকে দেখতে যান। তার মাথার কাছে বসে তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। সে তার পিতার দিকে দৃষ্টি ফেরাল। তার পিতা বলল, তুমি আবুল কাশেম সা:-এর অনুসরণ করো। অতঃপর সে ইসলাম গ্রহণ করল। রাসূল সা: সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি এই যুবককে জাহান্নামের আগুন থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন বলতে বলতে বের হলেন’ (সহিহ বুখারি-১৩৫৬, সুনানে আবু দাউদ-৩০৯৫)।
রোগীকে দেখতে যাওয়ার ফজিলত : রোগীকে দেখতে যাওয়ার অনেক ফজিলতের কথা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। আমরা এখানে কিঞ্চিত আলোকপাত করার প্রয়াস পাবো। হজরত আলী রা: থেকে বর্ণিতÑ রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি সকালবেলা কোনো অসুস্থ মুসলমানকে দেখতে যায় ৭০ হাজার ফেরেশতা বিকেল পর্যন্ত তার জন্য দোয়া করতে থাকেন। আর বিকেলে রোগী দেখতে গেলে সকাল পর্যন্ত ৭০ হাজার ফেরেশতা তার জন্য দোয়া করতে থাকেন এবং তার জন্য জান্নাতে একটি ফলের বাগান তৈরি করা হয়’ (আবু দাউদ-৩০৯৮, তিরমিজি-৯৬৯, ইবনে মাজাহ-১৪৪২)।
রোগীকে দেখার সুন্নত তরিকা ও আদব : ১. অজুসহকারে রোগীকে দেখতে যাওয়া। হজরত আনাস রা: সূত্রে বর্ণিতÑ রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি উত্তমরূপে অজু করে সওয়াবের উদ্দেশে কোনো অসুস্থ মুসলমানকে দেখতে যায়, তাকে জাহান্নাম থেকে ৬০ বছর সমপথ দূরে রাখা হবে’ (সুনানে আবু দাউদ-৩০৯৭)।
২. যথাসম্ভব রোগীর শরীরে হাত দিয়ে তার অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা (মুসনাদে আহমাদ-২২২৩৬)।
৩. রোগীকে সান্ত্বনার বাণী শোনানো। হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিতÑ রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘তোমরা যখন কোনো রোগীর কাছে যাবে, তার জীবন সম্পর্কে আনন্দদায়ক কথা বলবে, তাকে সান্ত্বনার বাণী শোনাবে।’ (এ সান্ত্বনার বাণী) ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাবে না, যা ঘটার তাই ঘটবে কিন্তু তার মন সান্ত¡না লাভ করবে, যা রোগী দেখতে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য’ (তিরমিজি-২০৯৪)।
৪. রোগীর কাছে বেশি সময় অবস্থান করবে না। কারণ এতে রোগীর কষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হ্যাঁ রোগীর কাছে অবস্থান করা, যদি রোগীর অন্তরের প্রশান্তি ও সান্ত্বনার কারণ হয়। তাহলে দীর্ঘ সময় অবস্থান করাতে কোনো সমস্যা নেই।
৫. চিকিৎসক কর্তৃক রোগীর সাথে দেখা-সাক্ষাতের ক্ষেত্রে কোনো পরামর্শ থাকলে, তার প্রতি লক্ষ্য রাখা। অনেক সময় আমরা আবেগতাড়িত হয়ে, এসবের প্রতি তোয়াক্কা না করে, রোগীকে দেখতে যাই। এতে রোগীর উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়।
৬. রোগীর কোনো চাহিদা আছে কি না জিজ্ঞেস করা। খাবার বা অন্য কোনো বৈধ চাহিদা থাকলে যথাসম্ভব পূরণ করার চেষ্টা করা।
৭. রোগীর কাছে উঁচু আওয়াজে কথা বলবে না। হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, ‘সুন্নত হলো রোগীর পাশে কম বসা এবং বড় আওয়াজে কথা না বলা’ (মিশকাত-১৫৮৯)।
৮. রোগীর জন্য দোয়া করা। হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিতÑ রাসূল সা: ইরশাদ করেন, মুমূর্ষ রোগী ছাড়া যেকোনো রোগীর কাছে নিম্নের দোয়াটি সাতবার পাঠ করা হলে, সে রোগী অবশ্যই ওই রোগ থেকে মুক্তি লাভ করবে’ (আবু দাউদ-৩১০৬)। উচ্চারণ : আস আলুল্লাহাল আজিম রাব্বাল আরশিল আজিম আইয়াশফিয়াকা।
৯. রোগীর কাছে নিজের জন্য দোয়া চাওয়া। হজরত ওমর রা: থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, রাসূল সা: এরশাদ করেন; ‘তোমরা যখন কোনো রোগীকে দেখতে যাবে, তার কাছে দোয়া চাইবে! কারণ তার দোয়া ফেরেশতাদের দোয়ার মতো কবুল’ (ইবনে মাজাহ-১৪৪১)।
১০. রোগী মুমূর্ষু হলে তার কাছে সূরা ইয়াসিন পাঠ করা।
১১. অসুস্থ ব্যক্তিকে রোগের অবস্থা সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস না করা। কারণ অনেক সময় এতে রোগী বিব্রতবোধ করে। তবে চিকিৎসকের ব্যাপার ভিন্ন।
লেখক : মোহাদ্দিস, আল-জামেয়াতুল আজিজিয়া দারুল উলুম ইসলামিয়া, দৌলতখান, ভোলা।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement