২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মিটফোর্ড হাসপাতালে সেবার মান তলানিতে

-

রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে পদে পদে রোগী হয়রানি ছাড়াও নানা অনিয়ম চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া টাকা আত্মসাৎ, আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন গায়েব এবং ওষুধ চুরি এখন নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। আবার দুর্নীতিবাজরা পারও পেয়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে ১ কোটি টাকায় ওয়ারসি সার্জারিক্যাল থেকে লজিক পি ৫ ইউএসএ নামে দুটি আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন ক্রয় করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এ ছাড়া ২০১৫ সালে চীন সরকারের উপহার বাবদ জি ই হেলথ কেয়ার, উহান, চায়না নামক আরেকটি মেশিন হাপাতালের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগে স্থাপন করে সেবা প্রদান শুরু হয়। এর পর ২০১৭ সালে দুটি মেশিন নষ্ট হয়ে যায় জানিয়ে ওই সব মেশিন পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হাসপাতাল পরিচালক বরাবর আবেদন করা হয়। যদিও নিয়ম ও চুক্তি অনুযায়ী মেশিনগুলোর লাইফ টাইম ১০ বছর ধরা হয়। সে অনুযায়ী মেশিনলোগুলো যথাক্রমে ২০২৩, ২০২৪ ও ২০২৫ সালে পরিত্যক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু ২০১৮ সালে ওইসব মেশিন সুকৌশলে পরিত্যক্ত মালামালের গুদামে রেখে দেয়া হয় এবং ২০২১ সালে মেশিনগুলো লক্ষাধিক টাকায় বিক্রি করে দিয়ে তদস্থলে ভাঙ্গাড়ি দোকান থেকে অন্য মেশিনের খোলস গুদামে রেখে দেয়া হয়।

বিষয়টি নিয়ে গত বছরের ২০ নভেম্বর নয়া দিগন্তে ‘৩ আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন মেধাও’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতি বেদন প্রকাশ হয়। পরে গত বছর ১ ডিসেম্বর আরো একটি রিপোর্ট হয়। এরপর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও দুর্নীতি দমন কমিশন পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি চলতি বছরের ৭ এপ্রিল ঘটনার সত্যতা নিশ্চত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ সংবলিত নির্দেশনা জারি করে চিঠি দেয়। আর এসব তদন্তে ছিলেন উপসচিব উম্মে হাবিবা। এ দিকে, মূল অপরাধীকে বাদ দিয়ে মামলায় চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারী নেতাকে আসামি করা হয়। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি একজন সাসপেন্ড কর্মচারী। তা ছাড়া তিনি কোনো দায়িত্বে নেই। তার পরেও কেন দুদক তাকে ফাঁসিয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তো আমাকে দোষারোপ করলো না। অথচ দুদকের মামলায় ২ নম্বর আসামি। যেখানে রহিম ভুঁইয়া নাটের গুরু, সেখানে তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে বলে জানান তিনি।


অন্য দিকে, ডায়ালাইসিস বিভাগের ইনচার্জ সিনিয়র নার্স মাধবী সুতার পরিচালক বরাবর অভিযোগ করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ১৭ এপ্রিল বিকেল সাড়ে ৩টায় ডায়ালাইসিস স্টোর রুমে তালা দিয়ে বাসায় যান তিনি। পরের দিন ১৮ এপ্রিল সকালে এসে স্টোর খুলে দেখেন হেমোডায়ালাইজার ২০টি কার্টন ফাঁকা ও ছেঁড়া। পরে গণনা করে দেখেন ২৪০ পিচ হেমোডায়ালাইজার খোয়া গেছে। এ ব্যাপারে নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান ডাক্তার ওয়াহিদকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। পরে চোর নিজেই ওইসব মালামাল ফেরত দেয়। এর আগে, হাসপাতালের বহির্বিভাগ টিকিট কাউন্টার থেকে দুই বান্ডল জাল টিকিট উদ্ধার করেছেন হাসপাতালের পরিচালক। এ সময় ২০০ জাল টিকিট জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় তিনজনকে অভিযুক্ত করা হয়। এরা হলো আজিজ, মেহেদী ও মফিজ। কেউ কেউ বলছে, টিকিট সিন্ডিকেটের মূল হোতা তারাই। উপরস্থদের টাকা দিয়ে নিয়মিত তারা এখানে ডিউটি নিচ্ছে। আর জাল টিকিট বাণিজ্য করে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা কামিয়ে নিচ্ছে। সবশেষ, মিটফোর্ড হাসপাতালের ক্যাশিয়ার আব্দুস সাত্তারের বিরুদ্ধে আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। গত ৫ দিন যাবৎ তার রুমে বন্দী করে হিসাব নিচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে তিনি অসুস্থতার কারণে সিসিইউতে ভর্তি রয়েছেন।


এ দিকে, হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আউটসোর্সিং কর্মচারীদের কাছ থেকে মাসে ১৬০০ টাকা কেটে নেয়ার অভিযোগ চাকরির শুরু থেকেই। তবে স্টাফরা চাকরি হারানোর ভয়ে টুঁ শব্দও করতে পারে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মচারী এ প্রতিবেদককে বলেন, তারা অনেকেই বেকার অকর্মা শব্দটি শুনতে কষ্ট পায়। তাই প্রতিবাদ করতে চায় না। কারণ প্রতিবাদ করলে জাকির স্যার তাদেরকে রাখবে না চাকরিতে। তা ছাড়া মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে এ চাকরি দেয়া হয়েছে। আবার অনেককে টাকা পয়সা নিয়েও তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানান তারা। অন্য দিকে, ১৪ নভেম্বর দুপুরে একজন রোগীকে মেরে রক্তাক্ত করার পর ঘটনাস্থলে এসে সহকারী পরিচালক মফিজুর রহমান মোল্লা বলেন, ‘সব রোগীকে লাথি মেরে বের কর। আর কাউন্টার বন্ধ কর’। ওই সময়ে রোগীরা জানান, পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কাউন্টারে টাকা জমা দিতে কয়েক শ’ রোগী ও তাদের স্বজনদের দীর্ঘ লাইন থাকার পরেও ভিতরে স্টাফ ঢুকে আর টাকা জমা দিয়ে তাদের নিজস্ব লোকের কাজ করিয়ে নেন। এ দিকে, সরকারি নিয়মকানুন ও বিধান উপেক্ষা করে দুইজনকে ভারপ্রাপ্ত ওয়ার্ড মাস্টার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে যুগ পার করছে কর্তৃপক্ষ। তার মধ্যে একজনের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুনীতির অভিযোগ রয়েছে। দুদকের খাতায় তিনি ৩ নম্বর আসামি। আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্তেও তিনি অপরাধী সাব্যস্ত। তারপরও তিনি বহাল তবিয়তে।
এ বিষয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী রশীদ -উন-নবী নয়া দিগন্তকে বলেন, মিটফোর্ড হাসপাতালে কর্মরত কেউ কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি করলে, তাকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না। ক্যাশিয়ার সাত্তারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। দুদকে অভিযোগ করেছি। তিনি বলেন, অপরাধী সাত্তার নিজেকে অসুস্থ বলছে। আমরা তাকে মেডিক্যাল চেকআপ করিয়ে কোনো অসুস্থতা পায়নি।

 


আরো সংবাদ



premium cement