২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কূটনীতি ও ইসলাম

-

ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। মানুষের জীবন চলার যাবতীয় আশয়-বিষয় ইসলামে রয়েছে। মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসহ অন্যান্য সব সমস্যার সমাধান দিয়েছে ইসলাম। তাই ইসলাম কূটনৈতিক ব্যবস্থারও বাইরে নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে কূটনীতি হচ্ছেÑ ওইসব নীতি বা কাজ যেখানে ইসলামী নিয়মনীতি মেনে চলা হয়। ইসলামী নৈতিকতা সমর্থন করে না এমন বিষয় যেমনÑ প্রবঞ্চনা, মিথ্যা, ধূর্তামি পরিত্যাগ করে ইসলামী রাষ্ট্র ও এর অধিবাসীদের কল্যাণে অন্যান্য রাষ্ট্র বা সম্প্রদায়ের সাথে নিবিড় ও যৌক্তিক সম্পর্ক যখন গড়ে তোলা হয় অথবা কূটনৈতিক সম্পর্ক যখন ইসলামী নিয়মনীতি অনুসরণ করে ও মুসলমানদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে মতবিনিময় করা হয় তখন তাকে কূটনীতি বলা হয়।
ইসলাম শান্তির ধর্ম। বিভেদ, হানাহানি, শত্রুতা ইত্যকার যাবতীয় খারাপ কাজ ইসলামে নিষিদ্ধ। তাই ন্যায়, ইনসাফ ও সমতার ভিত্তি হচ্ছে ইসলামী কূটনীতির মূল বিষয়। মুসলমানরা ইসলাম প্রদর্শিত কূটনীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইনসাফভিত্তিক সম্পর্ক গড়ে তুলবে এবং পরস্পরের মধ্যে বিবাদগুলোর শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়পূর্ণ সমাধান করবে। ইসলামের আবির্ভাব ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক রক্ষার্থে শুরু হয় এর বাস্তব প্রক্রিয়া ও কার্যক্রম। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর নবী মুহাম্মদ সা: স্বয়ং কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি বিভিন্ন দেশ ও রাজন্যবর্গের সাথে দূত ও প্রতিনিধি প্রেরণের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালান।
পরবর্তী সময়ে তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি খলিফারা ও রাষ্ট্রপ্রধানরা মহানবী সা: প্রতিষ্ঠিত পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছিলেন। ফলে ইসলামী কূটনীতির সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার প্রভাব মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। এ জন্য দলে দলে লোক এসে ইসলামের ছায়াতলে একত্র হয়। এর ফলে একের পর এক রাষ্ট্র ইসলামী সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। কিন্তু কালের চক্রে মানুষ হয়ে পড়ে বিভ্রান্ত। দেশে দেশে শুরু হয় দ্বন্দ্ব, সঙ্ঘাত আর হানাহানি। এ ক্ষেত্রে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোও ব্যতিক্রম নয়। এর অন্যতম কারণ ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত ইসলামের অনুশাসন থেকে পিছিয়ে পড়া। এই প্রেক্ষাপটে আজ নতুন করে ইসলামী কূটনীতির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক এবং বিরাজমান সমস্যা সমাধানের গ্যারান্টি হচ্ছে ইসলামী কূটনীতির সফল বাস্তবায়ন।
ইসলাম আগমনের আগে আরবসহ গোটা বিশ্ব নৈতিক অবক্ষয়ের তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছিল। তখন মুক্তির বারতা নিয়ে দুনিয়ায় আসেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:। তিনি এসে নৈতিকতার উৎকর্ষের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। সমাজের মানুষ ও বিভিন্ন গোত্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রেও তিনি নৈতিকতাকে গুরুত্ব দেন।
বিদেশী রাজদরবারে সাময়িকভাবে দূত পাঠানোর দৃষ্টান্ত স্মরণাতীতকাল থেকেই প্রচলিত আছে। সুতরাং রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নবী করিম সা: বিভিন্ন সময় দেশে দেশে দূত বা কূটনৈতিক প্রতিনিধি পাঠাতেন। আল্লাহর নবী সা:-এর অনুমতি পেয়ে মুসলমানরা আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। মুসলমানদের দলকে ফিরিয়ে আনার জন্য কুরাইশরা উদ্যোগ নিলো। তারা আবিসিনিয়ায় গিয়ে সেখানকার বাদশাহ নাজ্জাশিকে প্ররোচিত করেছিল। কুরাইশদের এ দুরভিসন্ধি বানচাল করার উদ্দেশ্যে নবী করিম সা: পদক্ষেপ নিলেন। দ্বিতীয় হিজরিতে তিনি আমর বিন উমাইয়া আদ-দামরিকে আবিসিনিয়ায় দূত হিসেবে (বর্তমান ইথিওপিয়া) প্রেরণ করেন।
মহানবী সা: তাঁর দীনের কাজকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা এবং মুসলিম স্বার্থকে নিশ্চিত করতে একজন সফল কূটনীতিকের পরিচয় দেন। তিনি মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় গিয়ে দীন প্রচারের কাজ শুরু করলেন। সেখানকার সমাজ নানা গোত্র ও জাতিতে বিভক্ত ছিল। তাই মদিনায় সুষ্ঠুভাবে কাজ করার জন্য তাঁর প্রথম কাজ ছিল সেখানে একটি সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করা। তখন মদিনায় ইহুদিরা ছিল নানা দিক থেকে শক্তিশালী। ফলে মদিনাবাসী ও ইহুদিদের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদন করা ছিল খুবই জরুরি। প্রথমবারের মতো তিনি একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এই গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিকে ‘মদিনার সনদ’ বলা হয়। এটি ছিল পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান। মদিনা সনদে স্পষ্টভাবে স্বীকার করা হয় যে, সব রকমের বিবাদ মীমাংসার জন্য মহানবী সা:-এর শরাণপন্ন হতে হবে।
এ সম্পর্কে স্কটিশ ইতিহাসবিদ (এডিনবার্গ বিশ^বিদ্যালয়ের আরবি ও ইসলামী স্টাডিজের অধ্যাপক) মন্টোগোমারি ওয়াট (১৯০৯-২০০৬) যথার্থই বলেছেন, ‘বিবাদ মীমাংসার জন্য মহানবী সা:-এর শরণাপন্ন হওয়ার শর্ত থাকার কারণে তাঁর শক্তি বৃদ্ধি পায়নি। কিন্তু সব বিবাদের মীমাংসা তিনি এমন নিখুঁত ও কূটনৈতিকভাবে সমাধান করতেন যা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় এবং এ কারণে তাঁর ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়।’
এ কথা সত্য যে, মহানবী সা: মদিনায় হিজরতের মাধ্যমে মক্কার সাথে বিছিন্ন হয়ে পড়েন। তবে মক্কায় তখনো ছিল অনেক মুসলমান। মক্কায় ইসলাম প্রচারের কাজ ধীরে হলেও গোপনে চলছিল। আর মক্কাতে দীনের প্রচার সম্প্রসারণ করাও ছিল নবীজীর অন্যতম লক্ষ্য। এ জন্য দীন প্রচারের স্বার্থে কুরাইশদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করা ছিল খুবই জরুরি। কুরাইশদের সাথে আলোচনায় মহানবী সা: সবচেয়ে বেশি কূটনৈতিক সফলতা অর্জন করেন হুদায়বিয়ার চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে। মক্কা থেকে হিজরত করার ছয় বছর পর এই চুক্তি সম্পাদিত হয়। ৬২৮ সালে নবী করিম সা: প্রায় চৌদ্দশ মদিনাবাসী সাহাবিকে নিয়ে হজব্রত পালনের জন্য মক্কার পথে যাত্রা করেন। তখন হজ পালনের জন্য মক্কার লোকেরা যে অধিকার ও সুবিধা ভোগ করত মদিনাবাসীর জন্যও সেই অধিকার ও সুবিধা প্রচলিত ছিল। কিন্তু মক্কাবাসীরা এই প্রচলিত নিয়ম লঙ্ঘন করে মদিনাবাসীদের হজ পালনে বাধা দেয়। উল্টো তারা মদিনাবাসীর সাথে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নেয়।
মক্কার খোজা গোত্রের নেতা মাদিলের কাছে নবী করিম সা: মক্কাবাসীর এই দুরভিসন্ধির কথা জানতে পারেন। তাই আল্লাহর নবী সা: মক্কা শহরে প্রবেশ করার পরিবর্তে হুদায়বিয়া গ্রামে শিবির স্থাপন করেন। মাদিলের মারফতে নবী করিম সা: কুরাইশদের কাছে এই বলে খবর পাঠান যে, তিনি শুধু হজ পালনের উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন। যুদ্ধ করা তাঁর উদ্দেশ্য নয়। এ সময় একজন কুরাইশ দূত নবী করিম সা:-এর কাছে আসে আলোচনার জন্য। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হলো না। এরপর মুহাম্মদ সা: সমস্যা সমাধানকল্পে মক্কায় একজন দূত প্রেরণ করলে কুরাইশরা নবীর দূতের উটকে হত্যা করে। শুধু তাই নয়। তারা মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করার জন্য সৈন্য পাঠায়। মুসলমানরা তাদের বন্দী করে রাখে। কিন্তু মহানবী সা: প্রতিশোধ না নিয়ে কূটনৈতিকভাবে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করেন এবং ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে কুরাইশদের মুক্তি দেন। পরে মহানবী সা: হজরত উসমান রা:-কে দূত হিসেবে মক্কায় প্রেরণ করেন। কুরাইশরা তাকেও আটক করে রাখে এবং কয়েক দিন পর গুজব রটে যে, হজরত উসমান রা:-কে হত্যা করা হয়েছে। এই খবর পাওয়ার পর সাহাবিদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। তাঁরা এই হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।
অবশেষে মহানবী সা: সাহাবিদের নিয়ে দূত হত্যার বদলা নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ঠিক তখনই শান্তি আলোচনার জন্য কুরাইশদের দূত হুদায়বিয়া গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হয়। বহু আলোচনার পর বিভিন্ন শর্তসাপেক্ষে এক ঐতিহাসিক সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তি ‘হুদাইবিয়ার সন্ধি’ নামে পরিচিত। উপরিউক্ত আলোচনায় নবী করিম সা:-কে আমরা একজন বিজ্ঞ কূটনীতিক হিসেবে দেখতে পাই। অত্যন্ত নাজুক ও বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যেও স্বীয় মর্যাদা ও অবস্থান বজায় এবং দীনি মর্যাদা অক্ষুণœ রেখে আদর্শের বাস্তবায়নের প্রত্যয়ে আল্লাহর নবী কতটা পারদর্শী ছিলেন তা তাঁর এসব কর্মকাণ্ড থেকে অনুধাবন করা যায়। একজন আদর্শ কূটনীতিকের পরিচয় আমরা পাই আল্লাহর নবীর চরিত্রে। আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি, মহানবী সা: তাঁর কূটনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অবস্থাভেদে কখনো দৃঢ়তা অবলম্বন করেছেন, কখনো বা নম্রতা প্রদর্শন করেছেন। অর্থাৎ মহানবী সা: প্রয়োজনবোধে সময়োচিত ব্যবহার করতে সক্ষম ছিলেন। দার্শনিক ও বাস্তববাদী ব্যক্তির গুণের এক অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল ছিল তার মধ্যে। নিজের অনুসারীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার-বিশ্লেষণ করে দ্রুত তথা আড়ম্বরহীন পদ্ধতিতে আলোচনা চালিয়ে তিনি এমন এক চুক্তি সম্পাদন করেন যা দূরদৃষ্টি, ধৈর্য, বিশ্বাস, কৌশল ও ন্যায়বিচারের আদর্শ হিসেবে বিবেচ্য। হুদায়বিয়ার সন্ধিতে মহানবী সা: কুরাইশদের অনেক ছাড় দেন। ফলে এই চুক্তি নিয়ে অনেক মুসলমান নানা প্রকার প্রশ্ন তোলেন। তারপরও এই চুক্তি ছিল মুসলমানদের জন্য বিরাট সাফল্য। আল্লাহ তায়ালা হুদায়বিয়ার সন্ধিকে ঐতিহাসিক বিজয় বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিঃসন্দেহে আমি তোমাকে সুস্পষ্ট বিজয়ে বিজয়ী করেছি।’- সূরা আল-ফাতহ, আয়াত : ১
এভাবে কূটনৈতিক পারদর্শিতা ও দক্ষতা দিয়ে আল্লাহর নবী ও তাঁর খলিফারা অনেক ক্ষেত্রে বিজয় ও সাফল্য লাভ করেছেন। ইসলামের এই কূটনীতিতে কূটকৌশল বা চালাকি ছিল না। বরং এতে ছিল নৈতিকতা ও সততার পরম বাস্তবতা। সচ্ছতা ও নীতির কোনো ব্যত্যয় ইসলামী কূটনীতিতে ঘটেনি।


আরো সংবাদ



premium cement
থামছে না পুঁজিবাজারে পতন বিনিয়োগকারীদের আর্তনাদ ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ভোট শুরু: নাগাল্যান্ডে ভোটার উপস্থিতি প্রায় শূন্য কারাগার এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী আন্দোলনে ব্যর্থ বিএনপির হাল ধরার কেউ নেই : ওবায়দুল কাদের পাবনায় ভারতীয় চিনি বোঝাই ১২টি ট্রাকসহ ২৩ জন আটক স্বচ্ছতার সাথে সরকারি অনুদানের চলচ্চিত্র বাছাই হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী মিয়ানমার বিজিপির আরো ১৩ সদস্য পালিয়ে এলো বাংলাদেশে শ্যালকের অপকর্মে দুঃখ প্রকাশ করলেন প্রতিমন্ত্রী পলক মন্দিরে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ তুলে ২ ভাইকে হত্যা ইরানে ইসরাইলি হামলার খবরে বাড়ল তেল সোনার দাম যতই বাধা আসুক ইকামাতে দ্বীনের কাজ চালিয়ে যাবো : ডা: শফিকুর রহমান

সকল