২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
দক্ষিণাঞ্চলের লঞ্চযাত্রীরা হয়রানির শিকার

২১টি লঞ্চ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মেরিন আদালতে মামলা চলছে

-

বরিশাল অঞ্চলের মানুষের প্রধান যাতায়াত মাধ্যম নৌপথ। আরামদায়ক ভ্রমণ ও খরচ কম হওয়ায় লঞ্চেই যাতায়াত করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ। তবে লঞ্চে যাতায়াত করতে গিয়ে পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য বিআইডব্লিউটিএ আর লঞ্চ মালিক কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছেন বলা হলেও বাস্তবে কোনোভাবেই যাত্রী হয়রানি থামছে না।
যাত্রীরা বলছেন, নীতিনির্ধারণী দুই পক্ষের স্বচ্ছতার কথা আইওয়াশমাত্র। মালিকপক্ষ যাত্রীদের পণ্য মনে করে হয়রানি, নির্যাতন করে। আর বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ না করায় নৌরুটে যাত্রীরা অসহায়। ফলে পন্টুন ত্যাগ করার পর কার্যত আইনের বাইরে চলে যায় নৌযানগুলো।
যাত্রীরা বলছেন, যাত্রীসেবায় লঞ্চ ও সরকারি দফতরের সমন্বয় না থাকায় অরাজকতার সৃষ্টি হচ্ছে। সচেতনতা ও দায়িত্ববোধেই শৃঙ্খলা ফেরাতে পারে এই পথে। দিনে দিনে হয়রানি ও নির্যাতন বাড়ছে।
অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ বরিশালের পরিবহন পরিদর্শক (টিআই) শামসুদ্দিন খান জানান, বরিশাল-ঢাকা রুটে মোট ২৮টি লঞ্চ যাত্রী পরিবহন করে থাকে। এর মধ্যে বরিশাল-ঢাকা রুটে সরাসরি ১৮টি ও ভায়া ১০টি লঞ্চ চলাচল করে। বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হয় সব সময়ে যাত্রীনিরাপত্তা নিশ্চিত করার। আইন ভঙ্গের কারণে ২১টি লঞ্চ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মেরিন আদালতে মামলা চলছে। মামলাগুলো বিআইডব্লিউটিএ থেকে দেয়া হয়। এ ছাড়া সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হয়। কিন্তু সুযোগ পেলেই যাত্রী হয়রানি, আইনভঙ্গের কাজ করে থাকে লঞ্চ মালিকরা। নিয়ম মেনে চলার মানসিকতা গড়ে ওঠা দরকার। শুধু মামলা দিয়েই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলেন এই কর্মকর্তা। জানা গেছে, বরিশাল-ঢাকা নৌরুটে মোট ২২টি লঞ্চ চলাচলের লাইসেন্স রয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি লঞ্চ চলাচল করছে। বাকি চারটি বন্ধ রয়েছে। এছাড়া যে ২১টি লঞ্চের বিরুদ্ধে মামলা চলছে সেগুলোর মধ্যে এমভি পারাবত-১০ লঞ্চের বিরুদ্ধে-তিনটি, পারাবত-১১ লঞ্চের বিরুদ্ধে একটি, সুন্দরবন-১১ লঞ্চের বিরুদ্ধে একটি, ফারহান-৮ লঞ্চের বিরুদ্ধে একটি, মানামী লঞ্চের বিরুদ্ধে একটি, কুয়াকাটা-২ লঞ্চের বিরুদ্ধে দু’টি, অ্যাডভেঞ্চার-১ লঞ্চের বিরুদ্ধে একটি, পরাবত ১২ লঞ্চের বিরুদ্ধে একটি, এমভি টিপু-১২ লঞ্চের বিরুদ্ধে একটি।
এ ছাড়া বানারীপাড়া-তরুরবাজার রুটের লঞ্চ এমএল রানার বিরুদ্ধে একটি, ঢাকা-ভাণ্ডারিয়া রুটের এমভি মর্নিং সান লঞ্চের বিরুদ্ধে একটি, এমভি বিউটি অব লইনছরি লঞ্চের বিরুদ্ধে একটি, ঢাকা-চরমোনাই রুটের এমভি কাজল-৭ লঞ্চের বিরুদ্ধে একটি, ঢাকা-বরগুনা ভায়া বরিশাল রুটের এমভি অভিযান-১০ লঞ্চের বিরুদ্ধে একটি মামলা চলমান। যাত্রীবাহী ট্রলার নওরীন, মিরাজ এক্সপ্রেস, আল আরাফাত ও আল্লাহ ভরসার নামে একটি করে মামলা চলছে।
দীর্ঘদিন লঞ্চে চলাচলকারী যাত্রী নিয়াজ ফয়সাল জানান, আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি লঞ্চগুলো ঘাট ত্যাগ করার পর দেশের আইনের মধ্যে থাকে না। আইনের ঊর্ধ্বে চলে যায়। যাত্রীরা কেউ আইনের সাহায্য চাইলেও তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। ফয়সাল তার জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ৯ জানুয়ারি সকালে সুরভী-৯ লঞ্চে কমপক্ষে সাত থেকে আট জনকে মারধর করে লঞ্চ স্টাফরা। সেই ঘটনায় আমার বন্ধুকে মারধর করা হয়। আমি মারধর বন্ধ করতে গিয়ে নিজেও হামলার শিকার হই। লঞ্চ স্টাফরা ওই রাতে চেয়েছিল অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি জানাজানি না হোক। কিন্তু আমার বন্ধু মারুফ আগুনের ছবি তোলে, আরেক বন্ধু ছিল সে ৯৯৯ নম্বরে কল করে। এই কারণে ক্ষুব্ধ ছিল লঞ্চ স্টাফরা। রাতেই মারধরের চেষ্টা করে আমাদের। তবে সবার ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদে তা সম্ভব হয়নি। ফলে সকালে সঙ্ঘবদ্ধভাবে লঞ্চ স্টাফরা আমাদেরও ওপর হামলা করে।
সচেতন নাগরিক কমিটি বরিশাল জেলার সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, ঢাকা-বরিশাল রুটে একের পর এক দুর্ঘটনা তো ঘটেই চলছে। যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য শুধু একটি পক্ষকে কাজ করলে চলবে না। সমন্বিতভাবে সকলের কাজ করতে হবে। তাছাড়া যাত্রীদের নিরাপত্তা না দিলে একসময়ে লঞ্চ পরিবহন থেকে যাত্রীরা মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবে। তিনি বলেন, নৌরুট নিরাপদ রাখতে কেন এত মামলা দিতে হবে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের? কেন মালিকপক্ষ সচেতন হবে না। মনে রাখতে হবে, যাত্রীনিরাপত্তা নিশ্চিত না করলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন লঞ্চ মালিকরাই।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ লঞ্চ মালিক সমিতির সহসভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু অবশ্য যাত্রী হয়রানির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, লঞ্চে যাত্রী হয়রানি করার প্রশ্নই ওঠে না। সম্প্রতি একটি লঞ্চে যাত্রী ও সাংবাদিকদের ওপর যে হামলার ঘটনা ঘটেছে তা ন্যক্কারজনক। আমি ওই ঘটনার নিন্দা জানাই। আমরা যারা ব্যবসা করি তারা যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করি। আমরা সবসময় স্বচ্ছ থাকার চেষ্টা করি। বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক ও বরিশালের নৌবন্দর কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কোনো নৌযানের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে মামালা দেয়াসহ তাৎক্ষণিক যে ব্যবস্থা প্রয়োজন তা গ্রহণ করি। আমরা চাই নৌপথে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক।

 


আরো সংবাদ



premium cement