২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সিলেটে ফরেনসিক ল্যাব না থাকায় বহু মামলার তদন্ত ঝুলছে

-

চাঞ্চল্যকর মামলার তদন্তে দীর্ঘসূত্রতায় প্রলম্বিত হয় বিচারকার্য। ক্লু-লেস হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, চাঞ্চল্যকর মামলার ক্ষেত্রে অপরাধ ও অপরাধী শনাক্তের জন্য প্রয়োজন হয় ফরেনসিক ল্যাবে রাসায়নিক ও ভিসেরা রিপোর্ট। কিন্তু প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটে ফরেনসিক ল্যাব না থাকায় এখনো ভরসা করতে হচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ল্যাবে। মাসের পর মাস ধরে লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও বিভিন্ন ঘটনার ফরেনসিক প্রতিবেদনও ল্যাবে বন্দী থাকে। এতে জট খুলছে না নানা অপরাধ রহস্যের। বিলম্ব হচ্ছে চাঞ্চল্যকর মামলার তদন্তে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আসার পরও শুধু ফরেনসিক রিপোর্ট না আসায় আটকে যাচ্ছে অনেক আলোচিত-সমালোচিত মামলার তদন্ত কার্যক্রম।
সিলেটের ওসমানীনগরে প্রবাসী পরিবারের তিন সদস্যের মৃত্যুর ঘটনার আলামতের প্রতিবেদনগুলোও এখন পর্যন্ত ল্যাবেই বন্দী রয়েছে। এ জন্য ওই ঘটনার সার্বিক তদন্ত কার্যক্রমও আটকে আছে। ২৫ দিন পার হলেও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, ডিএনএ নমুনার প্রতিবেদন, ভিসেরা আর নানা আলামতের ফরেনসিক প্রতিবেদন না মেলায় অনেক প্রশ্নের উত্তরও জানা যাচ্ছে না স্পর্শকাতর ওই ঘটনার। এতে ওই প্রবাসী পরিবারেও হতাশা দেখা দিয়েছে। মৃত্যুর কারণ জানতে ফরেনসিক প্রতিবেদনের অপেক্ষায় রয়েছে পুলিশও।
জানা গেছে, সিলেটে ফরেনসিক ল্যাবে ডিএনএ ও ভিসেরা পরীক্ষা না হওয়ায় বিলম্বিত হচ্ছে তদন্ত। বর্তমানে ভিসেরা কেমিক্যাল রিপোর্টের জন্য চট্টগ্রামে ও ডিএনএ-রিপোর্টের জন্য ঢাকায় সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে সিলেট অঞ্চলের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। বিশেষ করে নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণের ঘটনাসহ হত্যা মামলার প্রতিবেদন পেতে বিলম্ব হওয়ায় তদন্ত শেষ করতে বাড়তি সময় লাগছে। বর্তমানে ভিসেরা কেমিক্যাল রিপোর্টের জন্য চট্টগ্রামে ও ডিএনএ-রিপোর্টের জন্য ঢাকায় সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে সিলেট অঞ্চলের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। প্রতিটি প্রতিবেদন পেতে অন্তত এক মাস অপেক্ষা করতে হয়। অনেক সময় দেখা গেছে দুই-তিন মাসেও প্রতিবেদন আসে না। এ ছাড়া ডিএনএ রিপোর্ট পেতে ছয় মাসেরও বেশি সময় লেগে যায়। এই সঙ্কট সমাধানে সিলেটে ভিসেরা এবং ডিএনএ পরীক্ষার ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ক্লু-লেস মামলার একাধিক তদন্ত কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ক্লু-লেস বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর মামলার রহস্য উদঘাটনে আদালত সিআইডিকেই নির্দেশ দিয়ে থাকেন। অপরাধের রহস্য উদঘাটনে কর্মকর্তাদের আলামত নানা পরীক্ষা করাতে হয়। সিলেটে কোনো ল্যাব না থাকায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম পাঠাতে হয়। এতে সময় লাগে। পরীক্ষার রিপোর্ট পেতেও দেরি হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সিলেট থেকে চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকার ল্যাবে নমুনা পাঠানোর প্রক্রিয়ায় বেশ কয়েক দিন লেগে যায়। নমুনা সংগ্রহের পর তা সংরক্ষণ, পুলিশ কর্তৃক আদালতের অনুমতির জন্য বিষয়টি উপস্থাপন ও পরীক্ষার অনুমোদনের আদেশ নিতে হয়। তাৎক্ষণিকভাবে নমুনা পরীক্ষাগারে প্রেরণ না করার ফলে অনেক সময় নমুনা পুরোপুরি ঠিক নাও থাকতে পারে বলে শঙ্কা থেকে যায়। কিন্তু সিলেটে ফরেনসিক ল্যাব থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে নমুনাটি ল্যাবে দেয়া সম্ভব হতো। এর ফলে রিপোর্টটিও তরতাজা পাওয়া যাবে। নিশ্চিত হবে ন্যায় বিচার। এমন প্রেক্ষাপটে তারা সিলেটে দ্রুত ফরেনসিক ল্যাব স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন।
সূত্র জানিয়েছে, ফরেনসিক ল্যাবে রাসায়নিক, ব্যালিস্টিকস, হস্তলিপি, ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ফুটপ্রিন্ট ও জালনোট শনাক্ত ছাড়াও ভিসেরা, নারকোটিক ও অ্যাসিড টেস্টসহ আরো কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করা হয়। এ ছাড়া মাদকদ্রব্য, মৃত মানুষের ভিসেরা, কবর থেকে তোলা হাড়, চুল, মাটি ও সফট টিস্যু, বিষাক্ত বা চেতনানাশক পদার্থের উপস্থিতি, আলামতে রক্তের উপস্থিতি, বিস্ফোরক দ্রব্য, দাহ্য পদার্থসহ বিভিন্ন আলামতের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে অপরাধীর উপস্থিতি শনাক্ত করা যায়। ‘ক্রাইম সিন’ থেকে সংগৃহীত ফিঙ্গার প্রিন্ট থেকে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান আঙুলের ছাপের সাথে সন্দেহভাজনদের আঙুলের ছাপ পরীক্ষা করা হয়। শুধু ফরেনসিক ল্যাবের পরীক্ষায় অপরাধী শনাক্তের ফলে অনেক ক্লু-লেস ঘটনার রহস্য উদঘাটিত হচ্ছে।
বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে ফরেনসিক ল্যাবের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। মামলার দীর্ঘসূত্রতা দূরীকরণ ও ন্যায় বিচার নিশ্চিতের লক্ষ্যে সিলেটেও এই ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন জরুরি বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ডা: মো: শামছুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, বর্তমানে একই কাজ কয়েকটি বিভাগকে করতে হচ্ছে। ভিকটিমের বয়স নির্ধারণের রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগ এবং সেক্সুয়ালের ক্ষেত্রে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ কাজ করছে। এ ছাড়া মৃত্যুর পূর্বে ধর্ষিত হয়েছে কি না তার জন্য প্যাথলজি বিভাগ কাজ করে। বিষক্রিয়ার সন্দেহ হলে ভিসেরা কেমিক্যাল রিপোর্টের জন্য চট্টগ্রামে ও ডিএনএ রিপোর্টের জন্যে ঢাকায় সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে নমুনা পাঠানো হয়। তিনি বলেন, সিলেটে ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন হলে এক জায়গায় সব রিপোর্ট কম সময়ের মধ্যে তৈরি হবে। এতে সময়ও অনেক কমে আসবে। ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে এ জন্য দক্ষ লোকও রয়েছে। শুধু কয়েকটি বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হলে সিলেটের লোকজনই ফরেনসিক ল্যাব পরিচালনা করতে পারবে। সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহফুজুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রতিটা মামলাতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে পাঠাতে হয়। সেগুলো আসতে আসতে দেরি হওয়ায় মামলায় দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে। এতে ন্যায়থবিচার থেকে অনেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এ অবস্থায় দ্রুত ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন করা জরুরি। এতে মানুষ সঠিক বিচার পাবে। মামলার জট কমে আসবে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সিলেটের বিশেষ পুলিশ সুপার সুজ্ঞান চাকমা নয়া দিগন্তকে বলেন, সিআইডির মামলাগুলোর ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে না। অন্য সংস্থার তদন্ত কার্যক্রম ফরেনসিক ল্যাবের কারণে বিলম্ব হচ্ছে। তিনি বলেন, সিলেটে ফরেনসিক ল্যাব স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর হয়ে এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবনাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেয়েছে। বর্তমানে ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনাটি অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। সিলেটে ফরেনসিক ল্যাবটি স্থাপন হলে সিলেট বিভাগের চার জেলাসহ পাশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ জেলার মামলা তদন্তে ল্যাবটি কাজে লাগবে। এর ফলে চাঞ্চল্যকর মামলার তদন্তে সময়ও কম লাগবে।


আরো সংবাদ



premium cement