প্রতারণার আরেক ফাঁদ ‘ভাইরাস শাট আউট কার্ড’
- শহিদুল ইসলাম রাজী
- ০১ জুলাই ২০২০, ০৫:৪৬
মহামারী করোনাভাইরাসের এ দুর্যোগকালে সুরক্ষার নামে অভিনব কৌশলে প্রতারণা করছে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী চক্র। এরা সুরক্ষার নামে ফাঁদ পেতে মানুষের কাছে বিক্রি করছে ক্ষতিকর চিকিৎসাসামগ্রী। বিক্রি বাড়াতে এবং সাধারণ মানুষের নজর কাড়তে সামাজিক মাধ্যম তথা অনলাইনে দেয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। এতে আকৃষ্ট হয়ে ওই সব পণ্য কিনে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন ভুক্তোভোগীরা। আর মহামারীর এ দুর্যোগকে কাজে লাগিয়ে ক্রেতাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি। নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, পিপিইসহ বিভিন্ন সামগ্রী বাজারজাত করছে তারা। এগুলোর মধ্যে করোনা রোধে নতুন প্রতারণার আরো একটি ফাঁদ পেতেছে এই চক্রটি, যার নাম ‘ভাইরাস শট আউট কার্ড’। বলা হচ্ছে, এই কার্ড ঘাড়ে রাখলে এক মাস করোনামুক্ত থাকা যাবে এমন বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে ক্ষতিকর এ চিকিৎসাসামগ্রী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাইরাস শাট আউট কার্ড নামের পণ্যটিতে ক্লোরিন ডাই-অক্সাইড নামে একধরনের কেমিক্যাল রয়েছে, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর।
জানা গেছে, ‘ভাইরাস শাট আউট’ নামে চীন থেকে আনা কার্ডগুলো মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর এবং চীনও নিষিদ্ধ করেছে এগুলো। অথচ ‘জি মামা’ নামে একটি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে বিক্রি করা হচ্ছে এই কার্ড। শুধু তাই নয়, রাজধানী ঢাকায় চিকিৎসাসরঞ্জাম বিক্রির সর্ববৃহৎ পাইকারি বাজার বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ভবনে বিক্রি হচ্ছে এসব ভুয়া কার্ড। ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের বিভিন্ন ফার্মেসিতেও পাওয়া যাচ্ছে এসব ভুয়া কার্ড। তাই তারা বলেছেন, সারা দেশে ফার্মেসিগুলোতে এসব বাজেয়াপ্ত করতে অভিযান চালানো হবে।
জি মামা ফেসবুক পেজ ঘেঁটে দেখা গেছে নানা চটকদার বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনে ‘ভাইরাস শাট আউট’ নামে ওই কার্ডের কার্যকারিতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, কার্ডটি গলায় ঝুলালে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, অ্যালার্জি, ছত্রাক থেকে মুক্ত থাকা যায়। কার্ডে রয়েছে ক্লোরিন ডাই-অক্সাইড, যা আশপাশের জীবাণু ও ভাইরাসের বিরুদ্ধে বাধা তৈরি করে। ঢাকার মধ্যে হোম ডেলিভারি ফ্রি উল্লেখ রয়েছে বিজ্ঞাপনে। কার্ডটি স্কুলগামী শিশুর সুরক্ষায় অত্যন্ত কার্যকর। কেউ গলায় মালার মতো করে একবার পরলে এক মাস পর্যন্ত করোনাভাইরাস তার তিন ফুটের মধ্যে আসতে পারবে না।
গতকাল বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ভবনে অভিযান চালিয়ে তথা কথিত করোনা রোধক এই কার্ডের বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্ষতিকর চিকিৎসাসামগ্রী বিক্রির অপরাধে দুই চিকিৎসাসরঞ্জাম ব্যবসায়ীকে একে লাখ ২৪ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ঢাকা জেলা প্রশাসন ও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর যৌথভাবে দিনব্যাপী অভিযান পরিচালনা করে। অন্য দিকে গতকাল রাজধানীর উত্তরায় পৃথক অভিযানে ভাইরাস শাট আউট কার্ড জব্দ করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলাম। এর আগে গত ২০ এপ্রিল মৌচাক মোড় থেকে টিপু সুলতান নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশ। পরে ভোক্তা অধিকার আইনের ৪৪ ধারায় তাকে এক লাখ টাকা জরিমানা করেন ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহনাজ হোসেন ফারিবা।
ডিএমপির এক কর্মকর্তা জানান, টিপু সুলতান অনলাইনে এক ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এ কার্ডের দুই হাজার টাকা দাম চান। পরে কার্ড বিক্রি করতে এসে ধরা পড়েছেন। তিনি তার অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন। ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, টিপু সুলতানের এ কার্ড বিক্রি করার কোনো লাইসেন্স না থাকলেও তিনি আমদানি করেন। ওষুধ প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া এগুলো বিক্রি করা অপরাধ। এরপরও তিনি অনলাইনে অর্ডার নিয়ে এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকায় এ কার্ড বিক্রি করে আসছিলেন।
পুলিশ জানায়, একটি হাউজিং প্রকল্পে চাকরি করত টিপু সুলতান। এর পাশাপাশি অনলাইনে ‘জি মামা’ নামের পেজ খুলে করোনা প্রটেক্টর বিক্রির এ কারবার করে আসছিল। ভাইরাস শাট আউট নাম দিয়ে এ কারবার করছিল টিপু সুলতান। সে প্রচার করছে, এ কার্ড গলায় পরলে আশপাশে তিন ফিটের মধ্যে কোনো করোনা থাকবে না।
সে জানিয়েছে, চীন থেকে ডিএইচএল কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ২০০ পিস আমদানি করেছে। কিন্তু কাস্টমস থেকে ৫০ পিস রেখে দিয়েছে। ৫০ পিসসহ পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এ ছাড়া ১০০ বিক্রি করেছে। কার্ডগুলো কিনতে তার খরচ পড়েছে ৪০০ টাকা; কিন্তু এগুলো বিক্রি করা হতো ১৫ শ’ থেকে দুই হাজার টাকা করে।
বিএমএ ভবনে অভিযান শেষে ঢাকা জেলা প্রশাসনের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মাহনাজ হোসেন ফারিবা বলেন, একটি কার্ড ঘাড়ে রাখলে এক মাস করোনামুক্ত বা প্রতিরোধ করবে, এমন করোনা রোধক কার্ডের বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্ষতিকর চিকিৎসাসামগ্রী বিক্রির প্রমাণ মেলে। এটা একধরনের প্রতারণা। তিনি জানান, এ জন্য বায়োমেডিকস নামে প্রতিষ্ঠানকে ভাইরাস শাট আউট কার্ড ও নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখায় ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, বায়োনিডস প্রতিষ্ঠানকে ভাইরাস শাট আউট কার্ড রাখায় ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং আজমেরী কমপ্লেক্সকে নকল ও অননুমোদিত কে এন ৯৫ মাস্ক মজুদ এবং বিক্রি করায় ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তিনি বলেন, এই কার্ড করোনা প্রতিরোধে সক্ষম এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এতে একধরনের কেমিক্যাল উপাদান ক্লোরিন ডাই-অক্সাইড আছে। এগুলো মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। তিনি বলেন, এটি আন্তর্জাতিক চক্রান্তের একটি অংশ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আমরা সত্যিই অবাক হয়েছি, বিএমএ ভবনে এ ধরনের ভুয়া কার্ড বিক্রি হচ্ছে দেখে। বিএমএ ভবন মালিক সমিতির নেতারা আশ্বাস দিয়েছেন, এ ঘটনায় তারা ব্যবস্থা নেবেন এবং এই কার্ড পরবর্তী সময়ে আর বিক্রি করতে দেয়া হবে না। এ দিকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কয়েকজন ব্যক্তি বিএমএ ভবনে এসে তাদের কার্ড সরবরাহ করতেন। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তারা দোকান থেকে বিক্রির পাশাপাশি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করছিলেন।
বিএমএ ভবন দোকান মালিক কল্যাণ সমিতির যুগ্ম সচিব মো: ইলিয়াস লসকর সাংবাদিকদের বলেন, তারা বিষয়টি জানতেন না এবং কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও কোনো ধরনের নোটিশ পাননি।
ওষুধ প্রশাসনের সহকারী পরিচালক মো: আজিউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, এই কার্ডের বিষয়টি আমরা জানতে পেরেছি। এতে করোনা প্রতিরোধে সক্ষম এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এটা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। সারা দেশে ফার্মেসিগুলোতে অভিযান চালানো হবে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা জানি না কিভাবে এই ভাইরাস শাট আউট কার্ড খালাসের অনুমতি দেয়া হলো। আমরা এই ওষুধের অনুমোদন দিইনি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা