২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চ্যালেঞ্জ এখন স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার

শ্রমিকদের আমরা ভোগান্তি করাতে চাইনি : বিজিএমইএ সভাপতি
-

করোনাভাইরাস মহামারীর চলমান কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেই হঠাৎই খুলে দেয়া হয়েছে রফতানিমুখী শিল্পকারখানা। ফলে ছুটিতে বাড়ি যাওয়া লাখ লাখ কর্মী কর্মস্থলে ফিরতে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন বা এখনো হচ্ছেন। যদিও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ও গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি ফারুক হোসেন বলেছিলেন, যারা কেবল ঢাকায় রয়েছেন, তারাই কেবল ১ আগস্ট থেকে কর্মস্থলে যোগ দেবেন। যারা গ্রামে গেছেন তাদের চাকরি যাবে না। তারা আস্তে আস্তে কাজে যোগ দেবেন। কিন্তু সেই কথার বাস্তবায়ন নেই। গত ৩০ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ‘গার্মেন্টসহ রফতানিমুখী শিল্পকারখানা স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা থাকবে’ বলে প্রজ্ঞাপন প্রকাশের পরপরই ঢাকায় ছুটতে থাকেন শ্রমিকরা। বাস, ট্রেন, লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় হেঁটে, ভ্যানে চড়েÑ যে যার মতো করে রওনা দেন কর্মস্থলের উদ্দেশে। সময়মতো কর্মস্থলে যোগ না দিলে চাকরি থাকবে না, এমন আশঙ্কায় যে যার মতো করে ছুটতে থাকেন ঢাকার দিকে। হঠাৎই গার্মেন্টসহ রফতানিমুখী শিল্পকারখানা খোলার ঘোষণায় চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছেন বা হচ্ছেন লাখ লাখ মানুষ, যে ভোগান্তি বর্ণনাতীত। কিন্তু কী জন্য এই তড়িঘড়ি করে গার্মেন্টসহ রফতানিমুখী শিল্পকারখানা খোলার সিদ্ধান্ত? ব্যবসায়ীরা বলছেন, বায়ারদের কাছ থেকে যে ক্রয়াদেশ রয়েছে, উৎপাদন বন্ধ থাকলে নির্দিষ্ট সময়ে তা পৌঁছানো যাবে না। এতে ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়ার আশঙ্কা ছিল। ভারত-ভিয়েতনামসহ রফতানিমুখী পণ্য উৎপাদনকারী দেশগুলোতে কারখানা বন্ধ নেই। ফলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজার হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়।
পবিত্র ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে গত ১৫ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই সকাল পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করে সরকার। ঈদের পরে ২৩ জুলাই থেকে ফের কঠোর বিধিনিষেধ থাকবে এবং গার্মেন্টসহ সব শিল্পকারখানাও বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়া হয়। এতে ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে কর্মরত লাখ লাখ শ্রমিক ছুটিতে গ্রামে চলে যান। যদিও তখনো করোনা মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি বিশেষজ্ঞ কমিটি সরকারের ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছিল। এরপর ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ফের কঠোর বিধিনিষেধ জারি করে সরকার। যেখানে সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধের পাশাপাশি গার্মেন্টসহ সব কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শুরু থেকেই ব্যবসায়ীরা শিল্পকারখানা খোলা রাখার পক্ষে সরকারের বিভিন্ন মহলে ধরনা দেন। সর্বশেষ ২৫ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের সভায়ও সিদ্ধান্ত হয় শিল্পকারখানা বন্ধই থাকবে। কিন্তু থেমে থাকেননি ব্যবসায়ীরা। তারা তাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। এরই মধ্যে ৩০ জুলাই চলমান কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেই গার্মেন্টসহ অন্যান্য রফতানিমুখী শিল্পকারখানা খুলে দেয়ার ঘোষণা দেয় সরকার। এতে ক্ষুব্ধ হন করোনা মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি বিশেষজ্ঞ কমিটি। কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা: মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, চলমান লকডাউনের মধ্যে গার্মেন্ট খোলার সিদ্ধান্ত করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি আরো বাড়াবে। তিনি বলেন, ‘দুই সপ্তাহের কঠোর লকডাউন অবশ্যই সংক্রমণ রোধের একটি বিজ্ঞানসম্মত উপায়। কিন্তু সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত নিশ্চিতভাবে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে।’ একইভাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও করোনা ঝুঁকি বাড়ার কথা বলেন গণমাধ্যমে।
‘জরুরিভিত্তিতে কারখানা খোলা হলোÑ এ মুহূর্তে কী পরিমাণ ওয়ার্ক অর্ডার রয়েছে’Ñ জানতে চাইলে বিজিএমইএ’র সভাপতি ফারুক হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, কী পরিমাণ আছে এ মুহূর্তে সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। তবে সব ফ্যাক্টরিতেই কাজ আছে। সবার কাছেই মোটামুটি ভালো কাজ আছে। আর আমরা ওয়ার্ক অর্ডারের জন্য শুধু না, সার্বিক বিষয় চিন্তা করেই আমরা ফ্যাক্টরি খোলার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। শ্রমিকদের টিকাদান, পোর্টের অ্যাকটিভিটিজ চালু, সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখার জন্য। কারণ অনেক দিন বন্ধ থাকলে তখন পোর্ট কলাপস হয়ে যাবে। জিনিসপত্র আনা-নেয়া করতে হয়। তিন দিন পোর্ট থেকে মাল বের না করলেই পোর্টের ক্যাপাসিটি থাকে না। পোর্টে আমাদের খাদ্যশস্য ইমপোর্ট করতে হয়, অনেক র ম্যাটারিয়ালস, শিশুর দুধটা পর্যন্ত ইমপোর্ট করতে হয়। তিনি বলেন, শ্রমিকদের আমরা ভোগান্তি করাতে চাইনি। ঢাকা শহরের মধ্যে আমাদের তিন লাখ শ্রমিকও কাজ করে না। কোথা থেকে এত ছবি, কোথা থেকে এত জিনিস..., আমাদের ফ্যাক্টরি সব ঢাকার বাইরে। মানিকগঞ্জ, কুমিল্লা, ঈশ্বরদী, মাওনা, শ্রীপুর, গাজীপুরÑ এসব জায়গায় বেশি ফ্যাক্টরি। যেখানে স্থানীয় শ্রমিকই বেশি। অনেকে ঈদের ছুটিতে গ্রামে যায়নি, অনেকে গেলেও ঈদের পরদিনই চলে এসেছে। সেসব শ্রমিককে নিয়েই আমরা কাজ শুরু করেছি। তার পরও অনেক শ্রমিক বিভিন্ন জায়গা থেকে রওনা দিয়েছে। বলে দেয়া হয়েছিল যারা গ্রামে আছে তারা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চালুর পর এলেও চাকরি যাবে না। তার পরও যদি আসে, জোর করে তো আর ভোগান্তি করা হয়নি। এসব বলছেন না কেন? এই যে আগের (রোজা) ঈদে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ গ্রামে গেছে। তারা কি আমাদের লোক ছিল? তখন তো আমাদের কোনো ফ্যাক্টরি ছুটি হয়নি। তখন তো কাউকে ধরলেন না?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হঠাৎ কারখানা খোলায় শ্রমিকদের চরম ভোগান্তি সহ্য করতে হয়েছে। চরম কষ্ট সহ্য করে যারা কারখানায় কাজে যোগ দিচ্ছেন, তাদের স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করাই এখন চ্যালেঞ্জের বিষয়। শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি কিভাবে মেইনটেইন করবেন, জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, আমাদের মনিটরিং টিম আছে। শ্রমিকদের মাস্ক পরা ছাড়া কাউকে ঢুকতে দিচ্ছি না। শ্রমিকদের আমরা কোটি কোটি মাস্ক দিয়েছি। জানি না অন্যরা কী করেছেÑ আমাদের কর্মীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করেছি। আপনারা কতটা করাতে পেরেছেন জানি না। আমরা পেরেছি। এ কারণে কর্মীদের মধ্যে কোনো সংক্রমণ হয়নি। এখন তো বলতে পারব না যে হবে (সংক্রমণ) কি হবে না। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, আমার মনে হয় তারা (ব্যবসায়ী) চাপের মধ্যে আছেন, বেশ কয়েক দিন তো বন্ধ (কারখানা) থাকল। এটি (কারখানা খুলে দেয়া) হয়তো আরো পরিকল্পিতভাবে করলে শ্রমিকদের আসতে যে কষ্ট হচ্ছে, সেটি হয়তো হতো না। স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ফেরত আসতে পারত। এখন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বজায় রেখে যাতে চালু রাখা যায়, সে জন্য মালিকদের পাশাপাশি সরকারকেও মনিটরিং করতে হবে। তাদের ক্রয়াদেশ চলে আসছে এবং একটি চাপ আছে, এটি ঠিক। কিন্তু ক্রয়াদেশ আসছে সেসব দেশ থেকে যেখানে স্বাস্থ্যের কারণে বায়াররা যাচ্ছে না। আমাদের এখানে সেই সুরক্ষাটা নিশ্চিত করতে হবে, তা না হলে আমাদের দেশ থেকেও তারা চলে যাবে। আমাদের ব্যালান্স ওয়েতেই সিদ্ধান্তটা কার্যকর করতে হবে। তিনি বলেন, কারখানায় স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে সার্বক্ষণিক মনিটরিং রাখতে হবে। তা না হলে অন্যান্য দেশ থেকে যে কারণে আমাদের দেশে ক্রয়াদেশ চলে আসছে স্বাস্থ্য সুরক্ষার অভাব হলে আমরা আবার বিপরীতমুখী প্রবণতাও দেখতে পাবো। সেটি আমাদের বিশেষ বিবেচনায় রাখতে হবে।
সরকারের এমন সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সম্মিলিত গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আকতার বলেন, হঠাৎ কারখানা খুলে দেয়ার সরকারের এমন সিদ্ধান্তে শ্রমিকরা আবারো সঙ্কটে পড়ে গেলেন।


আরো সংবাদ



premium cement