২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

টাইপরাইটিং পেশায় আধুনিকতার ছোঁয়া

-

সময়ের চরিত্রেই আছে বহমানতা। এই বহমানতাকে আঁকড়েই আমাদের আশ্রয় আর কর্মকাণ্ড। জীবন বা সময় দু’টিই একে অপরকে পরিপূরণ করতে করতেই অগ্রসর হয়। ক্রমেই এগোতে থাকি আমরাও। কাল থেকে উত্তীর্ণ হওয়া মহাকালে। আমাদের কাছে কোনোটিই খুব প্রত্যাশিত নয়, বরং হঠাৎ বাঁকে পড়ে অন্য দিকে ঘুরে যায় সেই গতিমুখ, আবার সেই বদলের সাথে মানিয়ে চলতে চলতে এগোনো, এভাবেই নিরন্তর প্রবাহ। কালের নিয়মেই পাল্টেছে যুগের হাওয়া, পাল্টেছে সামাজিক রীতিনীতি, বদল এসেছে নানা ক্ষেত্রে, আর্থসামাজিক পরিকাঠামোয়। সেখানে পেশার ক্ষেত্রই বা বাদ যায় কেনো। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে তৈরি হয়েছে নতুন ধরনের কাজ, নতুনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে মানুষ, কিংবা কখনো রক্ষণশীলতাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চেয়ে সেটাও হয়নি, তা-ও ধীরে ধীরে সেখানেই করে নিতে চেয়েছে সংস্থান। তারপর সেই পেশাও এক দিন পুরনো হয়েছে, তার জায়গায় এসেছে আধুনিক ছোঁয়া, অথবা একেবারে বিলুপ্তই হয়ে গেছে প্রায়। সবটাই সেই কালের নিয়মে। যে রকম একসময় ঢাকা শহরের রাস্তায় বা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দেখা যেত টাইপরাইটাররা বসে থাকতেন। শুধু ঢাকা শহর নয় বিভিন্ন বিভাগীয় এবং বড় জেলা শহরেও এই টাইপরাইটারদের দেখা মিলত। প্রযুক্তির লড়াইয়ে হেরে গিয়ে আরো একটি পেশা অবলুপ্ত প্রায়। সেটি হচ্ছে টাইপরাইটার টাইপিস্ট। দু’দশক আগেও টাইপরাইটারের ভালো রমরমা ছিল বাজারে। পুরনো সিনেমায়, গল্পে কোনো বড় অফিস ঘরের দৃশ্যে অফিসার বা যেকোনো উচ্চপদস্থ কর্মী ডিক্টেশন দিচ্ছেন আর একজন টাইপিস্ট খটাখট করে টাইপরাইটারে তা টাইপ করে ফেলছেন, এটা ছিল খুব সাধারণ একটা ঘটনা। পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট বা ব্যক্তিগত সচিব রাখার সময়ে প্রার্থীদের যোগ্যতা যাচাই করে নেওয়ার অন্যতম পরীক্ষাই ছিল টাইপিংয়ের স্পিড-টেস্ট। যিনি যত কম সময়ে যত তাড়াতাড়ি টাইপ করতে পারবেন, তিনি তত বেশি যোগ্য। এই ধরনের ডিক্টেশন শুনে হাই-স্পিড টাইপিংকে বলা হয় ‘শর্টহ্যান্ড টাইপিং’। অ্যাসিস্ট্যান্ট ছাড়া অন্যান্য পেশাও হতো টাইপিংয়ের, যে রকম চাকরির আবেদনপত্র লিখে দেয়ার কাজ, অডিও টাইপিং, কপি টাইপিং, ডেটা এন্ট্রি ক্লার্কের কাজ, যুদ্ধের সময় নিহতদের পরিবারকে চিঠি লেখার কাজেও প্রচুরসংখ্যক টাইপিস্ট নিয়োগ করা হতো।
