১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
করোনাভাইরাস

বিশ্ব অর্থনীতির বড় বিপদ

-

পুরো বিশ্বে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে নতুন করোনাভাইরাস। এই রোগের শুরু চীনে, এখন ছড়িয়ে গেছে বেশ কয়েকটি দেশে। মৃত্যুর সাথে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও। অনেক দেশ এবং এয়ারলাইন্স চীনের সাথে বিমান চলাচল স্থগিত করেছে। ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাতিল হয়েছে ১৫ হাজারের বেশি ফ্লাইট।
ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা, ফিনল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ আরো বেশ কয়েকটি দেশ ফেব্রুয়ারিতে চীনে সব ধরনের বিমান চলাচল স্থগিত করেছে। মিসর, কেনিয়া ও কাতারসহ কয়েকটি দেশ বাড়তি ব্যবস্থা হিসেবে চীনের সাথে বিমান চলাচলে অনির্দিষ্টকালের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ইতালি ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল শুধু চীনা নাগরিকদের নয়, বরং চীন ভ্রমণ করা বিদেশীদেরও ঢুকতে দিচ্ছে না। চীনা বা চীনে বসবাস করা ব্যক্তিদের জন্য ফ্রি ভিসা বা অন অ্যারাইভাল ভিসা দেয়া কয়েকটি দেশ সাময়িকভাবে এই ব্যবস্থা বন্ধ রেখেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া ও রাশিয়া। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর ভারত ও সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশ চীনা নাগরিকদের বা চীনে বসবাস করেন এমন ব্যক্তিদের বর্তমান ভিসাও বাতিল করেছে।
চীনের মূলখণ্ড হুবেই প্রদেশ থেকে লোকজনকে হংকংয়ে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। স্থানীয় প্রশাসন মূল ভূখণ্ড থেকে প্রবেশে আরো কড়াকড়ি আরোপের ব্যবস্থার অনুমতিও চেয়েছে। তাইওয়ানও একই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
তবে এখনো কয়েকটি দেশ চীনের সাথে বিমান যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করেনি। যদিও আগের তুলনায় তাদের ফ্লাইট সংখ্যা কমে গেছে। নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, পাকিস্তান রয়েছে এ দলে। অবশ্য একমাত্র পাকিস্তান হুবেই প্রদেশ ছাড়া চীনের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা উহানে অবস্থান করা নাগরিকদেরও দেশে ফেরাতে রাজি নয়। চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানকে এই করোনাভাইরাসের আঁতুড়ঘর হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে। গত ডিসেম্বরে প্রথম এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাসে চার শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। চীনের বাইরে ২৫টির বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। এর মধ্যে চীনের বাইরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম একজনের মৃত্যু হয়েছে ফিলিপাইনে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ২০০৩ সালের সার্স ভাইরাসের চেয়েও মারাত্মক হতে পারে করোনাভাইরাস। এরই মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যায় সার্সকে ছাড়িয়ে গেছে এটি।
করোনাভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। যদিও প্রতিষেধক তৈরির চেষ্টা শুরু হয়ে গেছে, তবে বিশেষজ্ঞদের অনুমান, প্রতিষেধক তৈরি করা গেলেও সময় লাগবে প্রায় ছয় থেকে ১২ মাস। স্বাভাবিকভাবেই এই সময়টায় উহান, হুবেই তথা পুরো চীন পৃথিবীর জন্য ভয়ের কারণ হিসেবে রয়ে যাবে। আর এই ভীতি যেমন চীনের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, তেমনি শ্লথ করে দেবে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির চাকা।
করোনাভাইরাসের আর্থিক আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে চীনের হুবেই প্রদেশ। পুরো প্রদেশের প্রায় ছয় কোটি মানুষ এখন অবরুদ্ধ অবস্থায় আছে। খাদ্যবাহী ট্রাক ও চিকিৎসাসামগ্রী ছাড়া আর কিছুই এখন ওই এলাকায় ঢুকতে পারছে না। অঞ্চলটির বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে চালু আছে কেবল হাসপাতাল সেবা ও ভিডিওস্ট্রিমিং। বাকি সব আর্থিক কর্মকাণ্ড পুরোপুরি স্থবির হয়ে পড়েছে। অথচ চীনের জিডিপির সাড়ে চার শতাংশ আসে হুবেই থেকে। ফলে হুবেই স্থবির থাকার অর্থ হলো চীনের সার্বিক প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া। বিশ্লেষকরা বলছেন, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে চীনের প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ কমে যেতে পারে। অথচ করোনাভাইরাসের আবির্ভাবের আগে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশ।
