১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

শোলাকিয়ায় পাঁচ লাখ মুসল্লির ঈদের নামাজ আদায়

শোলাকিয়ায় পাঁচ লাখ মুসল্লির ঈদের নামাজ আদায় - ছবি : নয়া দিগন্ত

কিশোরগঞ্জের আকাশ সকাল থেকেই ছিল কিছুটা মেঘাচ্ছন্ন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে তাপমাত্রা। তবে আগের কয়েকদিনের মতো তাপমাত্রা বেশি ছিল না। সূর্য ছড়িয়ে দেয় নরম আলো।

এমন আবহাওয়ায় ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ঈদগাহে পাঁচ লাখ মুসল্লির অংশগ্রহণে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় ঈদের জামাত শুরু হয়। এবার ছিল সেখানে ১৯৭তম ঈদুল ফিতরের জামাত।

জামাতে এবার স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি মুসল্লি অংশ নেন।

২০০ বছরের ইতিহাসে করোনা মহামারির কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে এ মাঠে বন্ধ ছিল ঈদ জামাত।
গত ২০২২ সাল থেকে আবার আগের ধারাবাহিকতায় মাঠে নামাজ শুরু হয়। এবার মানুষের আগ্রহ ছিল এই মাঠের দিকে বেশি।

ঈদগাহ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ ধারণা দেন, এবার শোলাকিয়া ঈদগাহে ঈদুল ফিতরে জামাতে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ অংশ নেয়।

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এই ঈদ জামাতে দূর-দূরান্ত থেকে আসা মুসল্লিরা দেশ, জাতি ও মুসলিম উম্মার শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় দোয়া করেন। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সকাল থেকেই মুসল্লিরা মাঠের দিকে আসতে থাকে। এক পর্যায়ে মুসল্লিদের ঢল নামে শোলাকিয়া মাঠের দিকে, যা পরিণত হয় জনসমুদ্রে।

এবারো মাঠে জায়নামাজ ছাড়া কোনোরকম ব্যাগ ও মোবাইল নিয়ে আসা ছিল নিষিদ্ধ। অন্তত ১০টি নিরাপত্তা তল্লাশির ভেতর দিয়ে মাঠে প্রবেশ করতে হয়েছে মুসল্লিদের। মাঠ ও এর আশপাশে ছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চার স্তরের নিরাপত্তা।

সিসি ক্যামেরায় মনিটর করা হয় মাঠের ভেতর ও চারপাশ। মাঠের চারপাশে ছিল ছয়টি ওয়াচ টাওয়ার। চারটি শক্তিশালী ড্রোন ক্যামেরায় মনিটর করা হয় মাঠ ও এর আশপাশ এলাকা।

সকাল ৮টার দিকেই মুসল্লিতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় মূল মাঠ। জামাত শুরু আগেই মাঠ ছাড়িয়ে আশপাশের রাস্তা, ফাঁকা জায়গা, বাড়ি, বাড়ির ছাদে মুসল্লিরা নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। ১০টা বাজতেই ঐতিহাসিক এই মাঠের ইমাম এলান দেন, শোলাকিয়ার ১৯৭তম ঈদুল ফিতরের জামাত শুরু হতে যাচ্ছে।

দীর্ঘ দিনের রেওয়াজ অনুযায়ী জামাত শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিট, তিন মিনিট ও এক মিনিট আগে যথাক্রমে তিনটি, দু’টি ও একটি গুলির আওয়াজ করা হয় শটগানে। শুরু হয় ঐতিহাসিক শোলাকিয়ায় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদ জামাত।

জামাতে ইমামতি করেন মাওলানা শোয়াইব বিন আবদুর রউফ।

জেলা প্রশাসক মো: আবুল কালাম আজাদ, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মো: জিল্লুর রহমান, কিশোরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মাহমুদ পারভেজসহ বিশিষ্টজনেরা এ জামাতে শরিক হন।

নামাজ শেষে মুসল্লিদের জন্য দিক-নির্দেশনামূলক খুতবা দেন ইমাম। এরপর কাঙ্ক্ষিত মোনাজাত।

মাঠের লাখো মানুষ অংশ নেন মোনাজাতে। দেশের সমৃদ্ধি, পাপ থেকে মুক্তি এবং পরম করুাণাময়ের অপার সন্তুষ্টি অর্জনে দু’হাত তুলে কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকে।

মাঠে নামাজ পড়তে আসা কটিয়াদীর করগাঁও গ্রামের আব্দুল মান্নান (৬২) জানান, ৪০ বছর ধরে তিনি এই ঈদগাহে নামাজ পড়েন। ছোট সময় বন্ধুবান্ধব মিলে ফজরের সময় রওনা হতেন এই মাঠের দিকে।

সাংবাদিক শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ জানান, এলাকায় এই ঈদগাহকে ‘ঈদগানা’ বলা হয়।

কিশোরগঞ্জ শহরের পূর্ব প্রান্তে শোলাকিয়া এলাকায় নরসুন্দা নদীর তীর ঘেঁষে শোলাকিয়া ঈদগাহের অবস্থান। প্রায় সাড়ে ছয় একর আয়তনের ঈদগাহে মাঠের ভেতরে স্বাভাবিক অবস্থায় এক লাখ ৬৫ হাজার মুসল্লির ধারণক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, এখানে প্রতিবছর ঈদের নামাজে অংশ নেন লাখ লাখ মুসল্লি।

মাঠের ভেতরেই দুই লাখের বেশি মুসল্লি ঠাসাঠাসি করে নামাজ পড়েন। আর মাঠের বাইরে রাস্তা-ঘাট ও পেছনে অংশ নেন আরো দুই থেকে আড়াই লাখের মতো মানুষ। দেশ-বিদেশের লাখো মুসল্লির সমাগমে মুখরিত হয়ে ওঠে শোলাকিয়া ও এর আশপাশ। এবার মুসল্লিদের অংশগ্রহণ ছিল আরো বেশি।

বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম বীর ঈশা খাঁর ১৬তম বংশধর দেওয়ান মান্নান দাঁদ খান ১৮৫০ সালে শোলাকিয়া ঈদগাহের জন্য জমি ওয়াক্ফ করেন। তারও ২০০ বছর আগে থেকে শোলাকিয়া মাঠে ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হচ্ছে বলে ওই ওয়াক্ফ দলিলে উল্লেখ আছে। লাখো মুসল্লির সাথে এক কাতারে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ পড়লে বেশি সওয়াব পাওয়া যায়, এমন ধারণা থেকে প্রতিবছর এখানে দেশ-বিদেশের কয়েক লাখ মুসল্লির ঢল নামে। বংশ পরম্পরায় এ মাঠে নামাজ পড়ে আসছেন অনেকে।

১৮২৮ সালে শোলাকিয়া মাঠে সোয়া লাখ মুসল্লি এক সাথে ঈদের নামাজ আদায় করেন। সেই থেকে এ মাঠের নাম হয় ‘সোয়া লাখিয়া’। যা এখন শোলাকিয়া নামে পরিচিত।


আরো সংবাদ



premium cement