২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

৩ কোটি টাকা হাতিয়ে লাপাত্তা আ’লীগ নেতার ছেলের ই-কমার্স ‘আস্থার প্রতীক’

-

অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যবসায়িক গ্রুপ ঢাবিয়ান বিজনেস কমিউনিটিকে (ডিবিসি) ব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে শপ সেলার ও গ্রাহকের অন্তত তিন কোটি টাকা আটকিয়ে রেখেছে ‘আস্থার প্রতীক’ নামের একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান।
প্রতিষ্ঠানটির এমডি (ম্যানেজিং ডিরেক্টর) রুশো তালুকদারের বাবা টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর পৌরসভার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খায়রুল ইসলাম তালুকদার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন ও আকর্ষণীয় ছাড়ে পণ্য বিক্রির ফাঁদ তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি শপ মালিক ও ক্রেতাদের কাছে প্রায় তিন কোটির বেশি টাকা নিয়ে এখন সেলারদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে অফিস বন্ধ করে অনেকটা লাপাত্তা হয়ে আছেন কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর রুশো তালুকদার ও বাকি ১২ জন শেয়ারহোল্ডার। এমডি রুশো তালুকদার ও ফিন্যান্স ডিরেক্টর আতিকুর রহমান তালুকদারের তিনটি নম্বরে কয়েকবার ফোন করে তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। কোম্পানির অন্য পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের ফোন দেয়া হলে তাদের ফোনও বন্ধ পাওয়া যায় এবং মাঝে মাঝে কল রিসিভ করলেও আবোল তাবোল বুঝিয়ে কল কেটে দেন।
কোম্পানির ট্যাক্স রেজিস্ট্রেশনের ফরর্মে কোম্পানির কার্যালয় টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর উল্লেখ থাকলেও রাজধানীর মোহাম্মদপুরের অফিস থেকেই মূলত কার্যক্রম চালানো হতো। যেটি বর্তমানে পুরোপুরি বন্ধ আছে। এমনকি বন্ধ রয়েছে কাস্টমার কেয়ার সেন্টারের নম্বরও। ইতোমধ্যে ‘আস্থার প্রতীক’ নামের যে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বেশির ভাগ কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো সেটিও ডাউন করে দেয়া হয়েছে এবং একই নামের ফেসবুক পেজ থেকে শপ মালিক ও কাস্টমারদের বিভিন্ন লেনদেনের তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে। তবে শপিং প্ল্যাটফর্মটির কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও ফেসবুকে ও বিভিন্ন মাধ্যমে নিয়মিত আশ্বাস দিয়ে সময় চেয়ে যাচ্ছেন কোম্পানির এমডি রুশো তালুকদার।
ডিবিসিতে চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন ও লোভনীয় অফার দিয়ে প্রথম দিকেই বিপুল পরিমাণ শপ মালিক ও গ্রাহকের সাড়া পায় কোম্পানিটি। সর্বমোট সাতটি ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে যার বেশির ভাগেরই পেমেন্ট এখনো বাকি। প্রথম অফারেই তারা নিয়মানুযায়ী ২০ দিনে সেলার পেমেন্ট দিতে ব্যর্থ হয়। ২৫ দিনে প্রথম ক্যাম্পেইনের পেমেন্ট ক্লিয়ার করে দ্বিতীয় ক্যাম্পেইন চলতি বছরের আগস্টে দিয়ে হিসাব অনুযায়ী পেমেন্ট ২০ দিনের মধ্যে দেয়ার কথা থাকলেও দ্বিতীয় ক্যাম্পেইনের টাকা ৫৮ দিনে সম্পন্ন করে; কিন্তু এর পর থেকেই শুরু হয় টালবাহানা। শেষদিকে দীর্ঘ দিন অতিক্রম হলেও কোম্পানিটির টাকা দেয়ার কোনো সদিচ্ছা লক্ষ করা যাচ্ছে না। প্রতি কাম্পেইনে এক সপ্তাহের মধ্যেই পণ্য সরবরাহের কথা বললেও আস্থার প্রতীক সময় মতো পেমেন্ট প্রদান তো করেইনি বরং এখন মালিকপক্ষের খোঁজই পাওয়া যাচ্ছে না। সেলার ও কাস্টমারদের বিভিন্ন মেয়াদে টাকা বাকি রেখেছেন তারা।
এর মধ্যেই কয়েক দিন আগে সেলারদের সাথে দফায় দফায় অনলাইনে (জুম প্ল্যাটফর্মে) মিটিং করে টাকা দেয়ার আশ্বাস প্রদান করেন রুশো। কিন্তু প্রতিবারই কথার সাথে কাজের মিল দেখাতে না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে যান সেলাররা। সবশেষ গত ১৪ নভেম্বর রুশো তালুকদার মোহাম্মদপুরের ভাড়া বাসার সেই অফিসে সেলারদের সাথে সরাসরি বৈঠকে বসেন। রুশোর সময় আবেদনের ভিত্তিতে বৈঠকে উপস্থিত সেলাররা দাবি করে, তাদের যাবতীয় পাওনার ৫০ শতাংশ টাকা পরবর্তী এক সপ্তাহের মধ্যে প্রদান করতে হবে। বাকি ৫০ শতাংশ দুই মাসের মধ্যে দিতে হবে। কিন্তু তাদের দাবির জবাবে রুশো বলেন, ওয়েবসাইটের এখন পর্যন্ত মোট সাতটি ক্যাম্পেইনে মোট ট্রানজেকশন সাত-আট কোটি টাকার মতো। প্রতি ক্যাম্পেইনের ভর্তুকি বাবদ মোট এক কোটি ৮০ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। যার ফলে আমি সেলারদের পেমেন্ট দিতে পারছি না। আমাকে ব্যবসা করার সুযোগ দিলে আমি ধীরে ধীরে সবার পেমেন্ট ক্লিয়ার করে দিতে পারব।
এরপর ওই বৈঠকে সেলারদের কাছে চার বছরের সময় চান তিনি। কিন্তু তাকে পরবর্তী এক সপ্তাহের মধ্যে ৫০ শতাংশ টাকার চেক দিতে হবে এমন মর্মে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করে সেলাররা তাকে যেতে দেন। এর পর থেকেই লাপাত্তা রুশো। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শেয়ারহোল্ডার বলেন, আমি ভালোভাবে খোঁজখবর না নিয়েই রুশোর সাথে বিনিয়োগ করেছিলাম। এমনকি চুক্তিপত্রটাও আমি পড়িনি। ওরা এমন করবে জানলে কখনোই বিনিয়োগ করতাম না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করলেও ‘আস্থার প্রতীক’-এর কোনো সরকারি নিবন্ধন নেই। শুধু টিআইএন রেজিস্ট্রেশন করা আছে, যার নম্বর ১৮৮৬৫২৮৪৮০১৭।
আস্থার প্রতীকের এমডি ফেসবুক লাইভে যে তথ্য দিয়েছেন তাতে বলা হয়েছে, এখনো প্রতিষ্ঠানটির কয়েক হাজার গ্রাহক রয়েছে। এর বাইরে রয়েছে কয়েক শত সেলার। গ্রাহকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পণ্যের অর্ডার করার পর কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও তারা সেগুলো পাচ্ছেন না। এ ছাড়া মোটরসাইকেল, টেলিভিশন, ফ্রিজ, মাইক্রোওভেন, এসিসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পণ্য অর্ডার করেছেন ক্রেতারা। এসব পণ্যের ক্ষেত্রে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ ছাড়ের অফার দিয়ে গ্রাহক জোগাড় করত আস্থার প্রতীক।
ফরহাদ নামের একজন গ্রাহক নয়া দিগন্তকে বলেন, ১০ পার্সেন্ট ছাড়ে প্রায় দুই লাখ টাকার তেল ও চিনি অর্ডার করেছিলাম। ১৫ দিনের মধ্যে ডেলিভারি দেয়ার কথা থাকলেও তিন মাস হয়ে যাচ্ছে তাদের কোনো খোঁজখবরই নেই। আমার পণ্যও দিচ্ছে না টাকাও ফেরত দিচ্ছে না। কারো সাথে যোগাযোগ করতেও পারছি না। কাস্টমার কেয়ারের ফোন নম্বরেও কেউ ধরছে না। জামিল বখতিয়ার নামের একজন সেলার জানান, আমার ২০ লাখ টাকার পেমেন্ট আটকে আছে। তারা কোনোভাবেই টাকা দিচ্ছে না। আমরা সেলাররা মোটামুটি সবাই ছাত্র। এই টাকা না দিলে আমরা কিভাবে কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। উদ্যোক্তা জীবনের শুরুতেই এমন প্রতারণার শিকার হলে কিভাবে আমরা বিনিয়োগের সাহস পাবো।
আব্দুল আজিজ নামের আরেকজন সেলার বলেন, তিনটি অফার মিলে আমার ২১ লাখ টাকার বেশি পেমেন্ট আটকে রেখেছে। চার মাস হয়ে যাচ্ছে কিন্তু টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো আশা দেখতে পাচ্ছি না। একজন ছাত্র হয়ে এতগুলো টাকা যদি আমি ফেরত না পাই তাহলে পথে বসে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
উল্লেখ্য, রুশো তালুকদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উর্দু বিভাগ ও জসীমউদ্দীন হলের ছাত্র। রুশো জসীমউদ্দীন হল ডিবেটিং সোসাইটির সাবেক সভাপতি। তার পিতা টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর পৌরসভা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খায়রুল ইসলাম তালুকদার (বাবলু)। চলতি বছরের ১৩ জুলাই রুশো তার সহযোগী আতিকুর রহমান তালুকদার, হাফিজ আল আসাদ, ইশরাত জাহান, হাসান মাহমুদ তানভীর, ডালিয়া ইউসুফ, আলফি শাহরিয়ার, মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম, সনেট তালুকদার, নাহিদ, ইসরাত জুই, আব্দুল্লাহ আল ফয়সাল এবং সেগুফতা বুশরা মিশমাকে নিয়ে ১৪ লাখ টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটি চালু করেন।


আরো সংবাদ



premium cement