শুকিয়ে ক্যানেলে রূপ নিয়েছে গড়াই নদী
সঙ্কটে কৃষি ও জীববৈচিত্র্য- বাসস
- ২২ মে ২০২৪, ০০:০৫
স্বাভাবিক নাব্যতায় বছরে দেশী প্রজাতির প্রায় ১০০ মে. টন মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্র কুষ্টিয়ার পদ্মার উৎস গড়াই নদী প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবে শুকিয়ে এখন ক্যানেলে রূপ নিয়েছে। জিকে সেচ পাম্প অচল হয়ে পড়ায় নদী তীরবর্তী কৃষি, জীববৈচিত্র্য এখন হুমকিতে পড়েছে। মনুষ্যসৃষ্ট কৃত্রিম বাঁধ, কারেন্ট জালে মাছ শিকারে দেশী প্রজাতির নানা মাছের পোনা বিলুপ্তির পথে। দেশী প্রজাতির মাছ উৎপাদন, জিকে পাম্পকে সচল, সুন্দরবনকে লবণাক্ততা মুক্তকরণ এবং প্রাণী, গাছ-পালা রক্ষা, ভূগর্ভের পানির স্তর ধরে রাখতে গড়াই নদীতে সারা বছর নাব্যতা রাখতে সরকার ড্রেজিংসহ নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
জানা যায়, পদ্মার উৎস্য গড়াই নামে ৮৯ কিমি. মধুমতী নামে ১৩৭ কিমি. এবং বলেশ্বর নামে ১৪৬ কিমি.সহ এ নদীর মোট দৈর্ঘ্য ৩৭২ কিমি.। এ ছাড়া দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০টি জেলায় শুষ্ক মৌসুমে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য, কৃষি, মৎস্য, জলপথ রক্ষা এবং সর্বোপরি খুলনা বিভাগের উপকূলীয় লবণাক্ততার আগ্রাসন থেকে একমাত্র সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার প্রধান মিঠা পানির উৎস হলো গড়াই নদীর পানিপ্রবাহ। বিষয়টি সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বিবেচনায় গড়াই নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্প হাতে নিয়ে বর্তমানেও চলমান রয়েছে। চলতি বছরে গড়াইয়ের নাব্যতা সচল রাখতে ২৬ কোটি টাকার প্রাক্কলন ব্যয়ে গড়াই পুনরুদ্ধার প্রকল্পের খনন কাজ চলমান।
জানা যায়, ১৯৯৮ সালে প্রথম ধাপে গড়াই নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্প (এজজচ) (ঢ়যধংব-ও) এ ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প দিয়ে শুরু হয়েছিল এ প্রকল্পের প্রথম ধাপের খননকাজ। বিশ^ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে নেদারল্যান্ডের একটি কোম্পানি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার তালবাড়িয়াস্থ গড়াই নদীর উৎসস্থল থেকে কুমারখালী হয়ে খোকসা উপজেলার জানিপুর পর্যন্ত প্রায় ৩০কিমি. নদী খনন করে একটা পাইলট প্রকল্প সম্পন্ন করে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট পানিপ্রবাহের নাব্যতাকে টেকসই করতে স্থায়ীভাবে মেইনটেন্যান্স প্রকল্প চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এর পরেই গড়াই নদীর সুফল পেতে শুরু করে এ এলাকা। কুষ্টিয়া সরকারি বিশ^বিদ্যালয় কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহাতাব উদ্দিন বলেন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার জনগোষ্ঠীর কাক্সিক্ষত বিশুদ্ধ পানিপ্রবাহ, কৃষি, মৎস্য, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও জলপথ রক্ষা এবং সর্বোপরি বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় অঞ্চলের তীব্র লবণাক্ততার আগ্রাসন রুখতে গড়াই ব্যতীত কোনো কিছুই আর ফলপ্রসূ হচ্ছে না। গড়াই আংশিক শুকিয়ে যাওয়ায় এই অঞ্চলজুড়ে প্রতি বছরই শুষ্ক মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে তীব্র সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। বিশুদ্ধ পানিসঙ্কটে গোটা অঞ্চলের জনজীবন এখন হাহাকারের পূর্বাভাসে শঙ্কিত। গড়াই নদীর উৎসমুখ সংলগ্ন সদর উপজেলার ১নং হাটশ হরিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম মুশতাক হোসেন মাসুদ বলেন, গড়াই নদীকে স্থায়ী খননের মাধ্যমে এর পূর্বের পানিপ্রবাহ নিয়ে আসলে শুধু কুষ্টিয়া না পুরো দক্ষিণাঞ্চলের ১০ জেলার মানুষ, কৃষি, সুন্দরবন উপকৃত হবে। সরজমিনে গড়াই নদীর কমলাপুর, বারখাদা বাঁধ সংলগ্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, চিকন সরু গড়াই নদীতে স্বচ্ছ পানি প্রবাহমান। তবে পাড় ঘেঁষে প্রায় কয়েক কিমি. এলাকাজুড়ে ছোট বাঁধ, মশারি, চায়না জাল, বাঁশের কুঞ্চির সাথে বেঁধে অর্ধডুবানো রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এগুলো এই এলাকার মৌসুমি মাছশিকারিদের। রাতে এসব বাঁধ, জাল দিয়ে প্রতিদিন চিংড়ি, বেলে, টাকি, রিঠা, কাজলসহ প্রায় ১০ প্রজাতির দেশী মাছের পোনা ধরে এবং তা খুব সকালে নদীর পাড়ে বসেই কেজি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে থাকে। সেগুলো আবার বাজারে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। এমন একজন মৌসুমি মাছশিকারি আব্দুস সামাদ জানান, তার প্রায় ১০টি জাল ও চারু রয়েছে। যার মাধ্যমে সে প্রতিদিন গড়াই নদী থেকে তিন থেকে চার কেজি বেলে, চিংড়ি, পুঁটি, রিঠা মাছ ধরে থাকে। এতে দুই-এক দিন পরপর তার ১ হাজার থেকে ১২ শ’ টাকা আয় হয়। আগে সে মাছই ধরত নদীতে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় এখন সে এ পেশা বেছে নিয়েছে। তার মতো হাটশ হরিপুর শালদহের মহানগর ট্যাক এলাকার বাসিন্দা মতিয়ার রহমান জানালেন, তিনিও প্রতি রাতে জাল দিয়ে চিংড়ি, রিঠা, বেলে, বাইম মাছ ধরে থাকেন। প্রতি রাতেই তিন থেকে চার কেজি ছোট মাছ তিনি ধরে থাকেন। ভোরে এ সব মাছ নদীর পাড়েই বিক্রি করেন। দিনে তিনি দোকানদারি করেন আর রাতে এখন জাল দিয়ে মাছ ধরেন। কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান জানান, চুক্তি অনুযায়ী আমরা পানি পাচ্ছি। তবে গড়াই নদীর মূল উৎস পদ্মাতেই পানি নেই। ফলে উজান থেকে নেমে আসা পানির লাইনে পলি-মাটি ভরাট হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে গড়াই শুকিয়ে পানি প্রবাহের স্বাভাবিকতা হারাচ্ছে। গড়াই শুকিয়ে যাওয়ায় কুষ্টিয়া এলাকায় পানির স্তর নেমে গেছে। তিনি জানান, গড়াই নদীকে আরো বৃহৎ আকারে খনন প্রকল্পের মাধ্যমে পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখা সম্ভব। তা হলেই এর পূর্ণাঙ্গ সুফল পাওয়া যাবে। তবে তিনি নদীতে জাল দিয়ে, বেড়িবাঁধ দিয়ে মাছ ধরার বিষয়টি জানেন না। এটা মৎস্য বিভাগের দায়িত্ব বলে তিনি জানান। দিনের পর দিন শুকনো মৌসুমে বাঁধ দিয়ে, জাল দিয়ে মাছ ধরায় দেশী প্রজাতির মাছ গড়াই নদী থেকে বিলুপ্ত হচ্ছে। এ ব্যাপারে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো: শরিফ হাসান সোহাগ জানান, কুষ্টিয়ার গড়াই নদী থেকে প্রতি বছর স্বাভাবিক সময়ে দেশী প্রজাতির অনুমান ৮১ মে. টন মাছ উৎপাদন হয়ে থাকে। যার বাজারমূল্য প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। এখন নদী শুকিয়ে যাওয়ায় এর পরিমাণ অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। এখন সব মিলিয়ে ২০ মে. টনের কম অর্থাৎ এক কোটি টাকার মতো হবে বলে তিনি জানান।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা