১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

তাজউদ্দীন মেডিক্যালে লিফটে আটকে রোগীর মৃত্যু : স্বজনদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ

ঘটনাস্থলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের তদন্ত টিম
লিফটে আটকে রোগীর মৃত্যু : স্বজনদের বিরুদ্ধে দরজা ধাক্কা দেয়ার অভিযোগ - ছবি : নয়া দিগন্ত

গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের লিফটে আটকে থেকে রোগী মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদফতরকে চিঠি দিয়ে অবহিত করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চিঠিতে ‘লিফটে আটকে পড়া রোগীসহ লোকজন দরজা ধাক্কাধাক্কি করায় লিফটের দরজার নিরাপত্তা ব্যবস্থা (Door Safety) কাজ করে নাই’ বলে দাবি করা হয়।

চিঠিতে আরো দাবি করা হয়,‘লিফটে রোগীসহ অন্যরা ৪৫ মিনিট নয়, মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিট আটকে ছিলেন’।

সোমবার শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. জাহাঙ্গীর আলম চিঠি পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন গণপূর্ত বিভাগের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এদিকে হাসপাতালের লিফটে আটকা পড়ে রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় গঠিত স্বাস্থ্য অধিদফতরের তিন সদস্যের তদন্ত টিম সোমবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়েছেন।

রোববার বিকেলে হাসপাতালের পক্ষ থেকে অবহিতকরণ চিঠিটি স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবরে পাঠানো হয়েছে। শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. জাহাঙ্গীর আলম ও গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-১০, ঢাকার নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হালিম ওই চিঠিতে যৌথ স্বাক্ষর করেন।

শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, গাজীপুরে লিফটে আটকা পড়ে রোগী মৃত্যু সম্পর্কে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করণ প্রসঙ্গে লেখা ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, রোববার বেলা সোয়া ১১টার দিকে হাসপাতালের ৯ম ও ১০ম তলার মাঝখানে মুভি ব্র্যান্ডের (Movi Brand) একটি লিফট রোগী ও দর্শণার্থীসহ হঠাৎ আটকে যায়। প্রাথামিকভাবে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে লিফটটি আটকে গেলে লিফটটির ARD (স্বয়ংক্রিয় রেসকিউ ডিভাইস) কাজ করার জন্য ০১ (এক) মিনিট সময়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু লিফটে থাকা লোকজন ও আটকে পড়া রোগীসহ তাদের স্বজনেরা দরজা ধাক্কা-ধাক্কি করায় লিফটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা (Door Safety) কাজ করে নাই। পরবর্তীতে লিফট অপারেটর লিফট মেশিন কক্ষে হাত দিয়ে ম্যানুয়ালি লিফটটি একটি ফ্লোরে আনার পূর্বেই রোগীসহ লোকজন দরজা খুলে বের হয়ে আসে। এসব কাজ সম্পন্ন করতে ১০-১৫ মিনিট সময় অতিবাহিত হয়।

মাঝপথে ত্রুটি দেখা দেয়া লিফটটি আগে থেকে ত্রুটিপূর্ণ ছিল না দাবি করে চিঠিতে লিফটটির সম্পর্কে বলা হয়েছে, লিফটটি নিয়মিত সার্ভিস ও মেইনটেনেন্স করা হয় এবং বর্তমানে লিফটটি চালু আছে। আটকে পড়া রোগীসহ অন্যান্য লোকজন দরজা ধাক্কা-ধাক্কি করায় লিফটির সমস্যা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। ঘটনারটির সঠিক কারণ অনুসন্ধানের ইতোমধ্যেই অত্র কার্যালয়ের স্মারক নং-১০২১, তারিখ-১২/০৫/২০২৪খ্রিঃ মোতাবেক ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে (কপি সংযুক্ত)।

রোগীর অসুস্থতা নিয়ে চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, রোগীটি (নিহত মমতাজ) হার্টের রোগী ছিলো। তাৎক্ষণিক রোগীকে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয় এবং কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। গণমাধ্যমকেও চিঠিতে ভুল তথ্য প্রচারের জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে রোগী ৪৫ মিনিট লিফটে আটকে থাকার তথ্য সঠিক নয়।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তদন্ত টিম তাজউদ্দীন মেডিক্যালে
গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে লিফটে আটকা পড়ে রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় গঠিত স্বাস্থ্য অধিদফতরের তদন্ত টিম সোমবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান। তিন সদস্যের তদন্ত টিমের নেতৃত্ব দেন কমিটির প্রধান স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (ডেন্টাল) ডা. মাহমুদা বেগম।

