১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চিনির বাজারে আগুন হলেও ৬টি সুগার মিল দুই বছর ধরে বন্ধ

-

দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ছয়টি সুগার মিলে ক্রমাগত লোকসানের বোঝা কমাতে উৎপাদন ২০২০ সালে বন্ধ করে দেয় সরকার। গত দুই বছর ধরে মিলগুলো অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকায় নষ্ট হচ্ছে মিলের মূল্যবান যন্ত্রাংশ। অকেজো হয়ে পড়েছে আখ পরিবহনের শত শত ট্রলিসহ নানা ধরনের মূল্যবান সরঞ্জাম। উৎপাদন বন্ধ করায় উৎপাদনের লোকসান কমানো গেলেও মিলের সাথে সংশ্লিষ্ট যান ও যন্ত্রাংশের অপূরণীয় ক্ষতি বন্ধ হচ্ছে না। শুধু বস্তুগত ক্ষতিই নয়, বন্ধ মিলগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতে প্রতি বছর গুনতে হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। পাশাপাশি চিনিকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মিল জোনের আখের উৎপাদন শূন্যতে নেমে এসেছে। ফলে চিনিজাতীয় পণ্যের উৎপাদন কমে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। এ দিকে দেশের ছয়টি সুগার মিলের উৎপাদন বন্ধ থাকায় চিনির চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। ফলে চিনির কেজি খুচরা পর্যায়ে ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যার কারণে চিনি দ্বারা উৎপাদিত সব পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। অপর দিকে সুগার মিলের সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষের কর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা অর্ধাহারে অনাহারে দিনাতিপাত করছে।

সরেজমিন জানা যায়, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে আখ মাড়াই শুরু হওয়ার আগে শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে পাবনা সুগার মিলসহ দেশের ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলের উৎপাদন বন্ধ করা হয়। উৎপাদন বন্ধ হওয়া এসব মিলগুলো হচ্ছে, পাবনা সুগার মিল, কুষ্টিয়া সুগার মিল, রংপুর সুগার মিল, পঞ্চগড় সুগার মিল, শ্যামপুর সুগার মিল এবং সেতাবগঞ্জ সুগার মিল।
পাবনা সুগার মিল ২০২০ সাল থেকে উৎপাদন বন্ধ থাকায় ৪৫ একর জায়গার ওপর স্থাপিত পাবনা চিনিকলের বিশাল এলাকা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জংলী গাছ আর আগাছায় ভরে গেছে। প্রায় ৫ শতাধিক কর্মীর কর্মস্থল বিশাল এ মিল এলাকা এখন জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। পাবনা সুগার মিলের আখ পরিবহনের জন্য যেসব ট্রাক্টর ও ট্রলি ব্যবহার করা হতো সেগুলো খোলা আকাশের নিচে অযত্ন অবহেলায় পড়ে রয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ছে আখ পরিবহনের ২০টি ট্রাক্টর ও ১২২টি ট্রলি। দীর্ঘদিন পড়ে থাকলে এসব মূল্যবান যানবাহনের অনেক অংশই ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে সরকারের আগামীতে চিনি উৎপাদন ব্যাহত হয়ে বিদেশনির্ভর আমদানি বেড়ে যাবে।

মিল সূত্র জানায়, যে সময় মিলটি বন্ধ করা হয় সে সময় মিলে প্রায় ৫৮৯ জন কর্মী ছিল। যাদের মধ্যে স্থায়ী নিয়োগকৃতরা বেশির ভাগই অন্যান্য মিলে পদায়ন হয়েছে। তবে মিলটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বর্তমানে ৩০ জন নিরাপত্তাকর্মী এবং ৩১ জন অফিস স্টাফ রয়েছে। প্রায় ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৯৯২ সালে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার দাশুরিয়াতে পাবনা চিনিকল প্রতিষ্ঠিত হয়। ৪৫ একর জায়গার ওপর মিল, অফিস এবং আবাসিক এলাকা স্থাপন করা হয় এবং ১৫ একর জায়গার ওপর লেগুনা স্থাপন করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে কখনো লাভের মুখ দেখেনি মিলটি। ক্রমাগত লোকসানের কারণে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে মিলের উৎপাদন বন্ধ করা হলেও বন্ধের পরও আরো লোকসান গুনতে হচ্ছে পাবনা সুগার মিলে। একই অবস্থা উৎপাদন বন্ধ হওয়া বাকি চিনিকলগুলোতেও। মিল বন্ধ হওয়ায় আখের উৎপাদন থেমে গেছে। পাবনা সুগার মিলের অন্তর্গত ১০টি চিনি উৎপাদনের জোন রয়েছে। ২০২০ সালে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় মিল জোনের প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমিতে আখের আবাদ করা হয়। সে বছর কৃষকরা অনেক ঘোরাঘুরি করে পাবনার নিকটবর্তী নাটোরের লালপুরে অবস্থিত নর্থ বেঙ্গল চিনিকলে উৎপাদিত আখ সরবরাহ করে লোকসানে পড়ে। এর পর থেকেই আখ উৎপাদনে আগ্রহ হারায় তারা। গত বছর কিছু এলাকায় আখের আবাদ হলেও এ বছর চাষিরা পুরোপুরি আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এ বছর মিল জোনে মাত্র ৪০-৫০ হেক্টর জমিতে কৃষকরা আখের আবাদ করেছে গুড় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করার আশায়। সুগার মিল বন্ধ থাকায় আখের বাজার সঙ্কুচিত হয়ে পড়ায় কৃষকরা আখের আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সবজি ও অন্যান্য ফসল আবাদে মনোনিবেশ করেছে।

পাবনা সুগার মিলের আখচাষি সমিতির সভাপতি শাজাহান আলী বাদশা জানান, কৃষকরা উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে না পারলে সে পণ্য উৎপাদন করে না। চিনিকল বন্ধ থাকায় আখ চাষ করে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে পারবে না তাই আখ চাষ থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বাদশা মিল জোনের অন্যতম প্রধান আখ চাষি যিনি প্রতি বছর ৬০ থেকে ৭০ বিঘা জমিতে আখের আবাদ করে কিন্তু এ বছর মাত্র ৫ বিঘা জমিতে আখের আবাদ করেছেন। পাবনা সুগার মিলের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আক্তারুজ্জামান জানান, বিপুলসংখ্যক যানবাহন অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকায় পুরোপুরি অকেজো হয়ে পড়ার আগেই দেশের অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলে পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ দিকে অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকায় মিলের মূল্যবান অনেক যন্ত্রাংশগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যে মিল থেকে অনেক যন্ত্রাংশ খুলে অন্য মিলে কাজে লাগানো হয়েছে ফলে মিলটি এখন চালু করা সম্ভব নয়। মিলটি আবার চালু করতে হলে অন্তত এক বছর মেরামতের জন্য সময় লাগবে পাশাপাশি অনেক যন্ত্রাংশ নতুন করে সংযোজন করতে হবে এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে। বর্তমানে মিলটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কর্মীদের বেতনভাতা, বিদ্যুৎ বিলসহ প্রতি বছর প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement