১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হাশিম আমলা, মুসলিম ক্রিকেটারদের অনুপ্রেরণার উৎস

হাশিম আমলা, মুসলিম ক্রিকেটারদের অনুপ্রেরণার উৎস। - ছবি : সংগৃহীত

ক্রিকেটের অতিমানবীয় একজন ধারক ও বাহক ক্রিকেটের ভদ্রলোক খ্যাত ‘হাশিম আমলা।’ তিনি ছিলেন ক্রিকেটের বজ্রপাতহীন এক ঝড়। পৈশাচিক নয়, তবে নীরব ঘাতক। বলের চাওয়া অনুযায়ী খুঁটে খুঁটে রান করা আর ব্যাকরণসম্মত ব্যাটিংয়ে সুযোগ মতো বাউন্ডারি আদায় করে নেয়া ছিলো আমলার মূলমন্ত্র। নান্দনিক ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি ছিলেন ধারাবাহিকতার প্রতিচ্ছবিও।

আধুনিক ক্রিকেটে হয়ত বিরাট কোহলির মতো জনপ্রিয় ছিলেন না, এ বি ডি ভিলিয়ার্সের মতো ঝড়ও হয়ত তুলতেন না, হাঁকাতেন না ডেভিড ওয়ার্নারের মতো বিশাল বিশাল ছক্কা। কিন্তু তবুও তিনি এমন কিছু করেছেন, যা তারাও পারেননি। কখনো ছাপিয়ে গেছেন ক্রিকেট গ্রেট শচীনকেও। ছিলেন একজন প্রকৃত রেকর্ড ব্রেকার লিজেন্ডারি ক্রিকেটার।

বিশ্বের দ্রুততম ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডে ক্রিকেটে দুই হাজার, তিনি হাজার, চার হাজার, পাঁচ হাজার, ছয় হাজার ও সাত হাজার রানের মাইলস্টোন ছোঁয়া ব্যাটসম্যান আমলা।

ওয়ানডে ও টেস্ট উভয় ফরম্যাটে ৪৫+ গড়ে আট হাজার রান করা ক্রিকেটার বিশ্বে মাত্র দু’জন। তাদের একজন হাশিম আমলা, অপরজন সতীর্থ ডি ভিলিয়ার্স। আবার উভয় ফরম্যাটে ২৫+ সেঞ্চুরি করা পঞ্চম ক্রিকেটার হাশিম আমলা। অন্য চারজন হলেন শচীন, পন্টিং, সাঙ্গাকারা ও কোহলি।

সাউথ আফ্রিকার প্রথম ও একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে ৩০০ রান করা ব্যাটসম্যান আমলা।

ওয়ানডেতে চারবার ১৫০+ রান তার।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৫০+ সেঞ্চুরি করা দ্রুততম ব্যাটসম্যান হলেন আমলা। পেছনে ফেলেছেন শচীনকে।

২৭ ওয়ানডে সেঞ্চুরির ২৪টিতে পেয়েছেন জয়ের স্বাদ, হার মাত্র তিনটিতে। অপরদিকে ২৮ টেস্ট সেঞ্চুরির ১৭ টিতে পেয়েছেন জয়ের দেখা, হারের সংখ্যা তিন।

ক্রিকেটের বাহিরেও আমলা হয়ে উঠতে পারেন যে কারো জন্যই অনুপ্রেরণার উৎস। যা ফুঁটে উঠে আমলার অবসরের দিনে দক্ষিণ আফ্রিকা দলের পারফরম্যান্স বিশ্লেষক প্রসন্ন আগোরামের এক গল্পে। ওই গল্পের শিরোনাম ছিল, ‘রংধনুর দেশ তার রং হারাল।’ মূলত দক্ষিণ আফ্রিকাকে ‘রংধনুর দেশ’ নাম দিয়েছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা, সে অবশ্য ভিন্ন এক প্রসঙ্গ। তবে আগোরামের কাছে রংধনুর দেশের ‘রং’ ছিলেন হাশিম আমলা।

আমলাকে নিয়ে আগোরামের বিশেষ কিছু গল্প ছিল, গল্পগুলো আগোরামের ভাষায় :

হাশিম আমলা যখন তার ঘরের মাঠ ডারবানে অবসর নিচ্ছেন। হাত তুলে জবাব দিচ্ছে দর্শক অভিবাদনের। আদিখ্যেতা দেখিয়ে, ‘এই সম্মানটুকু আপনার প্রাপ্য’ বলতেই বুঝলাম তাকে আরো ভালো করে জানা-বুঝা উচিত ছিল। কারণ জবাব এলো, ‘আপনাকে আগেও তো বলেছি, জীবনে প্রাপ্য বলে কিছু নেই। আমি যথেষ্ট পেয়েছি, ১০০ টেস্ট খেলে ফেলেছি। তাছাড়া, বিশ্বকাপ শেষে থেমে যাওয়াটাও খুব ভালো, তরুণেরা সুযোগ পাবে। বিদায় সংবর্ধণাদ পেতে ঝুলে থাকলে নিজের কাছেই নিজের সম্মান থাকবে না। এটা দল কিংবা দেশের স্বার্থের সঙ্গে যায় না। আর সৃষ্টিকর্তা আমাকে যা দিয়েছেন তা নিয়ে আমি সন্তুষ্ট ও কৃতজ্ঞ।’

হাশিম আমলার ঘরে রাতের খাবার খেয়েছিলাম। খাওয়া শেষে ভাবছিলাম প্লেটটা কোথায় রাখব? আমলা হঠাৎ আমার হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে নিলেন, খাবারের উচ্ছিষ্ট নিজ হাতে ময়লা রাখার ঝুড়িতে ফেলে প্লেটটা রাখলেন বেসিনে। ঘটনার আকস্মিকতায় অস্ফুট স্বরে প্রতিবাদ জানিয়ে কিছু বলতে যাব, তার আগেই সে বলে উঠল, ‘আরে ভাই, আপনি আমার ঘরে এসেছেন। আপনি আমার ভাই। কিছু ক্ষেত্রে আমার ওস্তাদও। আপনাকে সম্মান করার সুযোগটুকু দিন।’

আমি অতটা খেতে পারি না, আর সেদিন প্লেটের খাবারও শেষ করতে পারিনি। উঠে দাঁড়াব, এমন সময় সে বলল, ‘ভাই, খাবার নষ্ট করবেন না।’ এরপর সে আমার প্লেটে খাবারের অবশিষ্ট অংশ নিজের প্লেটে নিয়ে খেতে শুরু করল। আমি আবারও হতবাক, সেদিন বুঝেছি ভালো মানুষ হয়ে উঠতে জীবনে কী কী পরিবর্তন দরকার।

২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্টে ১৯৬ রানে আউট হওয়ায়, দুঃখ প্রকাশ করতে তাকে বললাম, ‘ভাই, আপনার ডাবল সেঞ্চুরি পাওনা ছিল।’ আমি এ কথা বলার পর তার উত্তর ছিল, ‘একটা কথা মনে রাখবেন, জীবনে কখনো কিছু পাওনা থাকে না। পুরোটাই সৃষ্টিকর্তার কৃপা। মনে আছে, আমি ৪ রানে থাকতে একটি ডেলিভারি ব্যাটের কর্নারে লেগে স্টাম্পের খুব কাছ ঘেঁষে চলে গেছে। ওটা বোল্ড হওয়া উচিত ছিল, ডেলিভারিটা ছিল দারুণ। অস্ট্রেলিয়ানদের উইকেটটা পাওনা ছিল। ওরা হয়ত ড্রেসিং রুমে আলোচনা করছে। আমি কত ভাগ্যবান! আরো ১৯২ রান করেছি, যা পাওনা ছিল এটা তার চেয়েও বেশি। এ কারণে আমি যে রান করেছি তা নিয়েই কৃতজ্ঞ।’

২০১৫ সাল, বেঙ্গালুরুতে ঝুম বৃষ্টিতে ভেসে গেছে টেস্টের চারটা দিন। হঠাৎ এক দিন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ইমরান তাহির ও এক নিরাপত্তাকর্মী নিয়ে বাসার দরজায় হাজির হাশিম আমলা। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ঘরে পর্যাপ্ত বসার জায়গাও ছিল না। কিন্তু আমলা ভেতরে ঢুকে সোজা মেঝেতে বসে পড়লেন। তাকে মানা করতেই বললেন, ‘আপনার ঘরের মাপ নিতে এখানে আসিনি। ভালোবাসা থেকে এসেছি। আপনি আমার ভাই। দয়া করে এক কাপ মসলা চা দিন।’ সে এটা খুব পছন্দ করে এবং আরেক কাপ চাইল।

