১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

২ বছরে উখিয়া-টেকনাফে প্রাণ গেল ৭ বুনো হাতির

-

উখিয়া-টেকনাফ এলাকায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে নষ্ট হয় হাতির আবাসস্থল ও চলাচলের করিডোর। এরপর তৈরি হয় হাতি ও মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব। পাহাড় থেকে খাবারের খোঁজে লোকালয়ে এসে একের পর এক মারা পড়ছে বুনো হাতি। মৃত্যুর এই মিছিল যেন থামছেই না। কক্সবাজারে গেল তিন বছরে প্রাণ দিতে হয়েছে সাতটিরও বেশি বন্যহাতিকে। সরকার কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে বুনো হাতির মৃত্যুর তালিকা আরো দীর্ঘ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবেশসচেতন ব্যক্তিরা। পাহাড়ি জনপদে বিচরণকারী হাতির সুরক্ষায় অভয়াশ্রম গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন তারা।
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বনাঞ্চল উজাড় হওয়ায় বুনো হাতির খাবারের উৎস দিন দিন কমছে। এ ছাড়া বনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনে শিকার উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নিয়েছে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে গিয়ে উজাড় হয়েছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার আট হাজার একরেরও বেশি বনভূমি। এতে ধ্বংস হয়েছে বন, পাহাড়, গাছপালা ও প্রাণ-প্রকৃতি। হুমকির মুখে পড়েছে সেখানকার নানা প্রজাতির পশুপাখির সাথে বন্যহাতিরাও।
যার কারণে খাবার খুঁজতে খুঁজতে পাহাড় ছেড়ে লোকালয়ে নেমে এসে মানুষের বাধার মুখে পড়ে হাতির দল। বাধা পেয়েই তারা ফসলের মাঠ, মানুষের বসতঘরে তাণ্ডব চালায়। একপর্যায়ে হাতির দল বুনো আচরণ শুরু করে। কোনো কোনো সময় পায়ে পিষ্ট করে, কখনো শুঁড় পেঁচিয়ে তুলে আছাড় দিয়ে মানুষের জীবন কেড়ে নেয়। এই প্রেক্ষাপটে টিকে থাকার লড়াইয়ে নিজেদের জান-মাল রক্ষায় বুনো হাতির ওপর হিংস্র হয়ে ওঠে মানুষ।
বন্যহাতির সবচেয়ে বেশি বিচরণ ছিল কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে পাহাড়ি বনাঞ্চলে। এছাড়াও ছিল বেশ কিছু হাতি চলাচলের করিডোর। কিন্তু রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে নষ্ট হয় হাতির আবাসস্থল ও চলাচলের করিডোর। এরপর তৈরি হয় হাতি ও মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব। কক্সবাজারে গেল তিন বছরে এ দ্বন্দ্বে প্রাণ দিতে হয়েছে সাতটিরও বেশি বন্যহাতিকে।
তবে বন বিভাগ বলছে, হাতির নিরাপদ আবাসস্থল, খাদ্য ও করিডোর তৈরিতে কাজ করছে বন বিভাগ। যার কারণে গত দুই বছরে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বনাঞ্চলে দেখা মিলেছে ২০টির অধিক বন্যহাতির বাচ্চার। ইতোমধ্যে প্রায় ৭৪০ একর পাহাড়ি বনভূমিতে হাতির জন্য করা হয়েছে নিরাপদ আবাসস্থল, খাদ্য ও করিডোর উন্নয়ন।
এদিকে, গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে টেকনাফের হোয়াইক্যং পাহাড়ি এলাকায় দেখা মিলেছে সাতটি বন্যহাতি। যার মধ্যে পাঁচটি বড় হাতি ও দুটি হাতির বাচ্চা রয়েছে। এই দুটি বাচ্চার মধ্যে একটি সদ্য জন্ম নেয়া এবং আরেকটি বয়স দেড় বছরের মতো। দুটি দলে বিভক্ত হয়ে হাতিগুলো বনাঞ্চলে বিচরণ করছে বলে জানিয়েছে দক্ষিণ বন বিভাগ।
তবে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে বন্যহাতি ও বাচ্চাগুলোকে রক্ষার্থে তাদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল, খাদ্য, করিডোরসহ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দীপু বলেন, কক্সবাজার টেকনাফ পর্যন্ত ৬৩টি এশিয়ান হাতি রয়েছে। অধিকাংশ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে এসব হাতির আবাসস্থলে। ফলে এসব হাতির জীবন হুমকির মুখে পড়ে। তাদের চলাচলের করিডোরও বন্ধ হয়ে যায়।
দীপক শর্মা দীপু বলেন, ‘২০১৭ সালে রোহিঙ্গা আসার পর থেকে খাদ্য, আবাসস্থলসহ নানাভাবে বিপদে পড়ে কক্সবাজার বনাঞ্চলের হাতি। এর মধ্যে বনাঞ্চলে বাচ্চা হাতির দেখা যাওয়া ও হাতির বাচ্চা দেয়ার খবরগুলো অত্যন্ত আনন্দদায়ক। তাই এই অবস্থায় হাতিদের যে আবাসস্থল রয়েছে তা নিরাপদ রাখতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তাসহ নানাভাবে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
তবে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো: হুমায়ুন কবির বলেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে নষ্ট হয়েছে উখিয়া ও টেকনাফের হাতির নিরাপদ আবাসস্থল, খাদ্য ও করিডোর। যার কারণে খাবারের খোঁজে হাতি লোকালয়ে এসে বারবার আক্রমণ করে। ফলে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা আসার পর থেকে এ পর্যন্ত সাতটি হাতি মারা গেছে, যার মধ্যে একটি হাতির বাচ্চা ছিল। কিভাবে হাতির নিরাপদ আবাসস্থল, খাদ্য ও করিডোর উন্নয়ন করা যায় সে বিষয় নিয়ে ২০১৮ সালের শেষের দিকে কাজ শুরু করে বন বিভাগ।
মো: হুমায়ুন কবির বলেন, গত দুই অর্থবছরে উখিয়া ও টেকনাফে প্রায় ৭৪০ একর বন ভূমিতে হাতির নিরাপদ আবাসস্থল, খাদ্য ও করিডোর উন্নয়নের কাজ হয়েছে। যার কারণে হাতিরা ফিরে পাচ্ছে তাদের নিরাপদ স্থান। ফলে এ দুই বছরে উখিয়া ও টেকনাফের বনাঞ্চলে দেখা যাচ্ছে ২০টি অধিক হাতির বাচ্চা। হিমছড়ি, ধোয়াপালং, পানের ছড়া, ইনানী, হোয়াইক্যং, শীলখালী রেঞ্জের বনাঞ্চলে এসব হাতির বাচ্চা জন্ম নিয়েছে। প্রতিনিয়ত বনাঞ্চলের দায়িত্বরত রেঞ্জ ও বিট কর্মকর্তা এবং সিপিজি সদস্যরা বন্যহাতি ও বাচ্চা হাতির প্রতি নজর রাখছে। বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো: হুমায়ুন কবির বলেন, সর্বশেষ সোমবার কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের হোয়াইক্যং বিটের মংলা জাইন চাকমার ঘোনার বনের অভ্যন্তরে একটি হাতির বাচ্চা প্রসব করেছে। মা ও বাচ্চা হাতিটি সুস্থ রয়েছে। মা ও হাতির চলাচল নির্বিঘœ রাখতে হোয়াইক্যং রেঞ্জ সিপিজি সদস্যদের নিয়ে পাহারার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭৪০ একর পাহাড়ি বনভূমিতে বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে চাপালিশ কাঁঠাল, জাম (কয়েক প্রজাতির), আমলকী, চালতা, জগ ডুমুরসহ বেশ কিছু ফল জাতীয় গাছ। প্রাকৃতিক খাদ্যের সাথে এসব ফল হাতি নিরাপদ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে। পাশাপাশি নতুন একটি প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয়েছে। সেটি হচ্ছে হাতি চলাচলের নিরাপদ করিডোর তৈরি করা। ইতোমধ্যে রামু, উখিয়া ও টেকনাফের বেশ কিছু হাতির চলাচলের করিডোর চিহ্নিত করা হয়েছে। এই করিডোর তৈরিতে যদি জমি ক্রয় করতে হয়, তাহলে জমিও ক্রয় করা হবে। প্রজেক্টটি এখন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। মো: হুমায়ুন কবির আরো জানান, বন বিভাগ চেষ্টা করছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে হাতির একটি নিরাপদ আবাসস্থল, খাদ্য ও করিডোর তৈরি করতে, যাতে বন্যহাতিগুলোকে নিরাপদ রাখা যায়।

 


আরো সংবাদ



premium cement