টাইপরাইটারে লেখা একেবারে কাগজেই ছাপা হয়ে যেত। কাগজটিকে আগে স্ট্যান্ডে আটকে নিতে হতো, তারপর যত লাইন সরত, তত কাগজও সরে সরে যেত, সে কারণে পরের লাইনে যাওয়ার আগে কাগজকে আবার ঠিক পজিশনে নিয়ে আসতে হতো। এতটাই জনপ্রিয় ছিল এই টাইপিং যে, স্কুল পাশের পর ছাত্রছাত্রীদের এক রকম বাধ্যতামূলক ছিল শর্টহ্যান্ড টাইপিং শেখা। কিন্তু কম্পিউটারের আপগ্রেডেশন, ডেস্কটপের পর ল্যাপটপ, তারপর ট্যাবলেট, কিবোর্ড টাইপিংই এবং আধুনিক অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলই হয়ে উঠল টাইপরাইটার টাইপিংয়ের প্রধান অন্তরায়। যাকে বলা হচ্ছে আধুনিকতার ছোঁয়া। ভারতবর্ষে এক সময় বছরে পঞ্চাশ হাজার টাইপরাইটার মেশিন প্রস্তুত করত যারা, সেই গোদরেজ কোম্পানি ২০০৯ সালে এই মেশিন বানানো চিরতরে বন্ধ করে দেয় চাহিদা একেবারে কমে যাওয়ার কারণে।
ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে কথা হয় টাইপরাইটার মোহাম্মদ ইউসুফ (৬০) এর সাথে। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, মূলত সরকারি চাকরিতে যাওয়ার আশায় টাইপিং শিখেছিলাম। কিন্তু সরকারি চাকরি না হওয়ায় বাংলাদেশ বেতারে টাইপিস্ট হিসেবে কাজ করেছি। এরপর ১৯৮৮ সালে মোহাম্মদপুর থেকে কাজ শুরু করি। এখন প্রেস ক্লাবের সামনে বসি ২০০৫ সাল থেকে।
কম্পিউটার ও অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলের যুগে টাইপিং মেশিনের কাজ কেমন হয়? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এখন অনেকে বলেন কম্পিউটার নিয়ে বসতে। কিন্তু সেটা নিয়ে বসে কাজ করার সক্ষমতা নেই। বয়স হয়ে গেছে। এখনো ১৯৯৫-১৯৮০ সালের পুরনো কাজ পেলে করি। অনেকের পুরাতন কাগজ বা যোগদানপত্র ইত্যাদি হারিয়ে গেলে সেসব বিষয়ে কাজ করাতে আসেন। ইউসুফ জানালেন, কাগজ ছাড়া প্রতি পাতা ৩০০ টাকা হিসেবে কাজ করা হয়। আগে টানা সারাদিন কাজ করতেন। কিন্তু এখন প্রয়োজনে আসেন এবং ৩-৫ পাতা কম্পোজ করেন।
রাজধানীর তোপখানা রোড পেশাজীবী মুদ্রাক্ষরিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ আকরাম উদ্দিন বলেন, তিনি নিজে ১৯৯৯ সালে টাইপিং পেশায় নিয়োজিত হন। একসময় ৫২ থেকে ৫৩ জন ছিলেন। অনেকেই পেশা ছেড়ে অন্য চাকরি করেন। এখন ৩৬ জন বসেন। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে এই পেশায় কম আসেন। কম্পিউটার এসে আমাদের কাজ অনেক কমেছে। ফলে আগের মতো টাইপিং মেশিন ব্যবহার হয় না বললেই চলে। শুধু পুরনো ফরম্যাটের বাংলা লেখার জন্য টাইপিং মেশিন চলে। বাকি ইংলিশসহ অন্য সব কাজ কম্পিউটারে করি। যুগোপযোগী জিনিস নিয়ে কাজ করতে হয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজও পাওয়া যায়। তিনি বলেন, একটা সময় কাকরাইল, মতিঝিল, দৈনিক বাংলা মোড়, পুলিশ হেডকোয়ার্টাসের সামনে টাইপরাইটাররা বসতেন। কিন্তু এখন পেশাদার লোক অনেক কমে গেছে।


আরো সংবাদ



premium cement