২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

গুরুত্বপূর্ণ একটি হাদিসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে

-

আমরা মাঠে-ময়দানে, মাদরাসা-মসজিদে তর্কে-বিতর্কে আলোচনা-সমালোচনায় যখনই শিক্ষা বা এলেমের কথা বলি তখনই একটি হাদিসের উদ্ধৃতি দেই, আর হাদিসটি হচ্ছে- সুনানে ইবনে মাজার ২২৪ নম্বর হাদিস। তালাবুল ইলমি ফারিদাতুন আলা কুল্লি মুসলিমিন, পাঠের সময় আরবিতে এতটুকু পাঠ করে যখন তার অনুবাদ করি বা বাংলায় বুঝতে বা বোঝাতে চেষ্টা করি তখন হাদিসটির আগে ছোট্ট একটি শব্দ জুড়ে দেই, শব্দটি হচ্ছে দ্বীন। অর্থাৎ হাদিস পড়ি তালাবুল ইলমি ফারিদাতুন আলা কুল্লি মুসলিমিন, অর্থ করি দ্বীনে এলেম শিক্ষা করা মুসলিমদের জন্য ফরজ। পৃথিবীর অন্য কোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে অথবা অন্য যেকোনো দেশে অর্থ করার আগে দ্বীন শব্দটা সংযুক্ত করা হয় কি না আমার জানা নেই।
বোখারি শরিফের বঙ্গানুবাদের মধ্যে ১০৮ নম্বর একটি হাদিসে এরূপ পড়েছি যে, হুজুর সা: বলেন ‘যে আমার ওপর মিথ্যা আরোপ করবে সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেবে।’ কিন্তু অতি পরিতাপের বিষয়, এ দেশে খোদ মাদরাসায় পঠন-পাঠনের সময় দ্বীন কথাটা যুক্ত করে পাঠ করানো হচ্ছে। তাৎক্ষণিকভাবে শব্দটি যুক্ত করার ভয়াবহতা সম্পর্কে আমরা হয়তো কল্পনা করতে পারি না বা এ সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। হাদিসটির অর্থ করার সময় দ্বীন কথাটা জুড়ে দিলে শুনতে ভালো লাগে, মনে হয় হাদিসটির গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এর ক্ষতির দিকটা সম্পর্কে একটুও চিন্তা করি না।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে বসবাসকারী মুসলমানরা আমরা একবাক্যে মনে করি, দ্বীনে এলেম শিক্ষা করার অর্থ হচ্ছে মাদরাসায় পড়ে শুধু হাদিস-কুরআন শিক্ষা করে কারি, হাফেজ মাওলানা হওয়া। যারা স্কুল-কলেজে পড়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বা অন্য কোনো পেশায় নিয়োজিত হন সেগুলো বুঝি দ্বীনের বাইরের কোনো শিক্ষা, অর্থাৎ মাদরাসায় না পড়লে সে শিক্ষাকে দ্বীনে এলেম বলা যাবে না। অর্থাৎ হাদিসটির অর্থের আগে দ্বীন কথাটি বসিয়ে যেন এটাই বোঝান হচ্ছে- স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিপড়ুয়া মুমিনরা যেন দ্বীনের বাইরে রয়ে গেছেন। অথচ কুরআন-হাদিস উত্তমরূপে যারা বোঝেন, যারা স্থান-কাল-পাত্র ভেদে কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যাদানে পারঙ্গম তাদের দৃষ্টিতে প্রকৌশলী-চিকিৎসা বিদ্যাসহ অন্যান্য শিক্ষা যা মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য বৈধ তা সবই দ্বীনের শিক্ষার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
উদাহরণস্বরূপ ধরুন হজরত আদম আ:কে আল্লাহ পাক জীবন-জীবিকার জন্য কৃষিকাজ ও হালচাষ পরিচালনা করা শিখিয়ে ছিলেন, তাহলে এই পেশা কি দ্বীনে এলেমের বাইরে? আবার কৃষি প্রকৌশলীরা কৃষি উন্নয়নের জন্য যেসব প্রযুক্তি ও আধুনিক কৃষিযন্ত্র আবিষ্কার করে মানুষের খাদ্যচাহিদা মেটানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এটা কি দ্বীনে এলেম নয়? অর্থাৎ শরিয়তসম্মতভাবে যেকোনো শিক্ষাই হলো এলেম, আর মুহাম্মদ সা: যখন হাদিসটির সাথে দ্বীন কথাটি যুক্ত করেননি তাতে করে বোঝা যায়, এ হাদিসটি দিয়ে শুধু মাদরাসায় লেখাপড়া করার নামই এলেম নয়। যুগোপযোগী জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমন্বয়ে মানব কল্যাণের নিমিত্তে শরিয়তসম্মত সব শিক্ষাই দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত, এখানে মুমিনদের কর্মকাণ্ডগুলোকে দ্বীন থেকে পৃথক করার কোনো সুযোগ নেই।
যারা মনে করেন, মাদরাসায় না পড়লে দ্বীনের শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া যায় না- প্রকৃত অর্থে দ্বীনের তাৎপর্য তারা বুঝেছেন বলে মনে করা যায় না। ধরুন দ্বীন বলতে যদি শুধু মাদরাসা হয় তবে বাংলাদেশে কি এমন কোনো মাদরাসা আছে যেখান থেকে তৈরি হবে চিকিৎসাবিজ্ঞানী, পরমাণুবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী, কৃষিবিজ্ঞানী, প্রত্নতত্ত্ববিজ্ঞানী বা ওই ধরনের কোনো পেশার মানুষ? এগুলোর প্রয়োজন তো আমরা এড়িয়ে চলতে পারি না। তবে কি এ পেশায় শিক্ষা গ্রহণ করতে ইসলামে নিষেধ? যদি তাই হয় তবে তো ইসলামের শত্রুরাই সব জায়গা দখল করে নেবে, আমার পকেটের পয়সা আমি তাদের পকেটে তুলে দিচ্ছি নিজ ইচ্ছায়।
অতএব, হুজুর সা: যেখানে হাদিসটির আগে দ্বীন কথাটি উল্লেখ করেননি সেখানে আমরা কেন দ্বীন কথাটি ব্যবহার করব? ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় এই ছোট শব্দটির ব্যবহারে গোটা উম্মত এমনভাবে বিভক্ত হয়ে গেল যেমন করে একটা ধারালো দা দিয়ে একটি কুমড়াকে সজোরে আঘাত করে দুটি ভাগে ভাগ করে দেয়।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা


আরো সংবাদ



premium cement