২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঘরোয়া ক্রিকেট না বদলালে বিসিবির নাম বদলের ‘প্রস্তাব’

সাকিব কাণ্ড জনমানসে আছড়ে পড়েছে প্রচণ্ড ক্ষোভের রূপ নিয়ে। - ফাইল ছবি

রোগ ধরেছিল অনেকদিন। এবার বিকারের লক্ষণ। বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট তো ক্ষমতাবানদের ‘খেলার পুতুল’ হয়ে আছে বহুকাল ধরে। সাকিব আল হাসানের কাণ্ডে সেটিই জনমানসে আছড়ে পড়েছে প্রচণ্ড ক্ষোভের রূপ নিয়ে। অবস্থা কী পাল্টাবে এবার?

পরিকল্পিত হোক কিংবা নিতান্তই ঘটনাচক্রে, আগুনটা ঠিকই জ্বালিয়েছেন সাকিব। আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথে প্রথমে স্টাম্পে লাথি মেরে। পরের ওভারে তা উপড়ে ফেলে। ক্রিকেট মাঠে অক্রিকেটীয় আচরণ যে এটিই সাকিবের প্রথম, তা নয়। তবে উটের কাছে কাঁটা গাছের স্বাদ যেমন, সাকিবের কাছে বিতর্ক ব্যাপারটাও তেমন। হজম করে ফেলেন অনায়াসে।

কিন্তু ক্রিকেটের হর্তাকর্তারা সাকিব-কাণ্ড হজম করতে পারছেন কই! জনসাধারণ যে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের ওই লাথিতে দেশের ক্রিকেট সিস্টেমের বিপক্ষে এক ‘প্রতিবাদী চরিত্র’ খুঁজে নিয়েছে! হয়তো তা আরোপিত। কিন্তু কর্তার ইচ্ছায় কর্মে যে পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং, প্রভাবশালীদের পছন্দের ক্লাবকে জেতানো-হারানো, বিসিবির ভোটের রাজনীতি- এসব কিছু তো অন্ধকার গুহা থেকে বেরিয়ে এসেছে লেজে আগুন লাগা সরিসৃপের মতো।

এলবিডাব্লিউর আবেদনে সাড়া না দেয়ায় সেদিন প্রথম মেজাজ হারান সাকিব। ক্রিকেট কোচ ও বিশ্লেষক জালাল আহমেদ চৌধুরী ব্যাপারটা দেখেন আরো বড় পরিসরে, ‘সাকিবের মাথা গরম হবার পেছনে ওই বলের সিচুয়েশন তো আছেই। সামগ্রিকভাবে নিজের উপরও হয়তো ও বিরক্ত ছিল। নিজে রান পাচ্ছিল না। এছাড়া আগে-পরে অনেক কিছু বলেছে। বলেছিল, আইপিএল তাকে বিশ্বকাপ প্রস্তুতিতে সাহায্য করবে, সেখানে প্রিমিয়ার লিগও সাহায্য করতে পারছে না। এরও প্রভাব আছে। এছাড়া পরিবার থেকে দূরে আছে অনেকদিন। সাকিবের সাম্রাজ্যও অনেক বড় হয়েছে। ব্যক্তিজীবন, ব্যবসায়িক জীবন সব কিছুর ব্যাপকতা আছে। বয়স, খ্যাতি, বাস্তবতা সব কিছু মিলিয়ে সঠিক মানসিক অবস্থায় সাকিব ছিল না। তবে সে যা করেছে, সেটি অপ্রত্যাশিত তো বটেই।’

আবার এ অপ্রত্যাশিত ঘটনার ভিন্ন একটা মাত্রাও দেখেন তিনি, ‘আমাদের ক্রিকেটের যে নগ্ন রূপ আছে, সেটি বহুলভাবে আলোচিত হলো। এটি একটি লাভ। এখানে আরেকটা জিনিস দেখার আছে। যারা ক্রিকেট অনুসরণ করেন, তারা সবাই জানেন এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। কিন্তু দেখা গেল, বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ এত কড়া, ক্লাবগুলো ক্ষমতাবানদের পকেটে ঢুকতে ঢুকতে এমন অবস্থা যে, পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি কিছু খুঁজে পেলো না। অথচ অনেক দলকে আমরা বিভিন্ন সময় ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখেছি; তবে লিখিতভাবে কিছু দিলো না। সেটি কালো হাতের কড়া নিয়ন্ত্রণের কারণে। এ মন থাকলে তো কিছু শোধরানো যাবে না।’

বিকেএসপির ক্রিকেট উপদেষ্টা নাজমুল আবেদীন ফাহিমের মতও প্রায় অভিন্ন। সাকিবের আচরণ তার কাছে যেমন গ্রহণযোগ্য না; তেমনি ক্লাবগুলোর আচরণেও তিনি বিস্মিত, ‘আমি শুনে খুব অবাক হলাম যে, আম্পায়ারিং নিয়ে নাকি ২০১৭ সালের পরে কেউ অভিযোগ করেনি। আমি জানি না, এটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য। এই যে এবার ১২টি ক্লাবের সাথে কথাবার্তা হয়েছে। কারো কাছ থেকে আম্পায়ারিং নিয়ে নেতিবাচক কিছু নাকি শোনা যায়নি। আমার ধারণা, এই ১২টি ক্লাবের মধ্যে কয়েকটি ক্লাব এসবের সুবিধাভোগী। অন্যরা এর বিপক্ষে বলার মতো সাহস জুগিয়ে উঠতে পারেনি। কারণ, ক্রিকেটই তাদের জীবিকা, রুটিরুজির একমাত্র পথ। বোর্ডকে নাখোশ করে কেউ কিছু বলতে চায়নি।’

মাঠের ক্রিকেট খেলার আড়ালে ‘অন্য খেলা’ও দেখছেন নাজমুল আবেদীন ফাহিম, যার সুদূরপ্রসারী ফল ভালো হবে না বলেই তার আশঙ্কা, ‘এখানে কাউন্সিলরশিপের ব্যাপার আছে। কোন দল কোথায় গেলে কার কাউন্সিলরশিপ পাওয়া সহজ হবে, এসব হিসাব-নিকাশ আছে। সব কিছু মিলিয়েই জিনিসটাকে দেখা দরকার। আমরা যদি ধরে নিই, কেউ অভিযোগ করেনি বলে কিছু হয়নি বা হচ্ছে না, তাহলে বলবো যে, সিরিয়াসলি ক্রিকেটের ক্ষতি করছি। খুব শিগগিরই এর ফল ভোগ করতে হবে।’

সামগ্রিক অবস্থাতে হতাশাই বেশি ঝরে পড়ে এই ক্রিকেট কোচের কণ্ঠে, ‘এখন সবার মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা। ভালো খেললে ভালো জায়গায় যাবেন, এমন পরিবেশ আর নেই। ভালো খেলেন বা না খেলেন, কারো না কারো আশীর্বাদ থাকতে হবে। সেটি খেলোয়াড় হন অথবা কোচ, অথবা ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট অন্য যে-ই হোন। এটি তো ক্রিকেটের জন্য ভালো না। বরং তা ক্রিকেটকে আরো নষ্ট করবে।’

সে পচন এরই মধ্যে শুরু হয়েছে বলে উপলব্ধি বিসিবির সাবেক পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন আল মামুনের, ‘আমাদের ক্রিকেট তো একটা গাছ। আম্পায়ারিংসহ যে জিনিসগুলো নিয়ে কথা হচ্ছে, এগুলো গাছের শেকড়। শেকড়ে পচন ধরলে পুরো গাছেই প্রভাব পড়বে। নতুন খেলোয়াড়, নতুন দল তৈরি হবার জায়গাটা সংকুচিত হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, এটি সাকিবের ঘটনা থেকে হঠাৎ শুরু হয়নি। অনেক দিনের বাজে চর্চার ফল। বোর্ডের আধিপত্য এমন পর্যায়ে গেছে, তাদের হস্তক্ষেপ ছাড়া দ্বিতীয় বিভাগের দল প্রথম বিভাগে উঠতে পারবে না, কিংবা তৃতীয় বিভাগের দল দ্বিতীয় বিভাগে উঠতে পারবে না। তাহলে ক্রিকেট এগুবে কিভাবে, বলুন?’

বাংলাদেশ ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থায় মন খারাপ হয় এই সংগঠকের। সেজন্য কর্তাব্যক্তিদেরই দায়ী করেন রিয়াজ উদ্দিন আল মামুন, ‘আমি নিজের প্রতিষ্ঠানে সবসময় একটা নীতি মেনে চলি। সেটি হলো, লিডার অন্যদের অনুপ্রাণিত করবে। বেঞ্চমার্ক তৈরি করবে। ধরুন, ক্রিকেটে যদি আমার টিম থাকে, তাহলে তার উপরই নিয়ম-কানুন সবচেয়ে কড়াভাবে প্রয়োগ হবে। দুঃখের ব্যাপার হলো, এখন ক্রিকেটে অনেকে এসেছেন সোশ্যাল আইডেন্টিটি তৈরি করার জন্য। তারা সত্যিকারের সংগঠক কিনা, সন্দেহ আছে। যারা সত্যিকারের সংগঠক, তারা সত্যিকারের খেলাই মাঠে চান।’

সেই সত্যিকারের সংগঠকের অভাবে বাংলাদেশের ক্রিকেট পথ খুঁজে পাচ্ছে না। রিয়াজ উদ্দিন আল মামুনও তাই আশা দেখছেন না, ‘যুক্তি দিয়ে আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ দেখি না আমি। ক্রিকেটের অবস্থা এতটাই খারাপ। অনেক বছরের সাধনার ফলে আমাদের ক্রিকেট এখনকার পর্যায়ে এসেছে। এখনকার বাজে চর্চা চলতে থাকলে এটি ক্রমশ আরো খারাপের দিকে যাবে।’

জালাল আহমেদ চৌধুরী আবার বিসিবি নির্বাচন ঘিরে পরিবর্তনের আশা দেখেন তীর্যকচোখে। কারণ তাতে ক্রিকেট সংস্কৃতি পরিবর্তনের ভরসা পান না, ‘সামনে নির্বাচনে এখনকার ক্ষমতাসীনরাই জিতবে। এরপর চার বছরের জন্য নিশ্চিন্ত। তখন হয়তো ভাববে, একটু ভালো কাজ করি। আম্পায়ারিং নিয়ে হয়তো কিছু কিছু কাজ করতে পারে। কিন্তু এই সংস্কৃতি চালু থাকলে আবার নির্বাচন ঘনালে আবার দুর্নীতি করবে।’

এখনকার বিসিবির যে কাজের ধারা দেখেন, তাতে তার দীর্ঘশ্বাস বেরোয় অন্য রকম এক প্রস্তাবনায়- ‘বোর্ডের আগের নামে ফিরে গেলে ভালো হয়- বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড। কন্ট্রোল শব্দটি তো ভুল মনে করে বাদ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন বোর্ডের সব জায়গায় যেমন নিয়ন্ত্রণ, তাতে আবার কন্ট্রোল শব্দটা যুক্ত করাই যায়।’

বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট পুতুল নাচের মতো যেমন অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণের সুতোয় ঝোলে, তাতে নাম পরিবর্তনের প্রস্তাবটা ভেবে দেখা যেতেই পারে!

সূত্র : ডয়চে ভেলে


আরো সংবাদ



premium cement