২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোররা

ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোররা - ছবি : সংগৃহীত

দেশজুড়ে আতঙ্কের আরেক নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে কিশোর গ্যাং। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরোনোর আগেই কিশোরদের একটা অংশের দলবদ্ধ বেপরোয়া আচরণ ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজে। এরা বিভিন্ন নামে নানা ধরনের গ্রুপে বিভক্ত হয়ে জড়িয়ে পড়ছে ভয়ঙ্কর সব অপরাধে। তাদের হাতে হয়রানির শিকার হচ্ছে নারী-শিশুসহ সর্বস্তরের মানুষ। একই সাথে কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বেড়েছে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও। রাজধানীর উত্তরা, মিরপুর, বাড্ডাসহ ঢাকার ৪০টি এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র জুনিয়র দ্বন্দ্বে গত ১৭ বছরে ১২০ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে গত দুই বছরেই কিশোর অপরাধীদের হাতে মারা গেছে ৩৪ জন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক অনুশাসন কমে যাওয়া, প্রযুক্তির অপব্যবহার, কিশোরদের রাজনৈতিক ব্যবহারের কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের গ্যাং কালচার গড়ে উঠছে। পুলিশ বলছে, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনে ঘাটতি, আইনি জটিলতার কারণে কিশোর অপরাধ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। তবে কিশোর গ্যাংয়ের লাগাম টানতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারা জানিয়েছে, গত কয়েক বছরে কিশোর অপরাধী নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। তবে এর পাশাপাশি অভিভাবকদের আরো দায়িত্বশীল হওয়ার তাগিদ তাদের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের কেউ স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়েছে, কেউ বা এখনো পড়ছে। এদের সাথে যোগ হচ্ছে কিশোর বয়সের ছিনতাই ও মাদক মামলার আসামিরাও। এলাকায় আড্ডা আর খেলার ছলে অনেক কিশোরই জড়িয়ে পড়ছে গ্যাং কালচারে। এরপর জড়িয়ে পড়ছে মাদক সেবন, মাদক কারবারি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুনাখুনিসহ নানা অপরাধে। প্রকাশ্যে রাস্তায় গুলি করতেও তাদের হাত কাঁপছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশের কঠোর নজরদারি এবং পরিবারের নজরদারি ও মূল্যবোধ দিয়ে এই কিশোর অপরাধ অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব।

সম্প্রতি কদমতলী ও মুগদায় কিশোর গ্যাংয়ের হাতে এমন দু’টি খুনের ঘটনায় পুলিশ ১৪ জনকে গ্রেফতার করে। মুগদার মান্ডায় হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগে যারা গ্রেফতার হয়েছে, তারা কিশোর। ‘সালাম’ না দেয়াকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষ দ্বন্দ্বে জড়ায় এবং এতে হাসান নামের একজন খুন হয়। এ ঘটনায় সাতজনকে আসামি করে মামলা হয়েছিল। তাদের ছয়জন গ্রেফতার হয়েছে। এর বাইরে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত আরেকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

ডিএমপির অপরাধ পর্যালোচনার তথ্য অনুযায়ী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ৪০টির মতো কিশোর গ্যাং রয়েছে। প্রতিটি গ্যাংয়ের সদস্য সংখ্যা ১৫-২০ জন। পুলিশ সূত্র জানায়, গত এক বছরে ঢাকায় অন্তত পাঁচটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তারা। এর মধ্যে উত্তরার কিশোর গ্যাং সবচেয়ে আলোচিত। সেখানে একাধিক গ্যাং রয়েছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে উত্তরায় ডিসকো ও নাইন স্টার গ্রুপের দ্বন্দ্বে নিহত হয় কিশোর আদনান কবির। তার পরের মাসে তেজকুনিপাড়ায় দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে খুন হয় কিশোর আজিজুল হক। ঢাকার বাইরে থেকেও প্রায়ই কিশোর গ্যাংয়ের দ্বন্দ্বে খুন-খারাবির খবর পাওয়া যায়। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি হাতিরঝিল এলাকায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ ৩৪৩ কিশোরকে আটক করে। তাদের মধ্যে ৭১ জনের বিরুদ্ধে ডিএমপি অ্যাক্টে মামলা দেয়া হয়েছে। আর ২৬৯ জনকে অভিভাবকের জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি শ্যামপুরের ফরিদাবাদ গ্লাস ফ্যাক্টরি একতা হাউজিং এলাকা থেকে আট কিশোরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে অভিভাবকদের জিম্মায় তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।

এ ছাড়া ঢাকার বাইরে গত ২ মার্চ বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কিশোর গ্যাং অপরাধ প্রতিরোধ ও মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে ৪৭ জন কিশোরকে আটক করেছে চাঁদপুর মডেল থানা পুলিশ। থানার ওসি মুহাম্মদ আবদুর রশিদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, পুলিশ সুপারের নির্দেশে চাঁদপুর প্রেস ক্লাব ঘাট থেকে অভিযান শুরু হয়ে ৫ নম্বর কয়লা ঘাট, স্ট্যান্ড রোড, বেদে পল্লী, ছায়াবানী রোড, নতুন আলিম পাড়া, প্রতাপ সাহা রোড, মিশন রোড বালুর মাঠ ও ট্রাক রোডে এই অভিযান পরিচালিত হয়। সন্ধ্যার পর শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করবে। তারা রাস্তায় থাকবে কেন? পাড়া-মহল্লার রাস্তায় সন্ধ্যার পর অকারণে কোনো শিক্ষার্থীকে ঘুরতে দেখলে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং অভিযান অব্যাহত থাকবে। কারণ, চাঁদপুরবাসীকে কিশোর গ্যাংমুক্ত একটি শহর উপহার দিতে চান তিনি। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, আইন, আদালত, পুলিশ বিভাগ যথেষ্ট না, পারিবারিক মূল্যবোধ বাড়াতে পরিবারের সবাইকে বোঝাতে হবে। এই অপরাধ হ্রাস করতে গিয়ে শাস্তি দেয়ার জন্য তাদের জেলখানায় পুরে রাখলে একটা জাতি কারাগারে অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে।

আমাদের দেশের কিশোর-কিশোরীরা অন্যান্য দেশের তুলনায় অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় উল্লেখ করে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধ ইদানীংকালে একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশের নজরদারি বাড়ালেই এটা কমে যাবে।

তিনি বলেন, বাঙালিরা মারামারি করে যখন রাজনৈতিকভাবে দলবদ্ধ হয়। মানুষ যখন দলবদ্ধ হয় তখন তাদের মধ্যে সাধারণত বুদ্ধি-বিবেচনা কমে যায়, উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এতেই অঘটন ঘটে। এটা কিশোরদের বেলায়ও প্রযোজ্য। তাদের দলবদ্ধ হওয়াটা অনেক সহজেই কমাতে পারে পুলিশ। তাই যে সব জায়গায় কিশোর গ্যাং বেশি বেপরোয়া ওইসব জায়গায় পুলিশের নজরদারি বাড়ালেই সমস্যার অনেকখানি সমাধান হয়ে যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, কিশোরকেন্দ্রিক গ্যাং কালচারের প্রবণতা তখনই তৈরি হয়, যখন সমাজের মধ্যে অনেক রকম সমস্যা সৃষ্টি হয়, আর তখনই কিশোর অপরাধ বেড়ে যায়। কিশোর অপরাধ বেড়ে যাওয়ার কিছু কারণও উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি বলেন, প্রথমতো আমাদের জীবন ব্যবস্থাগুলো পরিবারকেন্দ্রিক। পরিবারের একজন তরুণ সদস্যকে কিভাবে সমাজের জন্য উপযোগী করে তৈরি করতে হবে সেই শিক্ষায় আমাদের এখানে যথেষ্ট পরিমাণে ঘাটতি রয়েছে। অনেক পরিবারে আমরা লক্ষ করি অভিভাবকরা কর্মের কারণে হোক, আর সময়ের স্বল্পতার কারণে হোক তারা সন্তানদের ভরণ-পোষণ থেকে শুরু করে মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করে তাদের দায়িত্বের জায়গাটি সমাপ্ত করতে চান। কিন্তু একজন তরুণকে বৃহৎপরিসরে একজন মানবিক, সংবেদনশীল, অধিকারবোধসম্পন্ন মানুষ, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষ হিসেবে তৈরি করতে আরো যে কিছু শিক্ষার দরকার আছে সে বিষয়টি পরিবার থেকে আসাটা খুব জরুরি। কিন্তু এই শিক্ষাটা বা এই পরিবেশটা আমরা ঘাটতি লক্ষ করছি।

