২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সুকুক : কি ও কেন?

-

বর্তমান সময়ে বিশ^ময় সবচেয়ে আলোচিত ইসলামিক প্রডাক্টগুলোর একটি হলো ‘সুকুক’। বিশেষত বাংলাদেশে এ সময়ে ইসলামিক ফিন্যান্স বিষয়গুলোর মধ্যে সুকুকের আলোচনা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে বছর দু’য়েক আগেও এর তেমন আলোচনা ছিল না। অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে এর আরো আগে থেকেই ইসলামিক ফিন্যান্সের বিভিন্ন লেকচারে এ নিয়ে আলোচনা করে আসছি। গত ২৯ মে, ২০১৯ পূঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘বিএসইসি’ সুকুক বিষয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ডিসেম্বর নাগাদ সরকারি সুকুক (ঝড়াবৎবরমহ ঝঁশঁশ) ইস্যু করা হবে। পুরো বিশে^র ইসলামিক ফিন্যান্স অ্যাসেটের ১৭ শতাংশই এই সুকুকের দখলে। কারেন্সির অঙ্কে তা ৪২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। (থমসন রয়টার্স, ২০১৭)
সুকুক কী?
বলার উদ্দেশ্য, এই সুকুক আসলে কী? তা আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়। সহজে এর মূল কথাটি হলোÑ এতটুকু আমরা জানি যে, কোম্পানি, ব্যাংক ইত্যাদি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়িক স্বার্থে পুঁজির প্রয়োজন হয়। দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারেরও প্রয়োজন হয় মোটা অঙ্কের মূলধনের। কোম্পানিগুলো তাদের পুঁজি সরবরাহ করার গতানুগতিক পদ্ধতি হলো শেয়ার ইস্যু করা। অথবা বন্ড ইস্যু করা। অপর দিকে সরকারের গতানুগতিক পদ্ধতি হলো ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করা। সুকুক মূলত এ ধরনেরই ফান্ড সংগ্রহের একটি বিশেষ মাধ্যম, যার মাধ্যমে সরকার বা কোম্পানি তাদের পুঁজি/মূলধন সরবরাহ করে থাকে। তবে বাস্তবে বিভিন্ন দিক থেকে শেয়ার ও বন্ডের সাথে সুকুকের পার্থক্য রয়েছে।
শেয়ারের সাথে সুকুকের মূল পার্থক্যটি হলোÑ শেয়ার মূলত আনুপাতিক হারে পুরো কোম্পানির অ্যাসেটের প্রতিনিধিত্ব করে। একটি শেয়ার ক্রয়ের অর্থ হলো আপনি সেই কোম্পানির সব প্রকার অ্যাসেটের আনুপাতিক মালিকানা লাভ করেছেন। এজিএমে আপনি কথা বলতে পারবেন। এভাবে বৃহৎ শেয়ার সংগ্রহ করলে কোম্পানির নীতিনির্ধারণীতেও আপনি ভূমিকা রাখতে পারবেন।
অপর দিকে সুকুক একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিশেষ প্রজেক্টে সুনির্দিষ্ট অ্যাসেটের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। সাধারণ শেয়ারের মতো পুরো কোম্পানির সব অ্যাসেটের ওপর হয় না।
ধরা যাক, ‘ক’ কোম্পানি একটি শিপিং কোম্পানি। তাদের অনেক শিপ আমদানি-রফতানিতে ভাড়ায় ব্যবহৃত হয়। কোম্পানির একটি শিপ ‘খ’ কোম্পানির কাছে ভাড়া দেয়া। চুক্তি অনুযায়ী ‘খ’ কোম্পানি তিন মাস অন্তর ভাড়া দেয়। এ দিকে ‘ক’ কোম্পানির নগদ মোটা অঙ্কের মূলধনের প্রয়োজন। এ জন্য সে ওই শিপকে ভিত্তি করে তৃতীয় একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে (পরিভাষায় একে ‘এসপিভি’ [ঝঢ়বপরধষ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব াবযরপষব] বলে) ১০০০ সুকুক ইস্যু করল। প্রতিটি সুকুকের মূল্য এক হাজার টাকা। মোট সুকুক মূল্য : ১০ লাখ টাকা। যারা সুকুক ক্রয় করবে, তারা সবাই আনুপাতিক হারে ওই শিপের মালিক হয়ে যাবে। এই কেইসে ‘ক’ কোম্পানির লাভ হলো, সে উপস্থিত মূলধন পেয়ে গেছে। সুকুক হোল্ডারদের লাভ হলো, তারা তিন মাস অন্তর অন্তর শিপ থেকে অর্জিত ভাড়া ভোগ করবে। এরপর একটা সময়ে শিপটি ওই তৃতীয় প্রতিষ্ঠান (এসপিভি) তাদের পক্ষে বিক্রয় করে দেবে। এটি ‘ক’ কোম্পানিও ক্রয় করে নিতে পারে।
লক্ষ্য করে দেখুন, এখানে সুকুক হোল্ডারগণ একটি বিশেষ প্রজেক্টে ফান্ড সংগ্রাহক কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়েছেন। শেয়ারের মতো পুরো কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়নি।
তদ্রƒপ সুকুক সাধারণ বন্ডের মতোও নয়। বন্ড শতভাগ একটি সুদি প্রডাক্ট। বন্ড ক্রয় করার অর্থ সুদে ঋণ প্রদান করা। এখানে সুনির্দিষ্ট অ্যাসেট থেকে প্রাপ্ত প্রফিট বণ্টন করা হয় না। বরং বন্ড ইস্যুকারী তার সামগ্রিক আয় থেকে সুদ প্রদান করে থাকে। আয় না হলেও গৃহীত মূলধনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হয়। অপর দিকে সুকুক শতভাগ একটি ইসলামী প্রডাক্ট। সুকুক ক্রয়ের অর্থ সুদে ঋণ প্রদান নয়। বরং বিশেষ প্রজেক্টে অংশগ্রহণ। এই অংশগ্রহণ কখনো মুদারাবা, কখনো মুশারাকা, কখনো ইজারা, কখনো সালাম (অফাধহপবফ ঈড়হঃৎধপঃ) ইত্যাদি শরিয়াহ্ কন্ট্রাক্টের অধীনে হয়ে থাকে। (আমাদের পূর্বোক্ত উদাহরণটি ইজারা বা ভাড়া কন্ট্রাক্টের উদাহরণ। )
সুতরাং সুকুক অবশ্যই ফান্ড সংগ্রহের একটি বিশেষ মাধ্যম। তবে তা শেয়ার নয়, বন্ডও নয়। অবশ্য কিছু কিছু দিক থেকে শেয়ারের সাথে মিল আছে। যেমন, এটিও শেয়ারের মতো সেকেন্ডারি মার্কেটে লেনদেন করা যায়। (অবশ্য ডেবট বেইসড সুকুক ব্যতিক্রম) শেয়ারের মতো এটিও আনুপাতিক হারে অবিভক্ত সমান মালিকানা বোঝায়। তদ্রƒপ বন্ডের সাথেও কিছু মিল আছে, যেমন-বন্ডের মতো সুকুক অবকাঠামোর উন্নয়ন এমনভাবে করা হয়, যেন বিনিয়োগকৃত মূলধন সুরক্ষিত থাকে। তবে অবশ্যই সেটি শরিয়াহ্ অনুসরণ করে। এ জন্যই অনেক গবেষক সুকুককে ‘কুআইজি ইক্যুয়িটি’ (ছঁধংর ঊয়ঁরঃু) ‘মেজানিন ইক্যুয়িটি’ (গবুুধহরহব ঊয়ঁরঃু) বলে অভিহিত করেছেন।
সুকুকের বৈশিষ্ট্য :
সুকুকের মূল বৈশিষ্ট্য তিনটি। যথাÑ ১. এটি বিশেষ প্রজেক্টে হয়ে থাকে ২. এর বিপরীতে সুনির্দিষ্ট অ্যাসেট থাকে। পরিভাষায় একে ‘আন্ডারলায়িং অ্যাসেট’ বলা হয়। সুকুক হোল্ডারদের মূলত সেই অ্যাসেট থেকে প্রফিট জেনারেট হয়। দেখুন সাধারণ ব্যাংক লোনের বিপরীতেও মর্গেজ হিসেবে অ্যাসেট রাখতে হয়। তবে সেটি ব্যবহৃত হয় না। সেখান থেকে প্রফিট আসে না। ৩. এর অবকাঠামো গঠন হয় শরিয়াহ্র সুনির্দিষ্ট কোনো কন্ট্রাক্টের অধীনে।
সুকুক শব্দের অর্থ :
‘সুকুক’ শব্দটি মূলত বহুবচন। এর একবচন ‘ছক্ক’। মূল শব্দটি ফার্সি। সেখান থেকে আরবি ‘ছাক্কুন’। এরপর এর বহুবচন ‘সুকুক’। এর শাব্দিক অর্থ : সার্টিফিকেট। দলিল দস্তাবেজ। যা কোনো সম্পদের প্রতিনিধিত্ব করে। যেমন, জমির দলিল। (আল-মিসবাহুল মুনীর, পৃ.১৮০)
সুকুকের প্রায়োগিক ব্যবহার :
প্রায়োগিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঐতিহাসিকভাবে ‘সুকুকের’ তিনটি অর্থ ও প্রয়োগ দেখা যায়। যথা-
ক. কোনো সম্পদের ডকুমেন্টস/সার্টিফিকেট। যেমন, ওয়াকফ সম্পদের দলিল। হিজরি পঞ্চম শতাব্দীতে এর ব্যবহার পাওয়া যায়। (রদ্দুল মুহতার, ১৩/৫৯২)
খ. রাষ্ট্রীয় ভাতাপ্রাপ্তির সার্টিফিকেট। এই ব্যবহারটি ৬৫ হিজরিতে উমাইয়াহ শাসনামলে পাওয়া যায়। মদিনার গভর্নর তখন মারওয়ান ইবনে হাকাম (২-৬৫হি./৬২৩-৬৮ঈ.)। ওই সময়ে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভাতা প্রদান করা হতো। সেই ভাতাপ্রাপ্তির জন্য বিশেষ সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছিল, যা ‘সুকুক’ নামে পরিচিত ছিল। এই সুকুক দিয়ে নির্ধারিত স্থান থেকে রাষ্ট্রীয় ভাতা হিসেবে খাদ্য লাভ করা যেত। এই সুকুক আবার সেকেন্ডারি মার্কেটে লেনদেন হতো। যিনি এই সুকুক লাভ করতেন, তিনি সেটি দিয়ে ভাতা উত্তোলন না করে অন্যত্র বিক্রি করে দিতেন। এতে যে সমস্যা হতো তা হলো পণ্য হস্তগত করার আগেই তা বিক্রি করা হয়। হাদিসে তা স্পষ্ট নিষিদ্ধ। তাই তৎকালীন সাহাবায়ে কেরাম এর বিরোধিতা করেছেন। ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে হাদিসের কিতাবগুলোয় উল্লেখ হয়েছে। (সহিহ মুসলিম,৩৭৩৯)
গ. সুদি বন্ডের বিকল্প হিসেবে ‘বিশেষ সার্টিফিকেট’। এ অর্থেই বর্তমানে ব্যবহৃত হয়। লক্ষ্য করুন, পূর্বোক্ত দুটি প্রয়োগ ও বর্তমান প্রয়োগে একটি বিশেষ মিল হলো, সুকুক সবসময় সম্পদের প্রতিনিধিত্ব করে। এর আন্ডারলায়িং অ্যাসেট থাকে। এটিই সুকুকের মূল কথা।
সুকুক কেন প্রয়োজন?
একটি টেকসই ও কল্যাণধর্মী অর্থব্যবস্থার জন্য সুদ অন্যতম প্রতিবন্ধক। সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা সম্পদের সুষম বণ্টন ব্যাহত করে। সম্পদে এককেন্দ্রিকতা সৃষ্টি করে। দীর্ঘ দিন যাবৎ সুদভিত্তিক বন্ড আমাদের অর্থব্যবস্থায় প্রচলিত। এর থেকে উত্তরণের অন্যতম উপায় সুকুক প্রচলন করা। সুকুক সম্পূর্ণ সুদমুক্ত একটি ইসলামী বন্ড। এটি সুদের বিপরীতে টেকসই অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি এটি সম্পূর্ণরূপে সম্পদভিত্তিক হওয়ায় এতে আর্থিক ঝুঁকিও সামগ্রিকভাবে কম। তবে সুকুক থেকে উপকার ও কল্যাণ লাভ করতে হলে এর শরিয়াহ্ পরিপালন সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ সুকুক ইস্যু করবে এটি অবশ্যই ভালো ও প্রত্যাশিত। তবে সেটা অবশ্যই সুদৃঢ় শরিয়াহ পরিপালনের মধ্য দিয়ে হতে হবে। এর জন্য দেশের টপ টু বটম ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন অপরিহার্য। সব কিছু অনৈসলামিক রেখে শুধু বন্ডে ইসলামীকরণ করা হলে এর সুফল নিয়ে সংশয় থেকে যায়। ‘বাংলাদেশে সুকুক ইস্যু : সমস্যা ও উত্তরণ উপায়’ নিয়ে ইনশাআল্লাহ সামনে কোনো একদিন বিস্তারিত আলোচনা করব। আজ এ পর্যন্তই।
(সার্টিফাইড শরিয়াহ্ অ্যাডভাইজর অ্যান্ড অডিটর, অ্যাওফি বাহরাইন)

 


আরো সংবাদ



premium cement