২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

এই সময়ে ঈদুল আজহার তাৎপর্য

-

এক দিকে করোনার সংক্রমণ ও আতঙ্ক অন্য দিকে ভয়াবহ বন্যা। গরিব মানুষ বন্যায় পানিবন্দী আর ধনীরা করোনা আতঙ্কে ঘরবন্দী। এমনি এক সময়ে আসছে মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা।
বিশ্বজুড়ে চলছে করোনার রাজত্ব। করোনা আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। পুঁজিবাদী সমাজে ধনীরা সাধারণত স্বাধীন থাকে। কিন্তু করোনার ভয়-আতঙ্কে ধনীরাও এখন ঘরবন্দী জীবনযাপন করছে। অদৃশ্য করোনা ধনী-গরিব সবারই স্বাধীনতা হরণ করেছে। উৎসব-আনন্দ সবই আজ সীমিত-বিধিবদ্ধ। তবুও সময় তো থেমে থাকে না, সময়ের পথ বেয়ে আসছে ঈদুল আজহা। আমাদের এই সমাজে সব উৎসবই সামাজিক উৎসব। সবাই চায় যার যার মতো করে উৎসবে মিলে যেতে। উৎসব মানুষকে আত্মকেন্দ্রিকতার বলয় থেকে বের করে মিলনমেলায় মিলিয়ে দেয়। কিন্তু এখন সে মিলনে বাদ সেধেছে কোভিড-১৯ নামক আগ্রাসী এক ভাইরাস। ‘সামাজিক দূরত্ব’ মানুষের সামাজিক মিলনকে সীমিত করে দিয়েছে। মানুষ নতুন স্বাভাবিকতায় নতুন রীতিতে উৎসব উদযাপনের চেষ্টা করছে। ‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়। কারণে ও অকারণে বদলায়, সকাল ও বিকেলে বদলায়।’ মুনির চৌধুরীর বিখ্যাত উক্তি মানবজীবনের বড় সত্য। তবে করোনার কারণে আজ শুধু ব্যক্তি মানুষ নয়, মানুষের জীবন-জীবিকা, সামাজিক সম্পর্ক, উৎসব-আনন্দ, অর্থনীতি, শিষ্টাচার সবই বদলে গেছে। মুসলমানদের বছরে দুটি ঈদ : ঈদুল ফিতর আর ঈদুল আজহা। করোনাকালেই উদযাপিত হয়েছে ঘরবন্দী ঈদুল ফিতর । করোনা কবে যাবে আমরা জানি না। ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদও করোনাকালেই উদযাপন করতে হবে। আমরা আশা আর স্বপ্ন নিয়ে বাঁচি। সময় যতই বিরূপ হোক মানুষ তবুও নতুন স্বপ্ন দেখে, আশায় বাঁধে বুক। করোনার এ ঘোর অমানিশা শেষে আসবে নতুন ভোর। এ আশাতেই স্বাগত ঈদুল আজহা ঈদুল আজহার অন্যতম বিষয় পশু কোরবানি। কোরবানি একটি ইবাদত। ইসলামের সব ইবাদত ও বিধানই মানুষের জন্য কল্যাণকর। এই কল্যাণ জাগতিক ও পরকালীন। কোরবানির সাথে জড়িয়ে আছে মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইব্রাহিম আ: ও তাঁর শিশুপুত্র ইসমাইলের ত্যাগের অনন্য ইতিহাস। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হজরত ইব্রাহিম আ: ওপর নির্দেশ এলো তাঁর প্রিয় পুত্র কুরবানির। তিনি তাঁর পুত্রকে বল্লেন, ‘প্রিয় পুত্র আমি স্বপ্নে দেখেছি, তোমাকে জবাই করছি। এখন তোমার মতামত বল।’ নবীর ছেলে, ভবিষ্যতের নবী। বয়স অল্প হলেও বুঝে ফেললেনÑ এটা মহান আল্লাহ পাকের ওহি এবং আল্লাহর রাহে নিজেকে উৎসর্গ করার সর্বোত্তম সুযোগ। পুত্র ইসমাইল পিতা হজরত ইব্রাহিম আ:-এর ছুরির নিচে মাথা পেতে দিলেন। উৎসর্গ, স্রষ্টার দাসত্ব আর আত্মসমর্পণে এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে। পিতা-পুত্র একই চেতনা আর প্রেরণায় উজ্জীবিত। হজরত ইব্রাহিম আ: ছুরি চালালেন একান্ত প্রিয় শিশু পুত্র ইসমাইলের গলায়। আল্লাহ পাকের উদ্দেশে পিতা-পুত্রের ত্যাগের কী অনন্য দৃষ্টান্ত। আল্লাহ খুশি হন। আল্লাহর কুদরতে পুত্রের বদলে কোরবানি হয় পশু। ‘প্রিয়বস্তু’ উৎসর্গের চরম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন হজরত ইব্রাহিম আ: আর ধৈর্যের পরীক্ষায় পাস করেন হজরত ইসমাইল আ: । এই অনন্য ত্যাগের মহিমাকে স্মরণীয় করে রাখা হয়েছে ঈদে পশু কোরবানির মাধ্যমে। পিতা-পুত্রের সেই অমর স্মৃতিকে মানব জাতির ইতিহাসে জাগরুক রাখতে প্রতি বছর তাঁদের অনুসরণে পশু কোরবানির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আগত ঈদুল আজহায় সারা বিশ্বের মুসলমান দুই হাজার বছরেরও বেশি পুরনো ঐতিহ্যের পুনরাবৃত্তি করে যার যার সাধ্যমতো পশু কোরবানি করবে। ঈদুল আজহা এক দিকে ত্যাগের পরীক্ষা অন্য দিকে আনন্দের উৎসব। পশু কোরবানি দেয়া সামর্থ্যবান মুসলিমের ওপর ওয়াজিব বা বিশেষ কর্তব্য। পশু কোরবানির মাধ্যমে ত্যাগ আর উৎসর্গের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মহান আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনই কোরবানির মূল উদ্দেশ্য। কোরবানি দেয়া পশুর রক্ত-গোশত কিছুই স্রষ্টার কাছে পৌঁছে না, শুধু পৌঁছে তাকওয়া । অনেক মুসলিম এটি বুঝতে না পেরে ত্যাগের উৎসবকে ভোগ আর প্রদর্শনীর মহড়ায় পরিণত করে। অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করে বা মানুষের বাহবা কুড়ানোর জন্য কোরবানির বড় পশু কেনাটা অর্থবিত্তের উৎকট প্রদর্শনী বৈ অন্য কিছু নয়। এটা ধর্ম ও ত্যাগ কোনোটিই নয়Ñ এটা ভোগ আর প্রদর্শনী। বিত্তের প্রতিযোগিতা নয়, বৈভবের প্রদর্শনী নয়, ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে কোরবানি করাই আসল কোরবানি।
পশু জবাইয়ের সাথে সাথে মনের পশুকেও কোরবানি দিতে পারলেই ত্যাগের পরীক্ষায় পাস করে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। একটি জাতির ভাষা, ধর্ম, উৎসব, ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সাহিত্য প্রভৃতি নিয়েই তার সংস্কৃতি। এটি মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম খুব ভালো করে বুঝতেন। সে কারণেই নজরুলের কবিতায় ধর্মীয় উৎসব এবং এর উদ্দেশ্য, তাৎপর্য ও শিক্ষা এসেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘কোরবানি’ কবিতায় কোরবানির আসল উদ্দেশ্য সুন্দরভাবে বলেছেন, ‘ওরে হত্যা নয়’ আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন, দুর্বল ভীরু! চুপ রহো, ওহো খামাখা ক্ষুব্ধ মন! ধ্বনি ওঠে রণি দূর বাণীরÑ আজিকার এ খুন কোরবানির!’ ঈদুল আজহার চাঁদ আনন্দ ও খুশির সাথে বয়ে আনে ত্যাগ আর মনের পশুকে দমন করার বার্তা। বিদ্রোহী কবি নজরুল তার ‘নতুন চাঁদের তকবীর শোন’ কবিতায় দীপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘এল স্মরণ করিয়ে দিতে ঈদজ্জোহার এই সে চাঁদ, (তোরা) ভোগের পাত্র ফেল দে ছুড়ে, ত্যাগের তরে হৃদয় বাঁধ। কোরাস : কোরবানি দে তোরা, কোরবানি দে। প্রাণের যা তোর প্রিয়তম আজকে সেসব আন, খোদার রাহে আজ তাহাদের করবে কোরবান। কি হবে ওই বনের পশু খোদারে দিয়ে (তোর) কাম ক্রোধাদি মনের পশু জবেহ কর নিয়ে। কোরাস : কোরবানি দে তোরা কোরবানি দে।।’ এই করোনাকালে এক দিকে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও সুবিধাবঞ্চিতরা জীবন ও জীবিকা উভয়ের জন্যই লড়াই করছে। দেশের বড় একটা অংশ বন্যাকবলিত। বানভাসি মানুষের দুঃখকষ্টের সীমা নেই। এর মধ্যেও একশ্রেণীর মানুষের লোভ আর ভোগের পেয়ালা উপচে পড়ছে। এরা কী লোভকে দমন করে ভোগকে কমিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে? যদি না দাঁড়ায় তা হলে তার পশু কোরবানি বৃথা। যে আল্লাহ পাকের উদ্দেশ্যে কোরবানি, তার অভুক্ত-অসহায় বান্দার প্রতি মমতা ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া ঈদুল আজহার অন্যতম শিক্ষা। মানুষের কবি নজরুল তার এক কবিতায় বলেছেন, ‘তোর পাশের ঘরে গরিব কাঙাল কাঁদছে যে তুই তাকে ফেলে ঈদগাহে যাস সঙ সেজে, তাই চাঁদ উঠল, এল না ঈদ, নাই হিম্মৎ, নাই উন্মিদ, শোন কেঁদে বেহেশত হতে হজরত আজ কি চাহে।।’ লোভ-লালসা, অতিভোগ, দ্রুত অবৈধভাবে ধনী হওয়ার জন্য দুর্নীতি অনেক মানুষকে আজ মানুষের মহত্তম আসন থেকে পশুরও অধম অবস্থানে নামিয়ে এনেছে।
আল্লাহ ভীতি, আত্মমর্যাদা, প্রজ্ঞা, মানুষের প্রতি মমতা-ভালোবাসা, ত্যাগের মানসিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ আজ বড় প্রয়োজন। এ বছরের ঈদুল আজহা দরদি সমাজ আর মানবিক পৃথিবী গড়ায় মানুষের ভেতরের পশুত্বকে দমিয়ে মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলার আকুতি নিয়ে হাজির হয়েছে। সাহায্যের হাত প্রসারিত হোক। বানভাসি মানুষের পাশে থাকুক সচ্ছল ও তুলনামূলক স্বস্তিতে থাকা মানুষগুলো।
লেখক : ডেপুটি ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড

 


আরো সংবাদ



premium cement
রাশিয়া সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টে ১৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে সিরিয়ায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৩৬ সেনা সদস্য দৌলতদিয়া ঘাটে পন্টুন থেকে নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু অ্যানেসথেসিয়ার পুরনো ওষুধ বাতিল করে কেন নতুনের জন্য বিজ্ঞপ্তি! বাইডেনের মেয়াদে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতির কোনো আশা নেই : রুশ রাষ্ট্রদূত ডিএমপির অভিযানে গ্রেফতার ৪০ নিউইয়র্কে মঙ্গোলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ফ্ল্যাট জব্দ করবে যুক্তরাষ্ট্র! টাঙ্গাইলে লরি-কাভার্ডভ্যান সংঘর্ষে নিহত ১ জিম্বাবুয়ে সিরিজে অনিশ্চিত সৌম্য বেনাপোল সীমান্তে ৭০ লাখ টাকার স্বর্ণের বারসহ পাচারকারী আটক ৪ বিভাগে হতে পারে বজ্রসহ বৃষ্টি!

সকল