দ্বিতীয়ত, কিশোরদের রাজনীতিতে ঢুকানো হচ্ছে। একটা এলাকায় যে রাজনৈতিক কোন্দলগুলো রয়েছে, সে কোন্দলগুলোকে ধরে রাখা, প্রতিপক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করা, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে প্রায় প্রতি রাজনীতিকেরই একটা করে গ্রুপ থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিশোরদের দিয়ে এ গ্রুপ তৈরি করলে কম খরচে গ্রুপটাকে পরিচালনা করা সম্ভব হয়।

তিনি বলেন, সব পরিবারের অর্থনৈতিক ভিত্তি এক রকম নয়। এখানে অভাব রয়েছে, অনটন রয়েছে, অভিযোগ রয়েছে। আমাদের রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ এই বিষয়গুলোকে পুঁজি করে তাদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করে। তার কিছু অভাব পূরণ করেন এবং সেই অভাব পূরণ করতে গিয়ে তাকে দিয়ে নানা ধরনের অন্যায় কাজ করান। তখন ওই কিশোরের মনে একটা বিশ^াস তৈরি হয়, যেকোনো কাজ আমি করতে পারি। এক্ষেত্রে বিপদে পড়লে আমাকে বাঁচানোর জন্য একজন রয়েছেন। এভাবে তার মধ্যে একটা হিরোইজম সৃষ্টি হয়। তৃতীয়ত. প্রযুক্তিকে বন্ধ করে আমরা থাকতে পারব না। এটিকে সাথে নিয়েই আমাদের চলতে হবে। কিন্তু যে দেশগুলোতে এই প্রযুক্তির কারণে তরুণদের মধ্যে বিকৃত কিংবা অপরাধমূলক আচরণ বৃদ্ধি পেয়েছে সেই সমস্ত দেশেগুলো মূলত প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ করে তাদের মতো করে পরিচালনা করছেন। এর সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হলো মালয়েশিয়া। কিন্তু আমাদের এখানে আমরা প্রযুক্তিকে যেভাবে ঢালাওভাবে ব্যবহার করছি, সবার হাতে তুলে দিচ্ছি। পরিবারগুলোকে সামাজিক ভূমিকা পালন করতে হবে। পরিবারের বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে। সামাজিকভাবে প্রতিরোধের জায়গাটি থাকতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকাগুলো আদর্শিক হতে হবে এবং সমাজের মধ্যে সততার আদর্শের যে দৃষ্টান্ত সেটি স্থাপন করতে হবে। সর্বোপরি কিশোরদেরকে রাজনীতি থেকে মুক্ত রাখতে হবে। এ ছাড়াও সমাজের শিক্ষক, অভিভাবক, জনপ্রতিনিধি বা যাদের কথা শুনবে, এমন ব্যক্তিদের নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগে এ কিশোর গ্যাং কালচার থেকে বিপথগামী কিশোরদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

সাম্প্রতিক কয়েকটি হত্যাকাণ্ড : গত ২৬ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার পালাসুতা গ্রামে ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে মাঠেই ছুরিকাঘাতে মোহাম্মদ আমিন (১৬) নামের এক কিশোর খুন হয়। গত ১২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় রাজধানীর মান্ডায় হাসান (১৭) নামের এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। স্থানীয় কিশোর গ্রুপের মধ্যে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের জেরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। গত ৮ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পথে কামরাঙ্গীরচরে খুন হয় ১২ বছরের শিশু সিফাত। জানা গেছে, বাসায় ফেরার পথে নিজের বয়সী এক শিশুর পা মাড়িয়ে দেয় সিফাত। এ নিয়ে দুইজনের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে শিশুটি তার সঙ্গীদের নিয়ে সিফাতকে ধাওয়া করে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিফাতের মৃত্যু হয়।


আরো সংবাদ



premium cement