২০১০ সালের একটি স্মৃতি। সে বছর তার সাথে প্রথম দেখা হয়। ভারত তখন দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করছে। হাশিম এসে বললেন, ‘একটু সাহায্য করতে পারেন?’ আমি বললাম, আপনি জীবনের সেরা ফর্মে, কী আর সাহায্য করতে পারি? বললেন ‘না, না, আমি সিরিয়াস। কেউই নিখুঁত নয়। সবশেষ সিরিজে আপনার বিশ্লেষণ আমার ভালো লেগেছে। আমি আরো শিখতে চাই, বেড়ে উঠতে চাই। খেলাটা তো যে কারো চেয়ে বড়। কেউ সব শিখতে পারে না। পেসারদের ভালো খেলছি কিন্তু হরভজন সিংকে সামলাব কিভাবে? সে তো এই উইকেটে বাউন্স পাবে।’

দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গেলে প্রায় প্রতি রাতেই সে আমার রুমে এসে চা খেতেন, ক্রিকেট কিংবা যা ভাবছে তা নিয়ে আলাপ হতো। কখনো আমার পছন্দের ভাত ও রুটি খেতে পারছি না বুঝতে পারলে আমাকে সে তার বন্ধুর বাসায় নিয়ে গিয়ে ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করত।

অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়ে আমলা বলেছিলেন- ‘বিশ্বকাপ শেষেই থেমে যাওয়াটা খুব ভালো। কিছু তরুণেরা সুযোগ পাবে। বিদায় সংবর্ধনার জন্য ঝুলে থাকলে নিজের কাছেই নিজের সম্মান থাকবে না আর। এটা দল আর দেশের স্বার্থের সাথে যায় না। আর সৃষ্টিকর্তা আমাকে যা দিয়েছেন তা নিয়ে অনেক সন্তুষ্ট আর কৃতজ্ঞ।’

আমলা আসলেই ভিন্ন এক মানুষ। যদি কখনো বলি, ভালো খেলেছেন কিংবা অসাধারণ ব্যাট করেছেন। তাহলে জবাব দিবেন, ‘সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।’ কিংবা প্রসঙ্গ পাল্টে বলবেন, ‘আমার ইনিংসের চেয়ে ডেল স্টেইনের ৩ উইকেট অনেক মূল্যবান ছিল।’

আমি যেমন কখনো তাকে রাগ করতে দেখিনি, তেমনি গর্ব করতেও দেখিনি। এমনকি খুব ব্যক্তিগত পরিবেশেও নয়। কারণ সে অভিনেতা নয়, সে এমনই, হাশিম আমলা একজনই। আমার সন্তান তার ব্যক্তিত্বের ৫০ ভাগ পেলেও গর্ব লাগবে। নিজেকে একজন গর্বিত বাবা বলেই মনে করব। তার মতো এতটা বিনয়ী, নিঃস্বার্থ ও মাটির মানুষ আর কাউকে দেখিনি।


আরো সংবাদ



premium cement
মাত্র ২ বলে শেষ পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টি জেলে কেজরিওয়ালকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দলের ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিকসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা তোকে যদি এরপর হলে দেখি তাহলে খবর আছে, হুমকি ছাত্রলীগ নেতার বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক মামলা করা হয়নি : প্রধানমন্ত্রী দাওয়াতী ময়দানে সকল নেতাদের ভূমিকা রাখতে হবে : ডা. শফিকুর রহমান চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেল শ্রমিকদের মাঝে ইসলামের আদর্শের আহ্বান পৌঁছাতে হবে : ডা. শফিকুর রহমান ঢাকা শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে বিমানবন্দরের টার্মিনালে ঢুকে গেলো বাস, ইঞ্জিনিয়ার নিহত গোয়ালন্দে প্রবাসীর স্ত্রী-সন্তানকে মারধর, বিচারের দাবিতে মানববন্ধন

সকল