অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ দ্বন্দ্ব, সবুজের খুন হওয়া সিনেমার ঘটনাকেও হার মানাবে
- হারুন আনসারী, ফরিদপুর
- ০৫ জুলাই ২০২২, ২২:২৭, আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২২, ২২:৩০

ফরিদপুরের সদর উপজেলার ডিক্রিরচর ইউনিয়ন থেকে পদ্মা নদীর ভাঙ্গনের কারণে ২০০৪ সালের দিকে শহরের বায়তুল আমানে এসে আশ্রয় নিয়েছিলো রাজমিস্ত্রী শহীদ মোল্যা। নদী ভাঙ্গনের শিকার প্রায় শতাধিক পরিবারের কারণে একসময়ের বিরান হয়ে থাকা বায়তুল আমানের ক্ষেত-খামারবিস্তৃত ওই এলাকাটি রেলবস্তি নামে ক্রমেই ঘিঞ্জি ও নানা অপরাধের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠে। সে সময়ে ওই এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতো ফরিদপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী হাতকাটা শাহীন ও তার বাহিনী। রাতের বেলায় শহর থেকে বাড়ি ফেরার পথে স্থানীয় মানুষদেরও গা ছমছম করতো।
২০১৫ সালের ৫ ডিসেম্বর সদর উপজেলার কৈজুরি ইউনিয়নের পিয়ারপুর বাজারের কাছে পাওয়া যায় ১৮ মামলা ও ৫৪ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি হাতকাটা শাহীনের গুলিবিদ্ধ লাশ। তার আগে যশোর থেকে ডিবি পরিচয়ে শাহীনকে তুলে নেয়ার অভিযোগ করেন তার স্ত্রী। পুলিশ অবশ্য ক্রসফায়ারে শাহীনের মৃত্যুর সত্যতা স্বীকার করেনি। শাহীনের পর একই পরিণতি ঘটে ওই এলাকার আরেক ত্রাস জুলহাসেরও। এরপর বায়তুল আমানে দীর্ঘদিন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায়
থাকলেও গত কয়েক বছর যাবত সেখানে রেলবস্তিকে ঘিরে আবির্ভাব হতে থাকে নতুন নতুন ত্রাস। দুই বছর আগে বিশেষ অভিযানে শহরের এক ডজন শীর্ষসন্ত্রাসীর পতন হওয়ার আগেও সেখানে রীতিমতো অফিস-আদালত বসিয়ে ব্যবসা ও বিচার চালাতো সন্ত্রাসীরা।
জেলা সদরের রাজনীতিতে বিপুল ক্ষমতাধর মোশাররফপন্থীদের পতনের পর সেখানে অপরাধ সাম্রাজ্যেরও হাতবদলের মতো প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য ব্যবসার নিয়ন্ত্রণও হাতবদল হয়। স্থানীয়রা বলছে, হাতকাটা শাহীনের মৃত্যুর পর ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয় শাহীনের সহোদর ভাই জেলা শহর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক তরিকুল ইসলাম নাসিম। হেলমেট বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হয়ে ফরিদপুরের পাসপোর্ট অফিসসহ আরো কিছু সরকারি দফতর ও ব্যবসার একক নিয়ন্ত্রণ করতো নাসিম। তবে দুই হাজার কোটি টাকা মানিলন্ডারিং মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি হয়ে নাসিম এখন পলাতক। সেই সুবাদে নাসিমের অপরাধ সাম্রাজ্যের স্বর্গরাজ্যখ্যাত বায়তুল আমান রেলবস্তির নিয়ন্ত্রণে গড়ে উঠে নতুন মুখ। এ নিয়ে সেখানে নতুন বিবাদও সৃষ্টি হতে থাকে।
জানা গেছে, রেলবস্তি এলাকার নিয়ন্ত্রক হিসেবে সেখানে স্থানীয় একটি শক্তিশালী গ্রুপের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েন উঠে নদীভাঙ্গনের শিকার হয়ে আসা এক পরিবারের সন্তান সবুজ মোল্যা (২৯)। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় এক নেতার সরাসরি ডানহাত বামহাত হয়েন উঠেন তিনি। বায়তুল আমানে ব্রডব্যান্ড লাইনের সাব লাইন নিয়ে ওই এলাকার ইন্টারেনেট লাইনের ব্যবসার একক নিয়ন্ত্রণ নেন সবুজ। ওই নেতার প্রশ্রয়ে এলাকার উঠতি যুবকদেরও নেতৃত্ব চলে আসে তার হাতে। নিজে পড়াশোনা না করলেও ছাত্রলীগের ছেলেদের নেতৃত্ব দিতেন তিনি। তাদের পেছনে টাকাপয়সা খরচ করে তাদের নেতৃস্থানীয় হয়ে উঠেন তিনি।
শহরের উপকন্ঠে বায়তুল আমানে রয়েছে রাজেন্দ্র কলেজের অনার্স-মাস্টার্স শাখার ক্যাম্পাস ও একাধিক ছাত্রাবাস। ফরিদপুরের বিশিষ্ট রাজনীতিবীদ ও সমাজসেবক মরহুম মোহন মিয়ার উদ্যোগে একটি শিক্ষানগরী হিসেবে বায়তুল আমান নামে একটি বিশেষ প্রকল্প হিসেবে এলাকাটিকে গড়ে তোলা হয়। গত কয়েক বছরে এখানে ফরিদপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও কমার্স কলেজসহ আরো কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবাসিক হল ও মেসের ছাত্রদের ব্যবহার করার ফলে ছাত্র না হয়েও ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে যান সবুজ মোল্যা। তার এই উত্থানের পথে স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধির কাছের লোক হিসেবে তিনি ক্ষমতাসীন দলের সরাসরি প্রশ্রয়
পেতেন। আর ওই এলাকার একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসীরও মদদ ছিলো তার কর্মকাণ্ডে। ঘটনার রাতে ওই সন্ত্রাসীর সাথে সাক্ষাত করেই ফেরার পথেই তার ওপর হামলা হয়।
জানা গেছে, সবুজের বাবা রাজমিস্ত্রী শহীদ মোল্যা এখন নির্মাণ কাজের সাব-কন্ট্রাক্টরের কাজ করেন। ছোট ভাই দশম শ্রেণির ছাত্র। দীর্ঘদিন রেলবস্তি এলাকায় থাকার সুবাদে তিনি স্থানীয়দের মতোই হয়ে উঠেছিলেন। তবে এলাকার আধিপত্য ও রাজনীতির নেতৃত্বের মাঠে তার এই উত্থান প্রতিপক্ষের কাছে একেবারেই উল্টো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
স্থানীয়রা জানায়, নদী ভাঙ্গন পরিবার তথা বাইরের ছেলে হয়েও স্থানীয়দের ওপর খবরদারির বিষয়টি অনেকের গাজ্বলার কারণ হয়ে উঠে। আর এই জের ধরেই গত রোববার রাতে পূর্বপরিকল্পিতভাবে কুপিয়ে তার বাম হাত শরীর থেকে আলাদা করে দেয়া হয়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে ফারুক ও প্রত্যয় নামে আরো দুই সহযোগীর সাথে মোটরসাইকেলে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে বায়তুল আমানের আদর্শ একাডেমির সামনে ৬-৭ জন লোক তাকে নামিয়ে এলোপাথারী কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। এতে তার বাম হাতের কব্জি আলাদা হয়ে যায়। আহত সবুজকে উদ্ধার করে ফরিদপুরের বিএসএমএমসি হাসপাতালে নেয়ার পর রাত পৌনে ১২টার দিকে অপারেশন থিয়েটারের মধ্যে মারা যান তিনি। তার মাথায় দু’টি গুরুতর জখম ছিলো।
মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে এলাকায় গিয়ে সেখানে নানা কথাই শোনা গেছে। হাত কেটে সবুজের এই হত্যাকাণ্ড সেখানে নতুন কোনো শীর্ষ সন্ত্রাসীর আগমনী বার্তা কিনা সেটিও বলছেন কেউ কেউ। এ ঘটনা সেখানকার মানুষের মনে সেই হাতকাটা সন্ত্রাসের আমল মনে করিয়ে দিয়েছে।
জানা গেছে, হাতকাটা শাহীন হিসেবে পুলিশের শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে এই আফজাল হোসেন শাহীন একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তেমনিভাবে পড়াশোনায় এগুতে না পারলেও শ্যামবর্ণের সবুজ ছিলো মিষ্টি চেহারার একজন সুবোধ বালক। কিন্তু বিরাজমান পরিস্থিতি ও নেতার কাছের লোক হয়ে কাঁচা টাকার হাতছানি তাকে প্রলুব্ধ করেছে এই পথে।
আরো জানা যায়, বায়তুল আমান এলাকায় ব্রডব্যান্ড ব্যবসার সাবলাইনের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে স্থানীয় ক্ষমতাসীন মহলের ছত্রচ্ছায়ায় নিজস্ব একটি বাহিনী গড়ে তোলেন সবুজ। এসব নিয়েই তার সাথে প্রতিপক্ষের বিরোধ শুরু হয়। কয়েকদিন আগে এক যুবককে হাতুড়ি দিয়ে পেটানোর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব বিষয় সেখানকার স্থানীয়রা মোটেও ভালোভাবে নেয়নি। যার ফলে ফরিদপুরের বায়তুল আমানে কুপিয়ে সবুজ মোল্যাকে হত্যা করা হয়েছে।
ফরিদপুর পৌরসভার ২৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হক বলেন, সবুজ একটু বদমেজাজি হলেও সে খারাপ কোনকিছুর সাথে জড়িত ছিলো না। এলাকার মাদক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। বিএনপি জামাতের সন্ত্রাসীরা তাকে হত্যা করেছে। হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে আব্দুল হকের নেতৃত্বে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়।
সবুজের বাবা শহীদ মোল্যা বলেন, ছাত্রদল নেতা অনু, ইমন, সিদ্দিকসহ ১০-১২ জন মিলে আমার ছেলেকে হত্যা করেছে। তার দাবি, সবুজ তাকে এ ব্যাপারে আগেই বলেছিলেন। তিনি তখন তাকে একটু ধৈর্য ধরতে বলেছিলেন।
কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমএ জলিল জানান, এ ঘটনার রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (মঙ্গলবার রাত ৮টা) থানায় কোনো মামলা হয়নি। তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। পুলিশের তদন্তে সেসবের সত্যতা বেরিয়ে আসবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা