১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

উগান্ডা যেভাবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে

অনুশীলনে উগান্ডার ক্রিকেটাররা - ছবি : সংগৃহীত

উগান্ডা দেশটির নাম বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই দেখা যায়। বাংলাদেশের সাথে খুব আহামরি সম্পর্ক নেই দেশটির।

কিন্তু বাংলাদেশে যে কোনো দুরবস্থার কথা কিছুটা ব্যাঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপন করতে বিকল্প কোনো দেশের নাম ব্যবহার করার প্রয়াসেই উগান্ডার নাম নিয়ে আসেন অনেকে। এবং এটা অনেকটা মজা করেই করে থাকেন তারা।

পূর্ব আফ্রিকার সেই উগান্ডা এবারে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলবে।

স্থলবেষ্টিত দেশটি ‘আফ্রিকার মুক্তা’ হিসেবে পরিচিত, কফি চাষের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত উর্বর এই ভূমি থেকে উঠে এসেছেন কজন ক্রিকেটার যারা এবারে বিশ্বকাপও খেলবে।

বছর খানেক আগেও যা ছিল কল্পনার বাইরে। কারণ উগান্ডার ক্রিকেটাররা এমন একটা পরিবেশ থেকে উঠে এসেছেন, যেখানে ভালো নেট নেই অনুশীলনের জন্য।

কিছু কিছু লেখায় উঠে এসেছে উগান্ডার কাম্পালায় যে অনুশীলনের জায়গা সেখানে একজন ফাস্ট বোলারের দৌড়ানোর মতো জায়গা নেই।

উগান্ডার ক্রিকেটারদের ক্রিকেট সামগ্রী কিনতেও যেতে হতো কেনিয়ায়, কারণ উগান্ডায় ক্রিকেট সামগ্রীর কোনো দোকান নেই।

উগান্ডার ক্রিকেটের ইতিহাস কিন্তু একেবারে সাম্প্রতিক নয়, ১৯৭৫ সালে পূর্ব আফ্রিকা নামে ক্রিকেট খেলেছে উগান্ডা, কেনিয়া, তানজানিয়া ও জাম্বিয়া।

এরপরে ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি খেলেছে পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকা নামে।

এবারে আর মহাদেশীয় অঞ্চল না একেবারে দেশের নাম দিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের ইভেন্ট খেলবে উগান্ডা।

এই বিশ্বকাপটা উগান্ডার ক্রিকেটারদের জন্য ‘স্বপ্নের মতো’, পৃথিবীর অনেক দেশের মতো উগান্ডাতে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল, ক্রিকেটাররা কিছুটা নজরে আসতে চান কারণ ক্রিকেট খেলাটা চালিয়ে যেতে হলে তাদের পৃষ্ঠপোষক প্রয়োজন একইসাথে প্রয়োজন সরকারের সমর্থন।

সেটা হয়তো এখন থেকে পাওয়া শুরু করবেন বলে আশা করছেন উগান্ডার পুরুষ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ব্রায়ান মাসাবা।

তিনি বলেন, আমাদের যে সুযোগ সুবিধা দেয়া হয় দেশে সেটাকে খুব ভালো বলা যাবে না, তাই আমার মতে উগান্ডার বিশ্বকাপ খেলাটা একরকম অলৌকিক বটে। এটা একতা স্বপ্নের মতো ব্যাপার।’

বিশ্বকাপে উগান্ডার গ্রুপে আছে নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আফগানিস্তান ও পাপুয়া নিউ গিনি।

এই ক্রিকেটারদের বিপক্ষে মাঠে নামাটাকে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসের বড় ব্যাপার মনে করেন মাসাবা।

উগান্ডার ক্রিকেটীয় উত্থান
১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের সহযোগী দেশ হিসেবে ক্রিকেটের পরিসরে ঢোকে উগান্ডা, কিন্তু আদতে উগান্ডার ক্রিকেট গুছিয়ে ওঠে ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে।

এই সময়ে কোচ লরেন্স মাহাটলেইন, টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলার লক্ষ্যে উগান্ডা ক্রিকেট দলের সাথে কাজ করেন।

দলটির অধিনায়ক মাসাবা বলেন, ‘কোচের কাজ ছিল সুনির্দিষ্ট। তিনি এই টি২০ বিশ্বকাপে খেলানোর একটা কার্যকর পরিকল্পনা নিয়েই মাঠে নেমেছিলেন এবং সফল হয়েছেন।’

প্রথমত ক্রিকেটারদের চুক্তিবদ্ধ করা হয় যাতে উগান্ডার ক্রিকেটাররা একটা পেশাদার মঞ্চ পান, এরপর দলটিকে প্রচুর ম্যাচ খেলানোর সুযোগ দেয়া হয়।

২০২১ সালের পর থেকে উগান্ডা পুরুষ আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছে, এটা প্রমাণ করে কতোটা সংকল্পবদ্ধ ছিল দলটির পরিকল্পনা।

এই সময়ের মাঝে উগান্ডা বেশিরভাগ ম্যাচ খেলেছে রুয়ান্ডা ও তানজানিয়ার বিপক্ষে, গত ২ বছরে ৫৯ ম্যাচে মাত্র ৮টিতে হেরেছে দলটি।

এতে করে দলটি খুব শক্তিমত্তা অর্জন না করলেও টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটে কিভাবে ম্যাচ বের করতে হয় সেই ধারণাটুকু হয়েছে।

শেষ পর্যন্ত সাবেক টেস্ট খেলুড়ে দেশ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি–টোয়েন্টি ম্যাচ জিতে বিশ্বকাপে খেলা নিশ্চিত করে উগান্ডা।

উগান্ডার ক্রিকেট ইতিহাসে কখনো কোনও জার্সিতে স্পন্সর ছিল না, এবার দলটি জার্সি স্পন্সর পেয়েছে, এটাই প্রমাণ করে দলটির জন্য এই অর্জন কতোটা গুরুত্বপূর্ণ।

মাসাবা বলেছেন, এই ইতিহাসের অংশ হবো, এটা কখনো ভাবনাতে আসেনি।

‘এটা একটা লম্বা যাত্রা, আমার অভিষেক হয়েছিল ২০১১ সালে, তাই আমি জানি এই জায়গায় আসতে আমাদের কতোটা কষ্ট করতে হয়েছে।

উগান্ডার প্রথম লক্ষ্য মাঠে নেমে একটা প্রভাব ফেলার চেষ্টা করা, অধিনায়ক মাসাবা বলেছেন, আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো আমাদের সংস্কৃতি তুলে ধরা, ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক দর্শকরা যাতে দেখে উগান্ডা নামের একটা দেশ ক্রিকেট খেলছে।

উগান্ডা ক্রিকেট দলের ডাকনাম ‘দ্য ক্রেইন্স’
ক্রিকেট ক্রেইন নামের পেছনে আছে একটি পাখি, ক্রেস্টেড ক্রেইন, এটি উগান্ডার জাতীয় পাখি।

অধিনায়ক ব্রায়ান মাসাবা বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের অনুষ্ঠান স্টাম্পডে বলেন, উগান্ডার জাতীয় পাখি ক্রেস্টেড ক্রেইনের নাম ধরেই আমাদের ক্রেইন বলে ডাকা হয়।

উগান্ডার বেশ কটি স্পোর্টস টিমের নামের সাথেই এই পাখির নাম জড়িত।

সবচেয়ে বয়স্ক ক্রিকেটার ফ্রাঙ্ক নাসবুগা
অফস্পিনার ফ্রাঙ্ক নাসবুগা ১৬ বছর বয়স থেকে উগান্ডার জাতীয় দলে খেলছেন। প্রায় তিন দশক পরে তার বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে।

পাঁচ বছর আগে উগান্ডা বিশ্ব ক্রিকেট লিগের চতুর্থ ধাপে অবনমিত হয়েছিল তখনো দেশটির ক্রিকেটাররা ভাবতে পারেননি কখনো তাদের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলা হবে।

নাসবুগা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমাদের জন্য এটা ছিল চমকের মতো। জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে বিশ্বকাপে খেলবো আমরা, ছেলেরা খুবই উচ্ছ্বসিত এবং এই অভিজ্ঞতা নিতে মুখিয়ে আছে। আমি তো ২৭ বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম।

