২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কোহলি-রোহিতের 'ইগো ফাইট', সমস্যায় ভারতীয় ক্রিকেট

কোহলি-রোহিত - ছবি সংগৃহীত

সুনীল গাভাসকার-কপিল দেব। সৌরভ গাঙ্গুলি-রাহুল দ্রাবিড়। মহেন্দ্র সিং ধোনি-বীরেন্দ্র শেহওয়াগের পর ভারতীয় ক্রিকেটে সবচেয়ে চর্চিত 'ইগো ফাইট' বিরাট কোহলি-রোহিত শর্মাকে নিয়ে। দুই মহাতারকা নিজ মুখে কোনো দিন স্বীকার করবেন না। তবে এটা 'ওপেন সিক্রেট'।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পরই ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট ফরম্যাটের রাজপাট কোহলি তুলে রাখবেন। প্রেস রিলিজে তিনি বলেছেন, 'রবি শাস্ত্রী ও রোহিতের সাথে দীর্ঘ আলোচনার পরেই এই সিদ্ধান্তে এসেছি।' ফলে অনেকেই ভাবতে পারেন, দুই বন্ধুর দারুণ মনের মিল। এটা যারা ভাবছেন তারা একেবারেই ভুলের জগতের বাসিন্দা।

দুই তারকার 'ইগো ফাইট'-এর বীজবপন অনেক আগেই হয়েছিল। সেই ২০১১ বিশ্বকাপের আগে থেকে। দিল্লির কোহলির থেকে অনেক আগে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন মুম্বইকর রোহিত। কিন্তু নিজের প্রতিভার মর্যাদা তখন করতে পারেননি। ফলে ২০০৭ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দলের সদস্য হয়েও, ঘরের মাঠের পূর্ণাঙ্গ বিশ্বকাপে তাকে দলে নেননি তৎকালীন অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি । এর আগে থেকেই বিরাটের উত্থান শুরু হয়ে গিয়েছিল। বাকি সময়টা ছিল নিজের ডালপালা মেলে ধরার। রোহিতকে ছাপিয়ে অনায়াসে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। দলের 'স্থায়ী সদস্য' হতে না পারার জন্য রোহিতের মনে আক্ষেপ ছিলই। এবার সেটা পরিণত হলো ইগোর লড়াইয়ে।

দুজন চূড়ান্ত পেশাদার। শোনা যায় বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত আর্থিক লেনদেন নিয়েও দুজনের মধ্যেও মনোমালিন্য চরমে ওঠে। রোহিতের স্ত্রী রিতিকা সচদেব তখন কোহলির বিজ্ঞাপনের কাজকর্ম দেখতেন। কিন্তু 'হিট ম্যান'-এর সাথে প্রেম ও পরবর্তীকালে বিয়ের জন্য কোহলির সাথে পেশাদার সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি রিতিকা। রোহিতের প্রতি কোহলির উষ্মার এটাও বড় কারণ বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।

ওই সময় পর্যন্ত এই মনস্ত্বাত্তিক লড়াইয়ে কোহলি এগিয়ে থাকলেও ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পর থেকে রোহিতও তার সতীর্থের উদ্দেশে 'খেলা হবে' স্লোগান তুলতে শুরু করেন। সাদা বলের ক্রিকেটে ওপেন করে নিজেকে নতুন ভাবে তুলে ধরতে শুরু করেন রোহিত। সাথে তো মুম্বই ইন্ডিয়ান্সকে একাধিকবার আইপিএল জেতানো ছিলই। দেখতে দেখতে পাঁচটি আইপিএল জেতা হয়ে গেল রোহিতের। সেখানে অধিনায়ক কোহলির প্রাপ্তির ভাঁড়ার শূন্য। গত আট বছরে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর 'কোহলিপ্রেমী'দের মনে শুধু একরাশ হতাশা বাড়িয়েছে।

এর সাথে যোগ হয়েছে কোহলির মারাত্মক তিনটি ভুল সিদ্ধান্ত।
১) ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে পিচের চরিত্র বুঝতে না পেরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হার। সেদিন টসে জিতে প্রথমে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেন বিরাট। গরম থাকার জন্য আবহাওয়া ছিল শুকনো। পিচও ছিল খটখটে। কিন্তু তা সত্ত্বেও টসে জিতে প্রথমে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেন বিরাট। পাকিস্তান প্রথমে ব্যাটিং করার সুযোগ পেয়ে ৩৩৮ রান করে। শতরান করেন ফকর জামান। ১৮০ রানে ম্যাচ জিতে চ্যাম্পিয়ন হয় পাকিস্তান।

২) বিরাট দ্বিতীয় ভুল সিদ্ধান্ত নেন বিশ্বকাপের সেমি ফাইনালে। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচ জেতার জন্য ভারতের দরকার ছিল ২৪০ রান। কিন্তু ৫ রানের মধ্যেই আউট হয়ে যান কে এল রাহুল, রোহিত ও কোহলি নিজে। তবে ধোনিকে ক্রিজে না পাঠিয়ে সবাইকে অবাক করে প্রথমে ঋষভ পন্থ ও পরে দীনেশ কার্তিককে ব্যাটিং করতে পাঠান কোহলি। এরপর ধোনি ও জাদেজা লড়লেও শেষরক্ষা হয়নি।

৩) অধিনায়ক হিসেবে কোহলি তৃতীয় ভুল করেন আইসিসি বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে। ওই টেস্টের আগে প্রচুর বৃষ্টি হলেও দুই স্পিনার অশ্বিন ও জাদেজাকে নিয়ে মাঠে নামেন ভারত অধিনায়ক। সেখানে কেন উইলিয়মসন চার পেসার ও একজন পেসার-অলরাউন্ডার নিয়ে মাঠে নামেন। ভারতীয় দল ৮ উইকেটে ফাইনাল হেরে যায়। এবারও পিচের চরিত্র বুঝতে পারেননি কোহলি।

গত বিশ্বকাপের সময় দল বাছাই ও সেমি ফাইনাল থেকে ছিটকে যাওয়ার পর কোহলি ও রোহিতের ঝামেলা নিয়ে ফের পানিঘোলা হয়েছিল। যার জন্য রোহিতের সাথে দূরত্ব আরো বাড়তে থাকে। ড্রেসিংরুমে বিভাজন শুরু হয়। শোনা যায় একদল সিনিয়র ও জুনিয়র রোহিতের দিকে ঝুঁকে পড়েন। যদিও ওই সময় হেড কোচ রবি শাস্ত্রী ব্যাপারটা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেছিলেন, 'আমি এরকম কিছু দেখিনি। যখন লোকে আমাকে বিরাট-রোহিতের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছে, তখন আমি বলেছি আমি কিছুই দেখিনি, যেটা তারা দেখেছেন। সবসময় ওদের মেলবন্ধন ভালো ছিল। এর প্রভাব যদি দলের ওপর পড়ত, তাহলে আমি মুখের ওপর বলে দিতাম। কারণ আমি সেরকমই মানুষ।'

তবে শাস্ত্রী যাই বলুন দুজনের মধ্যে বনিবনা একেবারেই ছিল না। সেটা অস্ট্রেলিয়া সফরে সীমিত ওভারের সিরিজের আগে ফের সামনে চলে আসে। ডাউন আন্ডারে যাওয়ার আগে আইপিএল খেলার সময় হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পেয়েছিলেন রোহিত। সেই চোট নিয়ে তিনি প্লে-অফের ম্যাচও খেলে দেন। তবে দলের সহ অধিনায়ককে একদিন ও টি-টোয়েন্টি সিরিজের দলে রাখা হয়নি। আরো চোট সারানোর জন্য দেশে ফিরে সোজা এনসিএ চলে যান রোহিত। অধিনায়ক হিসেবে এই বিষয়ে কোহলি অন্ধকারে থাকবেন এটা ভেবে নেয়া অসম্ভব। তবুও অস্ট্রেলিয়া পা রেখে প্রথম সংবাদ সম্মেলনে রোহিতের প্রসঙ্গ উঠলেই কোহলি সটান বলেছিলেন, 'অস্ট্রেলিয়ার বিমানে রোহিতকে না দেখে আমি অবাক হয়েছি!' কোহলির মুখে এমন মন্তব্য শুনে বাকিরাও অবাক হয়ে যান। তবে এরপর এই ইস্যু নিয়ে আর পানিঘোলা হয়নি। কিন্তু এবার ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে বাইরে বসিয়ে রাখা নিয়ে বিভাজন আরো বাড়তে থাকে।

তবে কোহলির টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট থেকে দায়িত্ব ছাড়ার খবর সামনে আসতেই, দুই মহাতারকার 'ইগো ফাইট' আবার সামনে চলে এলো। ভারতীয় ক্রিকেটের সাথে যুক্ত থাকা পন্ডিতদের দাবি, এক জঙ্গলে কোহলি ও রোহিতের মতো 'দুই বাঘ' থাকলেও এই 'ইগো ফাইট' থামবে না। কারণ দুজনেই যে ক্ষমতার চূড়ায় থাকতে পছন্দ করেন।
সূত্র : জি নিউজ


আরো সংবাদ



premium cement

সকল