২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কালের সাক্ষী পাল রাজবংশের ঘাটাইলের সাগরদিঘী

-

বুকে গভীর জল নিয়ে পাল রাজ বংশের শাসনামলে খনন করা দিঘী কালের সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার ঐতিহ্যবাহী সাগরদিঘী।

সভ্যতার নির্ভিক সাক্ষী দিঘীটির অবস্থান উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কি:মি: পূর্ব দিকে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এলাকাটির পূর্ব নাম ছিল লোহানী। কীর্তিমান পুরুষ সাগর রাজা দিঘী খনন করার পর তার নামের সাথে দিঘী যোগ করে এলকার নামকরণ করা হয় সাগরদিঘী। সেই থেকে পাহাড়ী জনপদটি সাগরদিঘী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। দিঘীর পাড়সহ মোট আয়তন ৩৬ একর। দিঘীর পাড় বেশ চওড়া হওয়ায় একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু স্থাপনা। উত্তর পাড়ে রয়েছে সাগরদিঘী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং দক্ষিণ পাড়ে সাগরদিঘী দাখিল মাদ্রাসা। পশ্চিম পাড়ে রয়েছে অস্থায়ী এলজিইডি বাংলো এবং পূর্বপাড়ে সাগরদিঘী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র।

এক সময় দিঘীর যৌবনের আলোক ছটায় মুগ্ধ হতো শত শত প্রকৃতি প্রেমী দর্শনার্থী। সবুজের সমারোহে ভরপুর ছিল দিঘীর পাড়। আর সবুজ পত্রপল্লবের নান্দনিক পরিবেশ বিষন্ন মনেও দোলা দিয়ে যেত চোখের পলকে। স্বচ্ছ পানির ঢেউ আছড়ে পড়তো দিঘীর পাড়ে। গ্রীষ্মের খাঁ খাঁ রোদ্দুরে অচেনা পথিকের গোসল ও পিপাসা দুই-ই মেটাতো এর পানি।

জনশ্রুতি আছে, বহুকাল আগে পালরাজাদের শাসনামলে এ অঞ্চল ছিল ঘন বন আর জঙ্গলে ভরা। পাহাড়ী এলাকা হওয়ায় বন্যপ্রাণি আর জীববৈচিত্রের অভয়ারণ্য হিসাবেও পরিচিত ছিল অঞ্চলটি। এরই মাঝে গড়ে উঠে মানুষের বসবাস। তবে এখানে পানির সংকট ছিল তীব্র। সাগর রাজা তার প্রজাদের সুপেয় পানির জন্য একটি দিঘী খননের সিদ্ধান্ত নেন। সেই অনুসারে ৩৬ একর জমির উপর দিঘী খননের কাজ শুরু করেন। দিঘীটি খননে সময় লাগে প্রায় দুই বছর। আর এতে খননকাজে অংশ নেয় দুই হাজার শ্রমিক।

দিঘীর খনন নিয়ে লোকমুখে নানান কাহিনী শোনা যায়, দিঘী খননের পর পর্যাপ্ত গভীরতা থাকা সত্তেও রহস্যজনকভাবে দিঘীর তলানীতে পানি না উঠায় রাজা চিন্তিত হয়ে পড়েন। কোন এক রাতে রাজা স্বপ্নে আদিষ্ট হন যদি তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে দিঘীতে নামানো হয় তাহলে দিঘীতে পানি উঠবে। রাজা ঘুম থেকে জেগে সকালে রানীকে সব খুলে বললেন। সব শুনে রানীও প্রজাদের সুখের কথা চিন্তা করে দিঘীতে নামার প্রয়াস ব্যক্ত করেন। দিনক্ষণ ঠিক করা হলো। রাজার বিষ্ময়কর এমন সিদ্ধান্তের বাস্তব দৃশ্য নিজ চোখে দেখার জন্য নির্দিষ্ট দিনে কৌতুহলী জনতা দিঘীর চারপাশে ভিড় জমায়। শুকনো দিঘীতে রানী নামলেন। কিছুদূর যেতেই দিঘীর তলদেশ থেকে পানি উঠতে শুরু করে। দেখতে দেখতে রানীর সমস্ত শরীর ডুবে যেতে লাগলো। রানীকে উদ্ধারে চেষ্টার কোন কমতি ছিলনা রাজার। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বাঁচানো গেলনা রানীকে। প্রজাদের সুখের জন্য রানীর আত্নবিসর্জনের মাধ্যমে পূর্ণতা পেল সাগর রাজার দিঘী। পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ হলো দিঘী। সাগর রাজার নামেই দিঘীটির নামকরণ হলো সাগরদিঘী। এ অঞ্চলের সনাতন ধর্মাবলম্বি লোকদের বিশ্বাস এখনো রানীর আত্মা রাতের আঁধারে ঘুরে বেড়ায় দিঘীর পাড়ে। তাই তারা রানীর আত্মাকে শান্ত রাখতে বিভিন্ন সময় পূজা অর্চনা করে থাকে।
সাগর রাজা এ অঞ্চলে রেখে যাননি কোন রাজ প্রাসাদ । তবে তার স্মৃতিবিজরীত দিঘীটি আজ কালের গর্ভে অনেকটাই মলিন হতে চলেছে। অবৈধভাবে দিঘীর পাড় দখল করে পশ্চিম এবং দক্ষিণ পাশে গড়ে তোলা হয়েছে লেয়ারের খামার। লেয়ারের বর্জ ফেলা হচ্ছে দিঘীর পানিতে। লীজ এর মাধ্যমে দিঘীটিতে করা হচ্ছে মাছ চাষ। যার ফলে দূষিত হচ্ছে পানি এবং বাতাসে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। এমন দুগর্ন্ধের কারণে সাধারণ মানুষসহ দুই পাড়ের দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রশান্তির নিঃশ্বাস আর বিশুদ্ধ বাতাস থেকে প্রতিনিয়ত হচ্ছে বঞ্চিত। তাদেরকে নাক বন্ধকরে চলতে হয়। এভাবেই দিন দিন দিঘীটি তার নিজস্ব সৌর্ন্দয্য হারাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ঐতিহ্যবাহী দিঘীটি সংরক্ষণের দাবী জানিয়ে আসছে এলাকাবাসী।


আরো সংবাদ



premium cement