উহান এলাকাটি ‘ম্যানুফ্যাকচারিং হাব’ হিসেবে পরিচিত। এই অঞ্চলে গড়ে উঠেছে অটোমোবাইল বা গাড়ি নির্মাণশিল্প। নিসান, হোন্ডা ও জেনারেল মোটরসের কারখানা আছে উহানে। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় এসব কারখানা বর্তমানে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের অংশ হিসেবে উহানে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এর প্রভাব পড়বে পুরো বিশ্বের অর্থনীতিতে।
করোনাভাইরাস এমন সময়ে ছড়িয়ে পড়েছে, যখন চীনে চলে এসেছে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার সময়। নতুন রোগের কারণে এই উৎসব ঘিরে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গত বছর এই সময়ই চীনের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় এক ট্রিলিয়ন ইউয়ান। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এবার তাতে ধস নামতে পারে। আবার নতুন বছরের এই ছুটির সময়ই চীনের সিনেমাশিল্প সবচেয়ে বেশি আয় করে থাকে। পুরো বছরের মোট আয়ের ৯ শতাংশ গত বছরের এই সময় আয় করেছিল চীনের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু এবার একই সময়ে চীনের প্রায় ১১ হাজার সিনেমা হল করোনাভাইরাসের কারণে বন্ধ করে দিতে হয়েছে। কমে গেছে অভ্যন্তরীণ ভ্রমণের পরিমাণও। করোনাভাইরাসের কারণে চীনের অনেক নাগরিকই দেশের ভেতরে ঘোরাঘুরি বাতিল করে দিচ্ছে।
শুধু হুবেই নয়, সাংহাই ও গুয়াংডংয়ের মতো অন্যান্য প্রদেশেও করোনাভাইরাসের আতঙ্ক ভর করেছে। নতুন বছর উপলক্ষে ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানিকে কারখানা বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল মার্কেট ইন্টেলিজেন্স বলছে, এভাবে দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানে কারখানা বন্ধ থাকায় চীনের প্রবৃদ্ধির হার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এদিকে স্টারবাকস পুরো চীনে ছড়িয়ে থাকা তাদের চার হাজার ২৯২টি ক্যাফের প্রায় অর্ধেক বন্ধ করে দিয়েছে। সাংহাইয়ে নিজেদের রিসোর্ট বন্ধ করে দিয়েছে ডিজনি। নতুন বছরের সপ্তাহব্যাপী ছুটির পর চীনের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের চাকায় গতি আসতে এমনিতেই বেশ সময় লাগে। এবার তা আরো কঠিন হয়ে যাবে। টেকজায়ান্ট টেনসেন্টের মতো কিছু কোম্পানি তাই এখন কর্মীদের ঘরে বসে কাজ করার নির্দেশ দিচ্ছে!
চীনের কারখানাগুলো বন্ধ থাকার অর্থ হচ্ছে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন এলোমেলো হয়ে যাওয়া। বর্তমানে বৈশ্বিক ওষুধশিল্পে ব্যবহৃত প্রায় ৮০ শতাংশ উপাদান যায় চীন থেকে। পৃথিবীতে তৈরি প্লাস্টিকের তৈরি ফুলের ৯০ শতাংশ সরবরাহ করে চীন। আবার ফক্সকনের মতে, চীনা কোম্পানিই তৈরি করে অ্যাপলের বিখ্যাত আইফোন। ফলে সব ক্ষেত্রেই টানাপড়েন তৈরির শঙ্কা তৈরি হতে পারে। এরই মধ্যে করোনাভাইরাসের কারণে ফক্সকনের শেয়ারের দাম কমে গেছে ১০ শতাংশ হারে। আর নতুন রোগ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে হংকং স্টক এক্সচেঞ্জে দরপতন হয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় সবচেয়ে বেশি খরচ হয় চিকিৎসা খাতে। সুতরাং এই খাতেও চীনসহ বিভিন্ন দেশের ব্যয়ের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে। এসব বিবেচনায় নিয়ে অক্সফোর্ড ইকোনমিকস নামের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চলতি বছরের বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৩ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। সত্যি হলে এটিই হবে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর সর্বনি¤œ বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি।
চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের পর থেকেই অনেক পশ্চিমা কোম্পানি চীনের বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছিল। কিন্তু সেই কাজে খুব একটা সফলতা আসেনি। করোনাভাইরাসের কারণে এবার বড় বিনিয়োগকারীরা আবার সেই চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে চীন ও বিশ্বের অর্থনীতি যে ধাক্কা খাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সার্স মহামারীর অভিজ্ঞতা আমলে নিলে বলতে হয়, এ ধরনের সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার পরপরই চীনা অর্থনীতিতে বড় ধরনের উল্লম্ফন দেখা যায়। এবারো হয়তো তার ব্যতিক্রম হবে না।
কিন্তু এই আশাবাদ মূলত করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানো ও তা কার্যকর প্রতিরোধের ওপর নির্ভরশীল। সেই কাজ কতটুকু ফলপ্রসূ হবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।


আরো সংবাদ



premium cement