২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

নেতানিয়াহুর পশ্চিম তীর দখলের হুঙ্কার

-

ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে পাল্টে দিতে চান। বড় ধরনের কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই নেতানিয়াহু নতুন করে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর দখলের হুঙ্কার ছুড়ে দিয়েছেন। নেতানিয়াহু গত সপ্তাহে জর্দান নদীসংলগ্ন প্রায় দুই হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করবেন বলে ঘোষণা দেন। নেতানিয়াহু যে এলাকাটি দখল করার ঘোষণা দিয়েছেন, সেটাকে ফিলিস্তিনিদের ফুড বাস্কেট হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কারণ, পশ্চিম তীরের উৎপাদিত সবজির প্রায় ৬০ শতাংশই ওই এলাকায় উৎপাদিত হয়ে থাকে।
ইসরাইল ইতোমধ্যে জর্দান উপত্যকার প্রায় ৮৮ শতাংশই তাদের কলোনিভুক্ত করে নিয়েছে। তারা এটাকে অবৈধ কৃষি বসতি এবং সামরিক অঞ্চলের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে। এটা সব সময় ধারণা করা তথা মনে করা হয় যে, সামরিকভাবে অধিকৃত অঞ্চল ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সীমান্তের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হবে। নেতানিয়াহু শুধু পশ্চিম তীর দখলের ঘোষণা নয়, সম্প্রতি রাশিয়া সফরে যাওয়ার আগে তিনি গাজায় হামলা চালানোরও হুমকি দেন। পর্যবেক্ষকরা নেতানিয়াহুর এই ঘোষণাকে নির্বাচনকে সামনে রেখে গোঁড়া ইহুদিদের ভোট বাগিয়ে নেয়ার অপকৌশল হিসেবে দেখেছেন।
১৭ সেপ্টেম্বরের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখেই ১০ সেপ্টেম্বর এক টেলিভিশন ভাষণে নেতানিয়াহু বলেন, পুনরায় ক্ষমতায় এলে তার সরকার পশ্চিম তীরের ওপর ইসরাইলের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। অবশ্য তার বিরোধীরা তার এই বক্তব্যকে রাজনৈতিক কৌশল ও ভাঁওতাবাজি বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
নেতানিয়াহুর এই ঘোষণায় ফিলিস্তিন, জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব বিশ্বের দেশগুলো তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনও নেতানিয়াহুর ঘোষণার বিরোধিতা করেছেন। ওআইসি নেতানিয়াহুর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ওআইসির বিশেষ সভা আহ্বান করে। নেতানিয়াহুর ঘোষণার নিন্দা জানিয়ে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে ইউরোপের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দেশÑ ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও স্পেন। তারা এক যৌথ বিবৃতিতে পশ্চিম তীর দখল আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে ইসরাইলের প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, পশ্চিম তীর বিশেষ করে জর্দান উপত্যকা ও উত্তরাংশের ডেডসি উপকূল দখলে নেতানিয়াহুর ঘোষণায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও স্পেন। বিবৃতিতে বলা হয়, এটা কার্যকর হলে তা হবে আন্তর্জাতিক আইনের ঘোরতর লঙ্ঘন। এর ফলে ১৯৬৭ সালের চুক্তি অনুসারে ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের বিষয়টি হুমকির মুখে পড়বে এবং ওই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা আরো কঠিন হয়ে যাবে।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, সুবিধা আদায়ের রাজনীতি করা এবং বেশ কয়েকটি দুর্নীতির মামলা রয়েছে। তাই তিনি ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বেপরোয়া। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে পুরোপুরি ইসরাইল ও ইহুদি লবি দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছেন। তাই ট্রাম্পের তথাকথিত মধ্যপ্রাচ্য নীতির কারণে নেতানিয়াহুর এখন পোয়াবারো। যুক্তরাষ্ট্র তথা ট্রাম্প প্রশাসন ইতোমধ্যে একতরফা ইসরাইলের পক্ষ নিয়ে জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী এবং অধিকৃত গোলান মালভূমিকে ইসরাইলি ভূখণ্ড বলে ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত তথাকথিত ‘ডিল সব দ্য সেঞ্চুরি’ তথা নতুন শান্তি প্রক্রিয়ায়ও নির্লজ্জভাবে ইসরাইলকে সুবিধা দেয়া হয়েছে এবং একটি বৃহত্তর ইসরাইলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা হয়েছে।
তাই নেতানিয়াহু পশ্চিম তীর দখলের যে ঘোষণা দিয়েছেন, সেটাকে কেবল তার রাজনৈতিক স্টান্ডবাজি হিসেবে মনে করলেই হবে না; ইসরইল এখন পশ্চিম তীরের একটি বড় অংশ দখল করে নিতে চায়। তারা সম্ভবত সব অবৈধ বসতি এবং জর্দান উপত্যকাও নিজেদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। নেতানিয়াহুর পশ্চিম তীর দখলের ঘোষণার পর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ), আরব লিগ, ইইউ এবং জাতিসঙ্ঘ যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে তা অনেকটা দায়সারা। ইসরাইল সব ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে সস্পূর্ণরূপে নিজেদের বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলার যে উদ্যোগ নিয়েছেÑ তার বিরুদ্ধে তারা সামান্যই বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে। ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব ইসরাইলের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত অর্থপূর্ণ কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। নেতানিয়াহুর পশ্চিম তীর দখল করার অঙ্গীকারের পর ফিলিস্তিনের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শতেহ যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, সেটাতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বই ফুটে উঠেছে। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বারবার ইসরাইলকে অন্তঃসারশূন্য হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। মাহমুদ আব্বাস এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ইসরাইল জর্দান উপত্যকা, উত্তরাঞ্চলীয় ডেডসি এবং ১৯৬৭ সালে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের যেকোনো অংশ দখলের চেষ্টা করলে ইসরাইলের সাথে স্বাক্ষরিত সব চুক্তির বাধ্যবাধকতা শেষ হয়ে যাবে। মাহমুদ আব্বাস অথবা শতেহ কেউই এই সত্য কথাটি উচ্চারণ করলেন না যে ‘শান্তি প্রক্রিয়া এখন মৃত এবং ইসরাইল ইতোমধ্যে সব চুক্তি লঙ্ঘন করেছে।’ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ দৃঢ়তার সাথে তাদের অস্তিত্ব জানান দিতে ব্যর্থ হলেও নেতানিয়াহু ওয়াশিংটনের পূর্ণ সমর্থন নিয়ে পশ্চিম তীর দখলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। ফিলিস্তিনি নেতৃবৃন্দকে এখন অবশ্য বুঝতে হবে যে সঙ্ঘাতের প্রকৃতি এখন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করে যে বৃহত্তর বর্ণবাদী ইসরাইলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়, প্রচলিত পদ্ধতির গতানুগতিক বিবৃতি দিয়ে কেবল সেটাকে ঠেকানো যাবে না। ফিলিস্তিনিরা অব্যাহতভাবে এই বাস্তবতা এড়িয়ে যেতে থাকলে ইসরাইল একদিন বাস্তবে ফিলিস্তিনিদের সম্পূর্ণরূপে বাস্তুচ্যুত করে তাদের স্বপ্নের বৃহত্তর ইসরাইলি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। হ


আরো সংবাদ



premium cement