১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

অনিয়ম আর দুর্নীতির বোঝা মাথায় নিয়েই বিদায় নিলেন চবির ভিসি

-

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ইতিহাসে একমাত্র নারী ভিসি অধ্যাপক শিরীণ আখতার। গত ১৯ মার্চ তার দীর্ঘ চার বছরের শাসনের ইতি ঘটেছে নতুন ভিসি অধ্যাপক ড. মো: আবু তাহেরের নিয়োগের মধ্য দিয়ে।
দায়িত্ব পালনকালীন চার বছরের বেশির ভাগ সময়েই বিতর্কিত ছিলেন নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে। এর মধ্যে অধিকাংশ অবৈধ দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োগ। সেই নিয়োগ যাত্রা সমাপ্ত করলেন দায়িত্বের শেষ দিনে (১৯ মার্চ) ৩০ জনেরও বেশি নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে। এর মধ্যে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে- উচ্চমান সহকারী, নিম্নমান সহকারী, ঊর্ধ্বতন সহকারী, নিরাপত্তা প্রহরী, অফিস পিয়ন, বুক বাইন্ডার, কম্পিউটার ল্যাব সহকারী, ভোজনালয় সহকারী, পেশ ইমাম, ঝাড়ুদার এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে ছয় মাসের জন্য এসব নিয়োগ দিয়ে যান তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্রে জানা যায়, ভিসি তার চার বছরে প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। শেষ তিন মাসে এমন নিয়োগের সংখ্যা ১১৭। আর তার শেষ দিনে দিয়েছেন ৪০ জন নিয়োগ। নিয়োগ পাওয়া অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের আত্মীয়স্বজন এবং শাখা ছাত্রলীগের সাবেক-বর্তমান নেতাকর্মী।
দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ২০২০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সংস্থাটি দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে তাদের অনুমতি ছাড়া অ্যাডহক, দৈনিকভিত্তিক জনবল ও মাস্টাররোলে নিয়োগ না দেয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছিল। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটেও দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োগের ব্যাপারে একটি প্রস্তাবনা পা হয়েছিল। কিন্তু এগুলোর কোনোটিই মানেননি সদ্য সাবেক এই ভিসি।
রেজিস্ট্রার দফতর সূত্রে জানা যায়, অবৈধ এসব দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগ হয় রেজিস্ট্রারের স্বাক্ষরে ভিসির অনুমোদনে। শূন্য ও সৃষ্ট এসব পদের বেতন-ভাতা দেয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব তহবিল থেকে। এরপর শূন্য পদের বিপরীতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলে নিয়োগপ্রাপ্তরা স্থায়ী হন। কিন্তু সৃষ্ট পদের জন্য প্রয়োজন হয় ইউজিসির বাজেট অনুমোদন।
২০২২ সালের ৩ মার্চ ফার্সি বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত তিনটি অডিও ফাঁস হয়। এতে জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে ভিসির ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) খালেদ মিসবাহুল মোকর রবীনের। কিন্তু শাস্তির বদলে তাকে ‘উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক’ হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়েছিল। ওই ফাঁস হওয়া অডিওতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর পদে ১২ লাখ, চতুর্থ শ্রেণী পদে আট লাখ, অফিসার পদে ১৫ লাখ ও শিক্ষক নিয়োগে ১৬ লাখ টাকার ওপরে লেন-দেন হয়েছে বলে অডিও ক্লিপগুলোতে উঠে আসে, যা আলোচিত হয় সারা দেশে।
এ ছাড়া ২০২২ সালের ৬ আগস্ট আরো দুটি ফোনালাপ ফাঁস হয়, এতে দেখা যায় নিম্নমান সহকারী পদের কর্মচারী মানিক চন্দ্র দাস নিজেকে সেকশন অফিসার পরিচয় দিয়ে তিন চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা আদায় করেছেন।
শেষ সময়ে নিয়োগের ব্যাপারে ৩য় শ্রেণীর কর্মচারী সেলের প্রধান সৈয়দ মনোয়ার আলী বলেন, সাবেক ভিসির বিদায়ের সময় মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) প্রায় ৪০ জনের কাছাকাছি নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য প্রফেসর ড. নঈম উদ্দিন হাছান আওরঙ্গজেব বলেন, ভিসি বারবার বলতো আমাদের অসংখ্য লোকের প্রয়োজন। কিন্তু ইউজিসি লোকবল দিচ্ছে না, তাই আমি লোক পাঠাচ্ছি। তখন আমরা ৫৪৫তম সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম একটি নির্দিষ্ট নিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ দিতে। একটি কমিটি করা হয়েছিলো যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অনুষদে দেখবেন আসলেই কতো লোক প্রয়োজন। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রয়োজনীতা অনুসারে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে নিয়োগ দিতে হবে। কিন্তু তিনি সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত না মেনে অপ্রয়োজনীয় নিয়োগ দিয়েছেন।
সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেন, তিনি (ভিসি) বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম লঙ্গন করে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত না মেনে নিজের মনগড়া নিয়োগ দিয়ে গেছেন।
অবৈধ শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে চবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী নয়া দিগন্তকে বলেন, তিনি শুরু থেকেই এ রকম অনিয়ম দুর্নীতি করেই আসছিলেন। তবে এটি খুবই দুঃখজনক যে শেষ সময়ে এসেও তিনি অনিয়ম আর দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগের ধারা বজায় রেখেছেন।
তিনি আরো বলেন, তিনি উপাচার্যের পদকে ব্যবহার করে এবং অনেকটা খাটো করে এই নিয়োগগুলো দিয়েছেন।
এ দিকে চবি সাংবাদিক সমিতির সাথে এক আলোচনা সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত ভিসি অধ্যাপক ড. মো: আবু তাহের নিয়োগ নিয়ে বলেন, যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। অযোগ্য ব্যক্তিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলে সে ৪০ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষতি করবে। নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই। যেকোনো মূল্যে ভালো শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। কর্মকর্তা কর্মচারী থেকে শুরু করে যারাই দক্ষ ও যোগ্য তাদেরকেই নিয়োগ দেয়া হবে।


আরো সংবাদ



premium cement