১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আমাজন আগুনের অন্তরালে

-

বিশ্বের বৃহত্তম রেইন ফরেস্ট আমাজনে যা ঘটছে তা দিনদুনিয়ার খবর রাখেন এমন প্রায় সবারই জানা। আগুনই তো লেগেছে। এ আর নতুন কি? গত কয়েক বছরে এমন আগুন বিশ্বের আরো কয়েক দেশেই লেগেছে। চলতি বছর স্পেন, গ্রিস, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় বনে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। পুড়েছে মাইলের পর মাইল বন। কিন্তু প্রশ্ন হলোÑ আমাজন নিয়ে এত হইচই কেন?
উত্তরটা সহজ। কারণ, আমাজন অরণ্য অন্য কোনো বনের মতো নয়। পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের ২০ শতাংশ আমাজন থেকে আসে। আমাজন পৃথিবীতে প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের একটি। এই বনের নদী বা আমাজন নদী বেশির ভাগ নদীর উৎস। এই নদী বিশ্বে প্রচুর পানির জোগান দিয়ে থাকে। ৪৫ লাখ প্রজাতির পোকামাকড় আছে এখানে। এ ছাড়া ৪২৮ প্রজাতির উভচর, ৩৭৮ প্রজাতির সরিসৃপ এবং ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে আমাজনে। আমাজন নদীতে আছে তিন হাজার প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী।
পৃথিবীর ‘ফুসফুস’ খ্যাত এই আমাজনে এ বছর রেকর্ডসংখ্যক আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। যা বিশ্লেষকদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ধারণা করছেন, পরিকল্পিতভাবে লাগানো হচ্ছে আগুন। অবশ্যই এর পেছনে কাজ করছে পুঁজিবাদী শক্তি।
এবার যে আগুন লেগেছে, তা নিয়ে হইচই হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ হলো এর ভয়াবহতা। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালে আমাজনে যতগুলো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, আর কখনো তা হয়নি। ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা দ্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্পেস রিসার্চ (ইনপে) জানিয়েছে, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে আমাজনে রেকর্ডসংখ্যক আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এ বছর ৮৫ শতাংশ বেশি আগুন লেগেছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে আমাজনে ৭৫ হাজারেরও বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। গত বছর আগস্ট পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০ হাজার। আরো ভয়ঙ্কর তথ্য হলো, ২০১৩ সালে পুরো ব্রাজিলে যত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল, চার মাস বাকি থাকতেই এ বছর তার চেয়ে বেশি আগুন লেগেছে। শুষ্ক মওসুমে, বিশেষ করে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আমাজনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা একেবারে বিরল নয়। কিন্তু এবারের মতো এত ভয়াবহ আগুনে কখনো পোড়েনি বিশ্বের বৃহত্তম গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এই বনাঞ্চল।
আমাজনের প্রায় ৬০ শতাংশ অবস্থিত ব্রাজিলে। বারবার এমন অগ্নিকাণ্ডে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছে ব্রাজিলের উত্তরাংশের রাজ্যগুলো। এরই মধ্যে জরুরি অবস্থাও জারি করা হয়েছে।
এই দাবানল যে প্রাকৃতিক নয়, ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটানো তার পক্ষে কোনো শক্ত তথ্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু এবার স্যাটেলাইটের পাঠানো ছবি খুঁটিয়ে দেখে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছেন, এই দাবানল শুধুই প্রাকৃতিক নয়। মানুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগ ছাড়া এত বড় ধরনের দাবানল একেবারেই অসম্ভব।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের দাবি, চাষযোগ্য জমি তৈরির জন্য এবং খনিজসম্পদের লোভে নির্বিচারে গাছ নষ্ট করার জন্য আগুন লাগানো হয়েছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, আমাজন একটি রেইন ফরেস্ট। বৃষ্টির কারণে এই অরণ্য চিরসবুজ থাকে। সারা বছরই বনটি বৃষ্টিতে সিক্ত থাকে। সূর্যের আলো প্রায় ঢোকেই না এ অরণ্যে। আর এখানেই বিজ্ঞানীদের প্রশ্ন। এমন সিক্ত ও সবুজ অঞ্চল, এত বিস্তীর্ণভাবে কী করে দাবানলের শিকার হয়?
স্যাটেলাইটের ছবিতে আরো দেখা গেছে, দগ্ধ অরণ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের জঙ্গল কেটে সাফ করে মাটির চিত্রই বদলে ফেলা হয়েছে। ভেজা ঘাসে ভরে থাকা জমি একেবারে ফাঁকা ও শুকনো হয়ে গেছে। এসব করতে গিয়ে অরণ্যের গভীরে ট্রাক্টরও ব্যবহার করা হয়েছে। উপড়ে ফেলে শুকানো হচ্ছে আমাজনের মাটি। ফলে আলগা হচ্ছে গাছের শিকড়, তাতেই মরে যাচ্ছে অনেক গাছ। আর তাতে সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো হারিয়ে যাচ্ছে চিরসবুজ এই অরণ্য থেকে।
ব্রাজিলের ফেডেরাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের একাংশ বলছেন, শুকনো বাতাসে দাবানল জ্বলে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এ ক্ষেত্রে দাবানলের প্রকোপে আগুন লাগেনি বলেই মনে করছেন তারা। ওই বিজ্ঞানীদের মতে, অনেক সময়েই চাষের জন্য জমি বা খামার তৈরি করতে ইচ্ছাকৃতভাবে জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দেন স্থানীয় গ্রামবাসী। সেখানেও এমনটাই হচ্ছে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
জলবায়ু বিজ্ঞানী কার্লোস নোব্রের দাবি, গবাদিপশুর চারণভূমি হিসেবে জমি ব্যবহার করতে চাওয়া কৃষকেরা জায়গা পরিষ্কার করতে শুকনো আবহাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন। এ সময় বন দাহ্য হয়ে থাকে এবং খুব সহজেই তাতে আগুন লাগে।
খনিজ পদার্থের ভাণ্ডার আমাজন। খনিজ পদার্থ অন্বেষণের জন্য আমাজন অরণ্যে লাগাতার জঙ্গল সাফ করে খননকাজ চালানো হয়। সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতি মিনিটে একটি ফুটবল মাঠের সমপরিমাণ জঙ্গল কাটা হচ্ছে। ফলে বৃষ্টিপাতও আগের তুলনায় কমেছে। এটি আমাজনে আগুন লাগার অন্য একটি কারণ হতে পারে বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীদের আরেক অংশ। কার্বন ছাকনি হিসেবে পরিচিত চিরসবুজ বনটি যে অব্যাহত আগুন লাগার ঘটনায় তার কার্যক্ষমতা হারাবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত প্রায় সব গবেষক।
আমাজনে ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য দক্ষিণপন্থী প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোর নীতিকে কাঠগড়ায় তুলেছেন পরিবেশবিদেরা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার আগে আন্তর্জাতিক হুঁশিয়ারির তোয়াক্কা না করেই আমাজন অঞ্চলকে চাষ ও খনিজ উত্তোলনের কাজে ব্যবহারের কথা বলেছিলেন তিনি। তার এ উদ্যোগের ফলে বন উজাড় হয়ে যেতে পারে আন্তর্জাতিক মহলের এমন উদ্বেগ দিনের পর দিন উপেক্ষা করে গেছেন বলসোনারো। ফলে আমাজনে অন্তত ৭২ হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। মৃত্যু হয়েছে অনেক পশুপাখিরও।
যদিও বলসোনারো বলেছেন, অযথা এসব নিয়ে দোষারোপ করা হচ্ছে তাকে। এই সময়ে আগুন জ্বালিয়ে চাষের জমি তৈরি করেন চাষিরা। সেটাই হয়ে আসছে। ইনপের পরিসংখ্যানকে ‘ভুয়া’ বলে উড়িয়ে দিয়ে ইনপের ডিরেক্টরকে বরখাস্ত করেছেন প্রেসিডেন্ট।
২০১৪ সাল থেকে ব্রাজিলে যে হারে আমাজন বন ধ্বংস হয়েছে, এবার তার হার অন্তত ৬০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এর কারণ অর্থনৈতিক সঙ্কট ও ব্রাজিলিয়ান সরকারের এ সংক্রান্ত নিয়মনীতির লঙ্ঘন। এই লঙ্ঘনের শুরুটা হয়েছে ২০১৮ সালে ব্রাজিলের জাতীয় নির্বাচনে জাইর বলসোনারোর বিজয়ের পর থেকেই। তবে কারণটা যাই হোক না কেন, আমাজন কিন্তু আগুনে জ্বলছেই। যত দিন যাচ্ছে, ততই উজাড় হচ্ছে গাছ। শিকড় আলগা হয়ে গিয়ে শুকিয়ে যাওয়া গাছের মাধ্যমে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে মাইলের পর মাইল সবুজ। মারা যাচ্ছে অসংখ্য প্রাণী। এতে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা যেমন আতঙ্কিত, তেমনি আতঙ্কিত গোটা বিশ্ব। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement