২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঈমানের অপরিহার্য শর্ত জ্ঞান

-

ঈমান মানুষের বোধ, বিশ্বাস ও কর্মে একটি বিপ্লবী পরিবর্তন আনে। একজন মানুষ ঈমান আনলে তাকে মোমিন বা বিশ্বাসী বলা হয় এবং ঈমান না আনলে তাকে কাফির বা অবিশ্বাসী বলা হয়। মূলত কাফির কোনো গালির নাম নয়Ñ এটি মানুষের একটি অবস্থার নাম। একজন মানুষ যদি চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, জিন-ভূত অথবা অন্য কোনো সৃষ্টি বা কোনো মানবীয় শক্তির বিষয়ে মনে করে যে সেটি তার স্রষ্টা বা সেটি তার ইবাদত, উপাসনা বা আনুগত্য পেতে পারে অথবা সে শক্তির হাতেই তার ভালো মন্দ নির্ভর করেÑ তাহলে ইসলামের পরিভাষায় সে আল্লাহর প্রতি কাফির এবং গাইরুল্লাহ বা আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর প্রতি বিশ্বাসী। অর্থাৎ সংক্ষেপে বললে সে আল্লাহর প্রতি কুফরী করল এবং আল্লাহর সাথে শিরক করল। অতঃপর যে কেউ তাগুতের সাথে কুফরি করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবেÑ সে একটি মজবুত রজ্জু ধারণ করল, যা কখনো ছিঁড়ে যাওয়ার নয়। সুতরাং ইসলামে ঈমানের বিষয়টি কোনো মন্ত্র পাঠ নয় বরং জেনে বুঝে একটি বিপ্লবী সিদ্ধান্ত গ্রহণ। কাজেই এ ঘোষণার প্রতিক্রিয়া কী? ঘোষণার ফলে আমার ওপর কী কী দায়িত্ব বর্তায়? এসব বিষয়গুলো বুঝে শুনে ঘোষণা দেয়ার নাম ঈমান। আমরা জানি হজরত ইবরাহিম আ: ঈমানের ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথে তার পিতার দুশমনে পরিণত হলেন এবং পিতা তাকে পাথর মেরে হত্যা করার হুমকি দিলেন। তাহলে যে ঘোষণা পিতা-পুত্রের সম্পর্ককে বাতিল করে দেয়, একজন অবিশ্বাসীর সন্তান ঈমানের ঘোষণা দিলে পিতার সম্পদের ওয়ারিশ হতে পারে নাÑ সেটি কোনো ছোটখাটো বিষয় নয়। তাই ঈমানের সাথে জ্ঞান বা ইলমের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। এক কথায় ইলমকে ঈমানের পূর্বশর্ত বললেও বেশি বলা হয় না। কেননা কিসের প্রতি বিশ্বাসের ঘোষণা দিচ্ছি সেটি না জানলে বা সে সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে সে ঘোষণার কোনো মানে হয় না। এজন্য অজ্ঞতা বা মুর্খতার সাথে ঈমানের সম্পর্ক নেই।
ঈমানদার ব্যক্তিকে অবশ্যই জেনে বুঝে ঈমানের ঘোষণা দিতে হবে, তাহলেই সে ঈমান হয় জীবন্ত-প্রাণবন্ত। আর সে ধরনের ঈমানদারই নিজেকে বদলে দিতে পারেন, বদলে দিতে পারেন তার চার পাশকে। দু’জন লোকের মধ্যে প্রকৃত পার্থক্য কী? একজনের নাম আবদুল্লাহ বা নূর মোহাম্মদ, অপরজনের নাম মধুসুদন বা ক্রিস্টোফার এই পার্থক্য? অথবা একজনের নাম সুমাইয়া বা উম্মে সালমা অপরজনের নাম আরতি বা মার্গারেটÑ এটাই কি পার্থক্য? নিশ্চয়ই তা নয়। একজন মুসলিম ও একজন অমুসলিমের মধ্যে মূল পার্থক্য হচ্ছে জ্ঞানের। একজন মুসলিম জানে আল্লাহর