কমিটির অন্য দুই সদস্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো: খায়রুজ্জামান ও সহকারি পরিচালক মো: মাসুদ রেজা খানও তার সাথে ছিলেন।

তদন্ত কমিটির প্রধান বলেন, রোববার সকালে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে লিফটে আটকে পড়ে নিহত হওয়ার খবর মিডিয়ায় প্রচার হওয়ার পর ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে ঘটনার তদন্তে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। তিন কার্যদিবসের মধ্যে এ তদন্তের প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। সোমবার শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মো: আমিনুল ইসলাম, উপ-পরিচালক মো: জাহাঙ্গীর আলমসহ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক, নার্স, লিফটের অপারেটর, ওয়ার্ডবয়, গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বক্তব্য নেয়া হয়েছে। তদন্তে লিফটি বন্ধের কারণ, তা কতক্ষণ বন্ধ ছিল, লিফটে আটকা পড়া লোকজন কিভাবে উদ্ধার হলো, রোগী মৃত্যুর ঘটনায় কারো কোনো অবহেলা ছিল কি-না সবকিছু খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

তদন্ত টিমের সদস্য উপ-পরিচালক মো: খায়রুজ্জামান বলেন, রোগীর স্বজনদের সাথেও এ ব্যাপারে কথা বলা হবে। তাদের সাথে টেলিফোনে কিংবা ফোন করে নিয়ে এসে কথা বলা হবে।

সহকারি পরিচালক মো: মাসুদ রেজা খান বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পরে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে ৩ নম্বর লিফটি থেমে যায়। লিফটের ভেতর নিহত রোগীসহ তার স্বজন ও অন্যান্যরা ১০ মিনিটের মতো আটকে ছিল। ১০ মিনিট পরে তাদের উদ্ধার করে আনা হয়। আর রোগীর স্বজনরা ৪০ মিনিট ভেতরে আটকে থাকার কথাও আমরা খতিয়ে দেখছি। তবে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে ঘটনার সময় ওই লিফটের ভেতরে কোনো লিফটম্যান বা কোনো অপারেটর ছিল না। আমরা নিহতের স্বজনদের সাথেও কথা বলার জন্য তাদের মোবাইলফোন নম্বর সংগ্রহ করেছি।

এ ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে। তারাও তদন্ত শুরু করেছে বলেন হাসপাতালের পরিচালক মো: আমিনুল ইসলাম।

উল্লেখ্য, গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের লিফট আটকে রোগী মমতাজ বেগমের (৫৩) মৃত্যু হয়। তিনি গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার বারিগাঁও গ্রামের শরীফ উদ্দীনের স্ত্রী। রোববার বেলা ১১টায় ১১তলার মেডিসিন বিভাগ থেকে সিসিইউতে স্থানান্তরের সময় পৌণে একঘণ্টা লিফটে আটকে থেকে রোগীর মৃত্যু হয়। নিহতের স্বামীসহ স্বজনদের দাবি, লিফটের ভেতর থেকে আটকেপড়াদের উদ্ধারের জন্য বারবার আবেদন জানালেও লিফট অপারেটরসহ সংশ্লিষ্টরা কোনো উদ্যোগ না নিয়ে সেখান থেকে তারা চলে যায়। একপর্যায়ে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯ এ ফোন করা হলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে মমতাজের লাশসহ আটকেপড়াদের লিফটের ভেতর থেকে উদ্ধার করে।

এরআগে, গত ৪ মে রাত পৌনে ১১টার দিকে একই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী জিল্লুর রহমান (৭০) হাসপাতালের ১২তলার ভেতরের দেয়াল ও মেঝের মধ্যে থাকা ফাঁকা স্থান দিয়ে ১০ তলায় পড়ে মারা যান। তিনি গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রামের কাসেম আলীর ছেলে। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সপ্তাহ খানেকের মধ্যে এবার লিফটে আটকে রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এতে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। তারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব অবহেলা ও অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন। এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও উপযুক্ত শাস্তির দাবি করেছেন তারা।


আরো সংবাদ



premium cement