১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`
নাগরিকত্ব সংশোধন ইস্যু

ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভারতের গণতন্ত্র ও জনগণ

-

গত মাসে ভারত বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) কার্যকর করেছে। এতে মুসলমান ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার বিষয়টি সহজ করা হয়েছে। এরই সাথে ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপি দেশটির ১৩০ কোটি নাগরিকের একটি সমন্বিত তালিকা গড়ে তুলতে চায়, যাতে সেখানে থাকা অবৈধ অভিবাসীকে সহজে চিহ্নিত করা যাবে। ভারত সরকারের এ কথাগুলো স্বাভাবিকভাবে ন্যায্য মনে হলেও এতে চরম ভোগান্তিতে পড়বেন দেশটিতে থাকা বেশির ভাগ মুসলিম। কারণ ভারতের ২০ কোটি মুসলমানের মধ্যে বেশির ভাগই হাতে দেশটির নাগরিকত্বের কোনো কাগজপত্র নেই। ফলে তারা স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রবিহীন হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছেন। আর এ তালিকার মাধ্যমে ধৃত ব্যক্তিদের আটক করতে ক্যাম্প তৈরি জন্য এরই মধ্যে আদেশ দিয়েছে বিজেপি সরকার।
তাদের এ উদ্যোগটি খুব সুচিন্তিত বা সুপরিকল্পিত বলে মনে হচ্ছে না। কারণ ইতোমধ্যেই এটি দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। ছাত্রজনতা এমনকি নরেন্দ্র মোদির প্রশংসায় মুখর থাকা গণমাধ্যমগুলোও বিজেপির এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে। তারা ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয় মুছে দিয়ে ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার এ পরিকল্পনার ব্যাপক সমালোচনা করেছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের পরিচয় পাল্টে দেয়ার বিজেপির মহাপরিকল্পনার মধ্যে বর্তমান পদক্ষেপটিকেই সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপ বলে মনে হচ্ছে।
বিজেপির বড় আকারের উগ্রতার প্রথম দেখা মিলেছিল রামমন্দির নির্মাণের জন্য অযোদ্ধার বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে। ১৯৯২ সালে হিন্দু উগ্রপন্থীরা সে মসজিদটি পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। এর জেরে ভারতজুড়ে রক্তক্ষয়ী সঙ্ঘাত ছড়িয়ে পড়ে। এর এক দশক পর ২০০২ সালে মোদির নিজ রাজ্য গুজরাটে ভয়াবহ দাঙ্গা সংঘটিত হয়। এতে দুই সহস্রাধিক মানুষ নিহত হন, যাদের বেশির ভাগই ছিলেন মুসলমান। বিষয়টি নিয়ে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও হিন্দু উগ্রবাদীদের চোখে হিরো হয়ে যান রাজ্যটির তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
ভারতে বিজেপির পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় বিষয়গুলো টনিকের মতো কাজ করেছে, তবে সে বিষয়টিই পুরো দেশের জন্য বিষের রূপ ধারণ করেছে। ভারতের সংবিধানে থাকা ধর্মনিরপেক্ষ নীতিমালাকে অবজ্ঞা করে মোদি সরকার একের পর এক যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা দেশের গণতান্ত্রিক ধারাকেই বিনষ্ট করে দিচ্ছে। আর এর জের চলতে পারে কয়েক দশকজুড়ে। আশঙ্কা রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী রক্তাক্ত সঙ্ঘাতেরও।
দুঃখজনক সত্যটি হচ্ছে, ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলে বিভাজনের মাধ্যমে মোদি ও তার দল বিজেপি রাজনৈতিকভাবে বেশ ভালোই লাভবান হচ্ছে। এ ইস্যুগুলোর মাধ্যমে জাতীয় ও রাজ্য নির্বাচনের সময় দলটির নেতাকর্মী ও সহযোগী সংগঠনগুলো দারুণভাবে উজ্জীবিত থাকে। তাদের এই উন্মাদনা অর্থনীতির মতো জটিল বিষয়গুলো থেকেও ভোটারদের মনোযোগ সরিয়ে দেয়, নির্বাচনে জয়ী হতে ভারতের মতো দেশে যা বিজেপির অনুকূল ভূমিকা রেখেছে বরাবরই।
এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদি মনে করেন, ভারতের অন্য সংখ্যালঘুরা তার প্রতি আস্থাশীল হলেও মুসলমানদের বিষয়টি এ ক্ষেত্রে ভিন্ন। তারা হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের জন্য ক্ষতিকর। বিজেপির এ ধারণার জন্যই তারা অব্যাহতভাবে মুসলমানদের কোণঠাসা করে রাখতে চায়। এই ধারাবাহিকতায় মোদি আমলে বারবার মুসলমানদের স্বার্থপরিপন্থী আইনকানুন-নিয়ম প্রণীত হয়েছে। মুসলমানদের ঐতিহ্যগুলো নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হচ্ছে। মুসলিম নামের এলাকাগুলোর নাম পরিবর্তন করে দেয়া হচ্ছে। এরপর সবচেয়ে বড় আকারে এসেছে এনআরসি ও সিএএ আইন। এখনই যেভাবে বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিক্ষোভ প্রতিবাদ হচ্ছে, নিশ্চিত করে বলা যায়, এর জের থাকবে বহু বছর। আর সেটি কেবল প্রতিবাদ-বিক্ষোভে সীমাবদ্ধ না থেকে আরো বড় আকার ধারণ করারও শঙ্কা রয়েছে। ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের মাধ্যমে যে তালিকা তৈরি করতে যাচ্ছে, তাতে কোটি কোটি মুসলমানের নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রতিবেশী মুসলিম দেশগুলো। ভারত অবশ্য দাবি করছে, এটা তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু বিজেপি সরকারের প্রণীত তালিকা থেকে কোটি কোটি মুসলমান বাদ পড়বেন তাদের ব্যাপারে কী করা হবে, তা এখনো অস্পষ্ট রেখে দিয়েছে বিজেপি সরকার। তারা না বললেও তালিকার বাইরে থাকা জনগোষ্ঠী যে সে সময় রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়বেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর বিজেপি সরকারের আমলে এ কোটি কোটি অনাগরিক মুসলমান ভারতেই অবস্থান করতে পারবে তা একটি অসার চিন্তা। ফলে মোদি সরকার যতই আশ্বস্ত করুক না কেন, স্বাভাবিকভাবেই এ বিশাল জনগোষ্ঠীর চাপ গিয়ে পড়বে প্রতিবেশী মুসলিম দেশগুলোর ওপর।
বিজেপির প্রয়োগকৃত ধারণাগুলো বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের যে অনুকরণীয় ধারণা ছিল, তাকে বিনষ্ট করে। তাদের ধারণাগুলো মুসলিম নাগরিকদের প্রতি ব্যাপক বৈষম্যের জন্ম দেয়। কারণ যেখানে তারা প্রতিবেশী আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে তথাকথিত নির্যাতিত জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে, সেখানে সে দেশেই দীর্ঘ দিন ধরে বসবাস করে আসা মুসলমানদের দেশ থেকে বাইরে বের করে দেয়ার কৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদির সরকার ধারাবাহিকভাবেই সে বিতর্কিত কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
স্বাধীনতার সময় থেকেই ভারত ঘোষণা করে আসছিল, বিভিন্ন ভাষা, জাতি, বর্ণ ও ধর্মের মিলিত রূপই হচ্ছে ভারত। আর এর গণতন্ত্রই বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে পরিচিত ছিল। ধর্ম-বর্ণ নিরপেক্ষ সরকারগুলো যেকোনো পন্থায় তাদের এই মেলবন্ধন অটুট রাখার মোটামুটি প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিল। অথচ দেশটির বর্তমান সরকার ভারতের এই পরিচয়কে স্পষ্টভাবে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, বিজেপি সরকারের মুসলিমবিদ্বেষী এসব কার্যক্রম পরীক্ষামূলক। এতে যদি সফল হয় তা হলে অন্য সংখ্যালঘুদের এমনকি হিন্দুদের মধ্যে যারা নিম্নবর্ণের তাদের বিরুদ্ধেও এ ফর্মুলা ব্যবহৃত হতে পারে। ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতি উপেক্ষা করে তারা যেমন গরুর গোশত খাওয়ার বা গরু জবাই করার জন্যও নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে, তেমনি হিন্দু নারীকে ভালোবাসা বা নিম্নবর্ণের সাথে উচ্চবর্ণের বিয়ের কারণে অনেক হিন্দু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। আর মাঝে মধ্যে এসব প্রবণতা গণহত্যার রূপ নেয়। ২০০২ সালে এমনই একটি বিষয় রূপ নিয়েছিল গুজরাটের দাঙ্গায়, যাতে মারা গিয়েছিল দুই সহস্রাধিক মানুষ।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১১ ডিসেম্বর লোকসভায় নাগরিকত্ব সংশোধন বিল পাস হয়। রাজ্যসভায় পাস হয় তার পরের দিন। এর পরপরই রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ ওই বিলে সই করলে তা আইনে পরিণত হয়। আইন অনুযায়ী প্রতিবেশী বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত সংখ্যালঘু হিন্দু, শিখ, জৈন, পার্সি, শিখ ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন যারা ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতে চলে এসেছেন, তারা এ আইনে নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। এ আইনের সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ অনেকে বলেছেন, এই আইন সংবিধানবিরোধী। কারণ ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী ধর্মীয় বিচারে নাগরিকত্ব দেয়ার কোনো উপায় নেই।
এ সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) বিরুদ্ধে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট ও বিভিন্ন রাজ্যের হাইকোর্টে ১৪৪টি আবেদন জমা পড়েছে। এগুলোতে সেই সিএএ বাস্তবায়নে স্থগিতাদেশ চাওয়া হয়। কিন্তু গত ২২ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট জানান, কেন্দ্রের মতামত না জেনে স্থগিতাদেশ দেয়া সম্ভব নয়। কেন্দ্রের অভিমত জানাতে চার সপ্তাহ সময় দেয়া হয়েছে।
তারা জানান, নাগরিকত্বসংক্রান্ত মামলার বৈধতার বিষয়টি বিবেচনার দায়িত্ব সাংবিধানিক বেঞ্চের হাতে ছেড়ে দেয়া হবে। চার সপ্তাহের মধ্যে পাঁচ বিচারপতির সেই সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠিত হবে। মামলাগুলোর শুনানি হবে পাঁচ সপ্তাহ পর। তারা এ-ও জানিয়েছেন, নাগরিকত্ব নিয়ে আসাম ও ত্রিপুরার আবেদনের বিষয়টি আলাদা হওয়ায় ওই দুই রাজ্যের আবেদন আলাদাভাবে শুনানি হবে।
যদিও এ বিষয়ে খুব বেশি আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না, তার পরও বিষয়টি যখন সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে, তখন কিছুটা হলেও আশা করতে সমস্যা কোথায়? ঘ


আরো সংবাদ



premium cement