অগাস্টেই এই ক্রিকেটারের বয়স হবে ৪৪ বছর। তিনি এরপর কোচিং করানোর আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন এছাড়াও উগান্ডার ক্রিকেট নিয়ে কাজ করবেন তিনি, ‘আমাদের ক্রিকেটকে গ্রামে নিয়ে যেতে হবে, নানা জায়গা থেকে ক্রিকেটার তুলে আনতে হবে। আমাদের আপাত কিছুটা পেশাদারিত্ব আসছে, যেটা ভালো।’

ফ্রাংকের ব্যাপারে অধিনায়ক মাসাবা প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কী বলবো তার ব্যাপারে, তিনি একেবারে শুরু থেকে আছেন, আমি ছোট ছিলাম যখন ফ্রাঙ্কের খেলা দেখেছি। তিনি উগান্ডার ক্রিকেটের সাথে সবসময় আছেন। আমরা যতদূর এসেছি এর পেছনে ফ্রাঙ্কের অবদান আছে।

ফ্রাঙ্ক নাসবুগা বিশ্বকাপের পরে আর খেলবেন না বলে জানিয়েছেন।

উগান্ডা ক্রিকেটের এই পর্যন্ত আসার পেছনে অবদান আছে এক অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট ক্লাবেরও, কাম্পালার ক্রিকেট পাড়ায় গেলে প্রায়ই চোখে পড়ে অস্ট্রেলিয়ার পুরনো সবুজ হেলমেট বা নিউ সাউথ ওয়েলসের জার্সি।

২০০৪ সালে অনুর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার যুবদলের দেখাশোনা করছিলেন ব্রায়ান ফ্রিম্যান, তখন তার নজরে আসে উগান্ডার ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়রা, যাদের কাছে ক্রিকেট সামগ্রী ছিলনা বললেই চলে, মাঠেই তারা সতীর্থদের সাথে সামগ্রী শেয়ার করে ক্রিকেট খেলতেন।

ব্রায়ান ফ্রিম্যান ২০০৫ সাল থেকেই নানা ধরনের ক্রিকেট সরঞ্জাম উগান্ডায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।

ফ্রিম্যান দ্য গার্ডিয়ানকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়াটা অনেক বড় ব্যাপার, এখানে আমরা অবদান রাখতে পেরে খুশি, আমরা তাদের থেকে অনেক ধন্যবাদ পেয়েছি, আমরা অভিনন্দন জানিয়েছি। তবে মনে রাখবেন, এই অর্জনটা একান্ত তাদের।

‘যেকোনো দলকে হারাতে পারবো’
সম্প্রতি বাংলাদেশের বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র টি–টোয়েন্টি সিরিজ জিতেছে, এটা দেশটির বিশ্বকাপ ক্যাম্পেইনে একটা ইতিবাচক শুরুর আশ্বাস দিচ্ছে।

ফাস্ট বোলার আলি খানের জন্য এই বিশ্বকাপটা বিশেষ কিছু, তিনি যখন নিজ দেশ পাকিস্তান ছেড়ে আমেরিকায় পাড়ি জমান তখন তার উদ্দেশ্য ছিল কেবলই অর্থ উপার্জন।

একটি মোবাইল ফোন কোম্পানির বিক্রয় কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতেন তিনি।

মাঝেমধ্যে সুযোগ পেলে ওহাইও থেকে শিকাগো গিয়ে ক্রিকেট খেলতেন।

২০১৫ সালে আলি খান ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি কোর্টনি ওয়ালশের নজরে আসেন।

এরপর ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে খেলেন তিনি, কিন্তু চোটের কারণে সুবিধা করে উঠতে পারেননি। পরে ডোয়াইন ব্রাভো তাকে আবারো নিয়ে আসেন সিপিএলে, সেই থেকে শুরু, একে একে বিশ্বের নানা লিগে খেলার ডাক পান আলি খান।

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগেও ডাক পেয়েছেন তিনি।

আলি খান এবারে বিশ্বকাপ খেলতে মুখিয়ে আছেন এবং তিনি মনে করছেন যেকোনো দলকেই হারাতে পারবে যুক্তরাষ্ট্রের টি–টোয়েন্টি দল।

এই দলে আছেন ভারতের হয়ে অনুর্ধ্ব ১৯ ক্রিকেট খেলা দুজন, নিউজিল্যান্ডের হয়ে জাতীয় দলে খেলা কোরি অ্যান্ডারসন। সূত্র : বিবিসি

 

 


আরো সংবাদ



premium cement