পরিচয়, নবুয়াত রেসালাত কী। সে জানে আখিরাতের জীবন কী? আল্লাহ ও তাঁর নবী রাসূলগণের সম্পর্কে জানার সাথে সাথে সে জানে তার করণীয় বা বর্জনীয় কী? কোন কাজটি আল্লাহর অনুমোদিত, কোন কাজটি আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ, কোন ধরনের কাজে আল্লাহ খুশি হন, কী কাজ আল্লাহর অসন্তুষ্টি বা ক্রোধের উদ্রেক করে সেটি একজন মুসলিম জানে আর এগুলো একজন অমুসলিম জানে নাÑ এটিই মূল পার্থক্য। নামের পার্থক্য আল্লাহর কাছে কোনো বিষয় নয়, জ্ঞান ও কর্মের পার্থক্যই মূল কথা। তাই ঈমানের দাবি অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন করার জন্য জ্ঞানের বিকল্প নেই।
ইসলাম গ্রহণ বা ঈমানের ঘোষণা দেয়ার আগেও ওমর ইবনুল খাত্তাবের নাম ওমরই ছিলÑ আবার ইসলাম গ্রহণের পরেও তার নাম ওমরই ছিল। তেমনি আবু বকর, ওসমান, আলী কিংবা তালহা-জুবায়ের, ইকরামা ইবনে আবু জেহেল, খালিদ বিন ওয়ালিদ প্রমুখ সাহাবির নাম ইসলাম গ্রহণের আগেও একই ছিল।
এখন বিবেচনা করুন কাফির বা মুশরিক অর্থাৎ যারা ঈমান আনে নাই তাদেরকেও আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন এবং পৃথিবীতে বেঁচে থাকার উপায় উপকরণ আল্লাহই তাদের সরবরাহ করেন। সূর্যের আলো, বৃষ্টি, বাতাস, অক্সিজেন সমানভাবেই কাফির ও মুসলমানকে সরবরাহ করেন আল্লাহ তায়ালা। এখন শুধু নামের পার্থক্যের কারণেই কী একজন জাহান্নামের অনন্ত শাস্তি ভোগ করবেন, আরেকজনের নাম পৃথক হওয়ার কারণে জান্নাতের সুখ সুবিধা অনন্তকালের জন্য ভোগ করবেন এমন বিচার কী আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার মতো প্রজ্ঞাবান দয়ালু ও করুণাময় স্রষ্টার কাছে আশা করা যায়? নিশ্চয়ই না। তাহলে দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য কী? একজন পাজামা পাঞ্জাবি পরেন, আরেকজন ধূতি কিংবা প্যান্ট পরেনÑ একজন গরুর গোশত খান অপরজন তা খান নাÑ এ ধরনের ঠুনকো পার্থক্যের কারণে কি এমনতরো বিপরীত পরিণতি হতে পারে? এখানেও আমাদের সাধারণ বিবেক বুদ্ধি বলবে যে, এমনটা হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে এ দু’জনের মধ্যে জ্ঞান ও কর্মের পার্থক্যই মূল পার্থক্য।
ইতিহাসের আরেকটি পাতার দিকে আমরা একটু দৃষ্টি দেই। খোলা তলোয়ার হাতে নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত ওমর চলছেন মুহাম্মদ সা:-এর খোঁজে। পথিমধ্যে খবর পেলেন তার নিজের বোন ফাতিমা বিনতে খাত্তাব এবং তার ভগ্নিপতি সাঈদ ইবন যায়েদ রা: ইসলাম গ্রহণ করেছেন। আর যায় কোথায়! ওমর ছুটলেন সে দিকে। আগে নিজের ঘর সামলিয়ে তারপর শত্রু নিধন। বোন ভগ্নিপতি ওমরের টের পেয়ে কুরআন মাজিদের যে অংশটুকু তারা তিলাওয়াত করছিলেন সে অংশটুকু লুকিয়ে ফেললেন। তাঁরা ওমরের মেজাজ এবং দৈহিক শক্তির সাথে পরিচিত ছিলেন। ক্ষিপ্ত ওমর ভগ্নিপতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং আচ্ছামতো প্রহার করতে শুরু করলেন। স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে বোন ফাতিমাও রক্তাক্ত হলেন। দু’জনই ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত। দীপ্তকণ্ঠে বলে উঠলেন, ওমর! সত্যকে বুঝতে পেরেছি, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছি এবং তাঁর ওপর ঈমান এনেছি, তুমি যা চাও করতে পার কিন্তু ঈমান থেকে একচুলও নড়বোনা আমরা। চিরকালীন শান্তশিষ্ট বোনকে এমন দৃঢ়তার সাথে প্রতিবাদ করতে দেখে বিস্মিত ওমর এবং একই সাথে রক্তাক্ত বোনকে দেখে খানিকটা লজ্জিতও বটে। বললেন, ‘কি পড়ছিলে তোমরা আমাকে দেখাও তো।’ কালামে মাজিদের প্রতি কোনো অবজ্ঞা প্রকাশ করবেন না এমন প্রতিশ্রুতি পেয়ে তারা পঠিত বিষয় ওমরের কাছে দিলেন। ওমর পড়তে শুরু করলেন। সূরা ত্বহার এক থেকে সাত আয়াত পর্যন্ত পড়লেন, ‘(হে মানুষ!) তোমাদিগকে কষ্টে ফেলিবার জন্য আমি এই কুরআন নাজিল করি নাই। ইহা তাহাদের জন্যই সতর্কবাণী তাঁহার নিকট হইতে আসিয়াছে- যিনি সৃষ্টি করিয়াছেন এই পৃথিবী আর ওই সুউন্নত আকাশ। যিনি পরম করুণাময় এবং আপন শক্তিতে অটুট। আসমান-জমিনে অথবা উভয়ের মাঝখানে অথবা মাটির নিচে যাহা কিছু আছে সবার ওপর তাঁর সর্বময় প্রভুত্ব এবং তুমি যা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করো তার মর্ম তিনি জানেন আরো জানেন সেই কথা যা তুমি গোপন করিয়া রাখো।’ জ্ঞানচক্ষু খুলে গেল ওমরের! মহিমাময় আল্লাহর ক্ষমতা ও কৌশলের সন্ধান পেলেন আর ছুটে গেলেন নবী সা:-এর কাছেÑ উদ্ধত তরবারি তাঁর পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে, তাঁর হাতে হাত রেখে ঘোষণা করলেন, ‘আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহাদাহু লা শারিকালাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু।’ ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল।’ ঘটনাটি এ জন্যই উল্লেখ করা হলো যে, জ্ঞানই ঈমানের নূর কথাটি বুঝানোর জন্য। ওমর যখন বিশ্বজাহানের স্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে বুঝতে পারলেন; ঈমান আনার ক্ষেত্রে কালবিলম্ব করলেন না। অপর পক্ষে তার শান্তশিষ্ট বোনটি যে কোনো দিন ভাইয়ের সাথে বাদানুবাদ করেনি, সেই বোনটিও বুঝে সুঝে ঈমান আনার কারণে ঈমানের প্রশ্নে আপসহীন ও প্রতিবাদী হয়ে ভাইকে পরিষ্কার করে বলে দিলেন, যা খুশি করতে চাও করতে পারো ; কিন্তু যে সত্য একবার জেনেছি তা থেকে ফিরে আসার কোনো সুযোগ নেই। না বুঝে অথবা না জেনে কিন্তু এমন গভীরভাবে কোনো কিছুর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা যায় না।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার


আরো সংবাদ



premium cement