১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ধর্মহীন করতে পাঠ্যপুস্তক থেকে ইসলাম বাদ

জাতীয় সেমিনারে বক্তারা
রাজধানীতে শিক্ষা গবেষণা সংসদ ঢাকা আয়োজিত জাতীয় সেমিনারে আলোচকরা : নয়া দিগন্ত -


শিক্ষা ও গবেষণা সংসদ ঢাকার উদ্যোগে আয়োজিত ‘জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্যবিরোধী পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও শিক্ষায় মৌলিক সংস্কার’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে বক্তারা বলেন, জাতিকে ধর্মহীন নাস্তিক করার জন্য মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসকে পাঠ্যপুস্তক থেকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বাদ দেয়া হয়েছে। আমার ধর্মীয় বিশ্বাসের শিক্ষা আমার অধিকার; এটা থেকে সরকার বঞ্চিত করতে পারে না। সরকার সাম্প্রদায়িক, পৌত্তলিক ও নাস্তিক্যবাদী অবৈজ্ঞানিক শিক্ষাব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে আমাদের মুসলমানদের ঈমান ও আকিদায় হাত দিয়েছে। ডারউইনের বিবর্তনবাদ শিক্ষা দিয়ে আমাদের কোমলপ্রাণ সন্তানদের ব্রেনওয়াশ করে ধর্মহীন করার অপচেষ্টা করেছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সরকার ধ্বংস করে দিয়েছে।
গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আব্দুর রবের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর চৌধুরী মাহমুদ হাসান। প্রধান আলোচক ছিলেন, সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ড. আ ন ম এহছানুল হক মিলন। সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, অধ্যক্ষ সৈয়দ আব্দুল আজীজ। শিক্ষা ও গবেষণা সংসদ ঢাকার পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ নুরন্নবীর পরিচালনায় সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল লতিফ মাসুম, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থটের (বিআইআইটি) পরিচালক ড. এম আব্দুল আজিজ, তা’মীরুল মিল্লাত মাদরাসার ভাইস প্রিন্সিপাল ড. খলিলুর রহমান মাদানী, ইঞ্জিনিয়ার শেখ আল আমিন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজের সাধারণ সম্পাদক মো: শহিদুল ইসলাম। সেমিনারে দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, কলামিস্ট-সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অংশ নেন।


প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রফেসর চৌধুরী মাহমুদ হাসান বলেন, জাতিকে ধর্মহীন করার জন্যই পাঠ্যপুস্তক থেকে মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাস ও ইসলামী চেতনা সংশ্লিষ্ট লেখা বাদ দেয়া হয়েছে। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের সাথে যারা জড়িত তারা পরিকল্পিতভাবে এটা করেছে। যারা শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে তারা তাদের আদর্শের আলোকে করেছে। আত্মপরিচয়ের নামে অবাধ যৌন বিকৃতিকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হয়েছে বইগুলোতে। ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ হলো মানসিক অসুস্থতা ও যৌন বিকৃতি। অথচ বইতে এটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি বলেন, হয়তো প্রধানমন্ত্রীও এটি ভালোভাবে জানেন না। কারণ আমরা মনে করি তিনিও ইসলামী চেতনায় বিশ্বাস করেন। পাঠ্যপুস্তক থেকে ইসলামী বিষয়গুলো সরিয়ে দেয়ায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে। যার প্রভাব তাদের নির্বাচনেও পড়তে পারে। সরকার আসবে সরকার যাবে; কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা ঠিক রাখতে হবে। তিনি বলেন, ইসলাম বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে কিছু বলেনি। ইসলাম মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। ইসলাম উদারতা, মানবতা ও উন্নত চরিত্র গঠনের শিক্ষা দেয়। এমন শিক্ষাব্যবস্থা হওয়া উচিত নয়, যাতে মানুষ ইসলাম ধর্ম থেকে দূরে সরে যায়। পরবর্তী প্রজন্মকে দুর্নীতিমুক্ত, ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে ইসলামী নৈতিকতা শিক্ষাব্যবস্থায় থাকতে হবে। তিনি শিক্ষানীতি প্রণয়নের কমিটিতে ধর্মীয় ব্যক্তিদের রাখার দাবি জানিয়ে বলেন, নতুন প্রণীত পাঠ্যপুস্তক অবশ্যই সংশোধন করতে হবে।


প্রধান আলোচকের বক্তব্যে সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ড. আ ন ম এহছানুল হক মিলন বলেন, জাতিকে ধ্বংস করতেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তকে ব্রিটিশ হয়ে ভারতীয় আধিপত্যবাদ স্থান পেয়েছে। এই পাঠ্যপুস্তক সংশোধন নয়; বরং তা বাতিল করতে হবে। ইসলামসহ সব ধর্মেই নৈতিক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। অথচ সরকার ইসলাম ধর্মের বিরোধী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করেছে। মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাস পাঠ্যপুস্তক থেকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বাদ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমি সব পাঠ্যপুস্তককে ইসলামাইজেশন করতে বলি না, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের বিষয় পাঠ্যপুস্তকে থাকলে সমস্যা কোথায়? বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন গত ১০ বছর ধরে পাঠ্যপুস্তকে ভুল হচ্ছে। সরকার আজকে দলীয় ও সাম্প্রদায়িক বিষয় শিক্ষা দেয়ার জন্য পাঠ্যবই প্রণয়ন করেছে। ক্লাস সেভেনের বিজ্ঞান বইয়ে নৌকাবিষয়ক প্রবন্ধ আছে। সরকারপ্রধানের ছবি কি পাঠ্যবইয়ে থাকতে পারে? না এটা পারে না; কিন্তু বর্তমান সরকার নারীর ক্ষমতায়নের চিত্র দেখাতে গিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, শিক্ষামন্ত্রীর ছবি ব্যবহার করেছে। এভাবে সরকারের ব্যক্তিদের ছবি পাঠ্যবইতে দেয়ার কোনো নজির নেই। আওয়ামী লীগ সরকার উদ্দেশ্যমূলকভাবে শিক্ষাব্যবস্থাকে দলীয়করণ করেছে। পাঠ্যবইয়ে এমন ব্যক্তিদেরকে অন্তর্ভুক্ত করতে হয়, যিনি সমালোচনার ঊর্ধ্বে। সরকার অটো পাস দিয়ে মেধাহীন মানুষ তৈরি করে দেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
সভাপতির বক্তব্যে প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আব্দুর রব বলেন, নীতিনৈতিকতাবিহীন শিক্ষাব্যবস্থা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কালচারাল আগ্রাসনের পাশাপাশি এখন শিক্ষাব্যবস্থায়ও আগ্রাসন চালানো হচ্ছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে উন্নত জাতি গঠন সম্ভব নয়। শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যবই প্রণয়ন কমিটিতে ইসলামিক স্কলারদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে পাঠ্যবইয়ে বলা হচ্ছে বানর থেকে মানুষ হয়েছে। অথচ প্রত্যেক মানুষ আদম ও হাওয়ার সন্তান। সাহিত্য-গল্প-কবিতায় ইসলামের চেতনা মূল্যবোধের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মেজরিটি মানুষ এ দেশে মুসলমান তাই মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী শিক্ষাব্যবস্থা পাঠ্যপুস্তকে চালু করতে হবে।


অধ্যাপক আব্দুল লতিফ মাসুম বলেন, দেশের সরকার পরিবর্তনের সাথে শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন করা হয়, এটা দুঃখজনক। যারা পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন তারা দায়সারাভাবে করেছেন। অথবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রতিবেশী ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করেছে। শিক্ষার উন্নয়ন করতে এ শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন নয়; বাতিল করতে হবে।
ড. এম আব্দুল আজিজ বলেন, শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করতে হবে। যারা বর্তমান পাঠ্যবই প্রণয়ন করেছে তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী করেছে। আমরা আমাদের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করার দাবি জানাচ্ছি। তিনি আরো বলেন, সরকার প্রথমে ধর্মশিক্ষা বাদ দিতে চেয়েছিল; কিন্তু আমরা যুক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করায় তা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে। শিক্ষানীতিতে কোনো সমস্যা নেই; কিন্তু পাঠ্যপুস্তক রচনা করার সময় ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী শিক্ষা বাদ দেয়া হয়েছে। পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সংস্কার করতে হবে। ইসলাম ধর্মের বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ইসলাম ধর্মশিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
মূল প্রবন্ধে অধ্যক্ষ সৈয়দ আব্দুল আজীজ বলেন, ইতিহাস বিষয়ের পাঠ্যবইটি পড়লে মনে হবে, এ দেশের ইতিহাসের সাথে ইসলাম ও মুসলমানের কোনো সংযোগই ছিল না; বরং বইটিতে সুলতানি আমলকে কলঙ্কিত করে দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে, সুলতানি আমলে বর্ণপ্রথার জন্ম হয়। পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণীর বইগুলোর বিভিন্ন অধ্যয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের কথা আনা হয়েছে; কিন্তু এসব আলোচনাতে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ইসলামী আন্দোলনগুলোকে। শহীদ তিতুমীর এবং ফরায়েজী আন্দোলনের কথা একেবারেই অনুপস্থিত। কোথাও উল্লেখ নেই ১৮৫৭ সালের বিপ্লবে আলেমদের ভূমিকা এবং আত্মত্যাগের। তিনি বলেন, শিক্ষার মূল লক্ষ্য হতে হবে সৎ, নৈতিক চরিত্রবান, দেশপ্রেমিক এবং একবিংশ শতকের দক্ষ নাগরিক তৈরি করা। মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য পাঠ্যপুস্তক সংশোধন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশপ্রেমিক নাগরিক প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ ও চিন্তাশীল অভিভাবকদের সমন্বয়ে জাতীয় শিক্ষা সংস্কার কমিটি গঠন করতে হবে।

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement